–ফকির সাবেরে পাও ধোয়া, পানি দে, সরবত দে।
জামাই আদর।
এক সময় আমরার কদর ছিল বউ। জামাই আদরই ছিল–গুণীন তো আর পথে-ঘাটে জন্মায় না। দশ গ্রামে বিশ গ্রামে একটা। যাই হোক, গল্পটা শোন। আমি উঠানে বইস্যা দুই ঝাড়া দিয়া পাইলাম–হাওলাদার সাহেবের পুত্রবধূ জ্বীনের সাথে একবার বেয়াদবি করছিল।
কি বেয়াদবি?
জ্বীন পুসকুনিতে গোসল কইরা পাকপবিত্র হইয়া আসতেছিল, তখন হাওলাদার সাহেবের পুত্রবধূ নাক ঝাড়া দিয়া তার গায়ে নাকের সর্দি ফেলছে। তারপর থাইক্যা। জীন লাগছে তার পিছনে। অল্প বয়সী চেংড়া জ্বীন–নাম হইল কলিন্দর। শাহবাজ। এরার মিজাজ খুবই চড়া থাকে। এই হইল ইতিহাস।
আপনে কি করলেন? জ্বীনের শইলের সর্দি মুইছা দিলেন?
তা না। জ্বীন তাড়াইলাম। দেশছাড়া করলাম।
এক্কেবারে দেশান্তরী?
অবশ্যই। মন্ত্রের তো আমার কাছে অভাব নাই বউ। একটায় কাজ না করলে আরেকটা দেই। কোন কিছুই যখন কাজ করে না তখন আছে কুফুরি কালাম। বড় কঠিন জিনিস। অষুধের মধ্যে যেমন পেনিসিলিন ইনজেকশন–মন্ত্রের মধ্যে তেমন কুফুরি কালাম। পাক কোরানের কালাম উল্টাপাল্টা কইরা পড়তে হয়। বিরাট গুনার কাজ। কিন্তু উপায় কি? গুণীন হইয়া জন্মাইছি গুনা তো করতেই হইবে। রোজ হাশরে এর শক্ত বিচার হবে। আমরা যারা গুণীন আমরার সামনে তোমরা চেলচেলাইয়া বেহেশতে যাইবা। আর আমরা দোজখের আগুনে পুইড়া মরব। এইটাই বিধান।
চান্দ শাহ ফকির তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে গল্প শেষ করে। বারুদের মত জ্বলে উঠে ফুলবানু।
এইসব মিথ্যা কথা বইল্যা আফনে মানুষ ঠকান? আফনের লজ্জা নাই?
ফুলবানু রোগের কথা ভুলে বিছানায় উঠে বসে। চান্দ শাহ ফকির শংকিত বোধ করে। কাটা খাল বেয়ে কুমীর চলে এসেছে। তাও ছোটখাট কুমীর না, বিরাটাকার কুমীর।
দুনিয়ার বেবাক মন্ত্র গুইল্যা খাইছেন? বলতে শরম লাগে না?
চান্দ শাহ ফকির ক্ষীণ গলায় বলল, শরমের কি আছে? শরম নারীর ভূষণ, পুরুষের কলংক।
শরমের কিছু নাই? তা হইলে মন্ত্রের একটা খেলা দেখান দেখি? নিদালী মন্ত্র পইরা একটা ফুঁ দিয়া আমারে ঘুম পাড়াইয়া দেন। না দিলে আইজ অসুবিধা আছে।
রাইত দুপুরে কি চিল্লা ফাল্লা শুরু করলা?
হয় মন্ত্রের খেলা আইজ আফনে দেখাইবেন, নয় গলায় গামছা দিয়া কইবেন মন্ত্রফ কিছু জানি না। যা বলি সবই মিথ্যা।
এইটা যদি স্বীকার পাই তাইলে তো মিথ্যা কথা হয়, মিথ্য বলি ক্যামনে বউ?
ওরে বাবা রে, আমার সত্যবাদী রে!
