রাশি কি তা তো ফকির মামা জানি না।
আইচ্ছা, দেখব নে পরীক্ষা কইরা। তুলারাশি বইল্যা মনে হয় না। তুই বিরাট গাধা। তুলারাশির মধ্যে গাধা হয় না। যাই হউক, তুই চিন্তা করিস না। জবান যখন দিছি তোরে একটা বিদ্যা দিয়া যাব। কোন বিদ্যা চাস? বল মুখ ফুইট্যা। শরমের কিছু নাই। শরম নারীর ভূষণ, পুরুষের কলংক।
আন্ধাইর মন্ত্র শিখাই দিয়েন।
আবে ব্যাটা তুই কস কি? এই মন্ত্র যারে তারে দেওয়া যায় না। বড় কঠিন। মন্ত্র। দুই বার এই মন্ত্র পইড়া ডাইন কান্দে একবার ফু, বাও কান্দে একবার ফু, বাস, আর দেখা লাগবে না। তুই হবি অদৃশ্য। তুই সবেরে দেখবি, তোরে কেউ দেখব না। তুই হবি অদৃশ্য মানব। এই মন্ত্র যারে তারে দেয়া যায় না–শোন তাহলে একটা গফ–আমার তখন জোয়ান বয়স। বাশখালি অঞ্চলের নামকরা চোর মজনু মিয়া এক রাইতে আমার পায়ে আইস্যা পড়ল। দুইটা মন্ত্র চায়–নিদালী মন্ত্র আর আন্ধাইর মন্ত্র। বলে কি–ফকির সাব, এই দুই মন্ত্র দেন–আর টেকা কি লাগব কন। টেকা কোন বিষয় না। আমি বললাম, এইটা তো হবে না। এই মন্ত্র যার তার হাতে দেওয়া যায় না। ওস্তাদের নিষেধ আছে। কঠিন নিষেধ।
মজুন মিয়া তখন আমারে ভয় দেখায়। বলে কি–মন্ত্র না দিলে ফকির সাব আফনের কিন্তু অসুবিধা হবে। আমি সহজ লোক না। আমি জটিল লোক।
আমি মনে মনে হাসলাম। যার জ্বীনসাধনা তারে ভয় দেখায়। হাতি-ঘোড়া গেল তুল পিপিলিকা বলে কত জল। হায় রে বেকুব–পরের ঘটনা বিরাট ইতিহাস।
ইতিহাসটা কি?
চান্দ শাহ ফকির উদাস গলায় বলে–সব ইতিহাস শুননের দরকার নাই। মোবারক। কাজ কর, কাজ কর। মন দিয়া কাজ করলে তোর গতি করে দিয়ে যাব। চান্দ শাহ ফকির জবান ঠিক রাখে।
ইতিহাসটা জাননের ইচ্ছা হইতাছে মামা।
দিক করিস না মোবারক। কাজ করতে বলছি কাজ কর। গুণীন যারা তারার কথা বলতে হয় কম। কথা বেশি বললে মন্ত্রের জোর কমে। আইজ এক দিনে মেলা। কথা বইল্যা ফেলছি। আর না।
কথা বললে যদি মন্ত্রের জোর কমে তাহলে চান্দ শাহ ফকিরের মন্ত্রে কোন জোর থাকার কথা না। কথা বলার কোন সুযোগই সে নষ্ট করে না। অন্য গ্রামের অচেনা কেউ এলে তো কথাই নেই। এ রকম ঘটনা আজকাল ঘটে না। পীর-ফকির গুণীনের আগের রমরমা নেই।
আগে কি দিন ছিল আর এখন কি দিন! চান্দ শাহ ফকির ছাতিম গাছের নিচে বসে বর্তমান দিনের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আগের দিনে কথায় কথায় গুণীন ডাকতো। গুণীন ছাড়া সমাজ ছিল অচল।
পাগলা কুকুরের কামড় : হলুদ পোড়া।
সাপের কাটা : কালো তাগা।
জীনের দৃষ্টি : লোহাপড়া। সোলেমানী তাবিজ।