বুঝলা বউ, মন্ত্র-তন্ত্রের এই বিদ্যা যারা চর্চা করে মিথ্যা বলা তাদের জন্য সম্পূর্ণ নিষেধ।
ফুলবানু হাসতে শুরু করে। অপ্রকৃতস্থ মানুষের হাসি। হাসতে হাসতে তার হিক্কা উঠে যায়। চান্দ শাহ ফকির বড় অসহায় বোধ করে। মনে মনে বলে–কি যে। যন্ত্রণায় পড়লাম! গল্প শুরু না করলেই হত।
এক শ্রাবণ মাসের মধ্যরাতে ফুলবানুর বুকে তীব্র ব্যথা হল। বিছানায় শুয়ে সে ছটফট করতে লাগল। সমস্ত শরীর তার নীলবর্ণ হয়ে গেল। চান্দ শাহ ফকির স্ত্রীর অবস্থা দেখে অবাক হল। মুখে স্বীকার না করলেও স্ত্রীকে সে অত্যন্ত পছন্দ করে। তার চিৎকার, তার রাগারাগি সবই পছন্দ করে। চান্দ শাহ ফকিরের ইচ্ছা করতে লাগল চিৎকার করে কাঁদে। গুণীনদের জন্যে চোখের পানি ফেলা পুরোপুরি নিষিদ্ধ বলে চোখের পানি ফেলতে পারছে না। ফুলবানু স্বামীকে ডেকে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমার মৃত্যুর সময় হইছে। আফনেরে একটা অনুরোধ।
চান্দশাহ বলল, বল বউ কি অনুরোধ। তুমি যা বলবা আমি তাই করব। জ্বীন চালান দিয়া অষুধ আইন্যা দিতেছি। একটু সবুর কর। জ্বীনের রাজধানী হইল কোহকাফ নগর। সেই রাজধানী থাইক্যা অষুধ চইল্যা আসবে।–
আবার মিথ্যা?
চান্দ শাহ নিঃশ্বাস ফেলল। আগের মত জোর গলায় বলতে পারল না–সে যা বলছে তা মিথ্যা না। ফুলবানু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মন্ত্র-তন্ত্র নিয়া আর মিথ্যা ভণ্ডামি কইরেন না। আফনের আল্লাহর দোহাই লাগে।
চান্দ শাহ ধরা গলায় বলল, আচ্ছা যাও করব না।
মোবারকরে ডাক দিয়া বলেন, সব মিথ্যা। বোকাসোকা মানুষ, একটা আশার মধ্যে আছে। আপনে তারে অদৃশ্য মন্ত্র দিবেন।
আচ্ছা, তারে বলতেছি।
এখনই বলেন।
এত অস্থির হইও না বউ। শান্ত হও।
শান্ত পরে হব–আগে আপনে তারে বলেন। আমার সামনে আইন্যা বলেন। নিজের কানে শুনি।
চান্দ শাহ মোবারককে ডেকে আনলেন। ধরা গলায় বললেন, মোবারক শোন, মন্ত্রফ আসলে কিছু না। এতদিন তোরে যা বলছি সবই মিথ্যা। বুঝছস?
ছি না।
ফুলবানু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মন্ত্র হইল ধাপ্পাবাজি, বুঝছস? মন্ত্র বইল্যা কিছু নাই। মন্ত্র থাকলে আইজ আমরার এই অবস্থা? খাওন নাই, পিন্দনের কাপড় নাই, রোগে চিকিৎসা নাই। মন্ত্র হইল মিথ্যা।
মন্ত্র মিথ্যা মামী?
হ রে ব্যাটা মিথ্যা। তুই বেহুদা তর মামার পিছে পিছে ঘুরিস না। কাজ কইরা খা।
জি আইচ্ছা।
জ্বি আইচ্ছা না। আইজই বিদায় হ–এক্ষণ যা।
চান্দ শাহ ফকির বিরক্ত গলায় বলল, এক্ষণ যাওয়ার দরকার কি? ধীরে সুস্থে যাইব। ঘরে এমন রোগী, কখন কি দরকার হয়।
ফুলবানু বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল, না, হে এক্ষণ যাইব। এক্ষণ। এক্ষণ বিদায় না হইলে আফনে তারেও মন্ত্র শিখাইবেন। হেও হইব আফনের মত ধান্ধাবাজ। তার জীবন কাটব দুঃখে দুঃখে …।
ঠিক আছে, অস্থির হইও না। ব্যবস্থা করতেছি।
ব্যবস্থা করা করি না। মোবারকরে বিদায় করেন। টেকা পয়সা যদি কিছু থাকে মোবারকের হাতে দেন। দিয়া বিদায় করেন।