ভুতের বাতাস : সরিষা পড়া।
পরীর নজর : বাড়ি বন্ধন।
চোরের উপদ্রব : কণ্টক মন্ত্র।
নয়া আবু রাতে ঘুমায় না, চিল্লাফাল্লা করে : আবু নিদালী।
সেই আমলে একটা গুণীনের দিন ভালই চলে যেত। খাওয়া-পরার রমরমা না থাকলেও অনাহারে থাকতে হত না। নতুন ধান উঠলে গুণীনের বাড়িতে এক ধামা ধান পাঠিয়ে দেয়া রেয়াজের মধ্যে ছিল। লাউগাছে দশটা লাউ ফললে একটা লাউ পাঠিয়ে দেও গুনীনের কাছে।
এইসব সভ্যতা-ভব্যতার আজকাল কিছুই নাই। মন্ত্র-তন্ত্রের উপর থেকে মানুষের বিশ্বাস উঠে গেছে। পাগলা কুকুরে কামড় দিলে হলুদ পোড়ার জন্যে তার কাছে আসে না। রোগী নিয়ে সোজা চলে যায় সদরে। নাভির মধ্যে সাত ইনজেকশান। এতে নাকি রোগ আরাম হয়। কি বে-সম্ভব কথা!
চান্দ শাহ ফকিরের দিনকাল বড়ই খারাপ যায়। স্ত্রীর কটু কথা মুখ বুজে শুনতে হয়। অভাব-অনটনে রোগে ব্যাধিতে ফুলবানুর মাথা থাকে চড়া। কড়া কথা যখন বলে কঠিন করেই বলে। আগে হঠাৎ হঠাৎ বলতো, ইদানীং প্রায় রোজই বলছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ছাতিম গাছের নিচ থেকে ঘরে ঢুকতে আজকাল চান্দ শাহ ফকির আতংকগ্রস্ত হয়। মনে হয়, না জানি কপালে কি আছে।
চান্দ শাহ ফকির রাতে শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়তে পারে না। বয়সের কারণে। তার ঘুম কমে গেছে। বিছানায় চুপচাপ শুয়ে থাকতেও তার ভাল লাগে না–গল্প করতে ইচ্ছা করে। ফকিরী গল্প। গল্প শুরু করলে ফুলবানু এমন হৈ চৈ শুরু করে। যে চান্দ শাহর আফসোসের সীমা থাকে না কেন সে গল্প শুরু করল! চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকলে এই যন্ত্রণা হত না। একে বলে খাল কেটে কুমীর আনা।
আজ রাতেও এ রকম খাল কাটার ব্যাপার ঘটেছে। চান্দ শাহ ফকির মনের আনন্দে খাল কেটে যাচ্ছে। সে তার এক ফকিরী গলপ শুরু করেছে। গল্প বলতে বড় ভাল লাগছে। সে বুঝতেই পারছে না কিছুক্ষণের মধ্যেই তার কাটা খালে কুমীর আসবে। আলিশান কুমীর।
বুঝলা বউ, তখন আমার যৌবন কাল। তোমার সঙ্গে তখনো বিবাহ হয় নাই। টুকটাক ফকিরি করি। ফকিরের তো আর চব্বিশ ঘণ্টার কাজ না। যখন ডাক পড়ে ফট। বাকি সময় গান-বাজনা করি। যৌবনকালে ঢোল ভাল বাজাইতাম। মন্দিরাও শিখছিলাম। তবে ঢোল হইল মন্দিরার চেয়ে কঠিন বিদ্যা। শুনতেছ বউ?
শুনতেছি। বলেন।
তখন মুরাদপুর গ্রাম থাইক্যা একটা ডাক পাইলাম। মুরাদপুর গ্রামের বিশিষ্ট জোতদার ইয়াজুদ্দীন হাওলাদার মহিষের গাড়ি পাঠায়ে দিয়েছেন আমাকে নিবার জন্যে। কারণ তার পুত্রবধূর প্রসববেদনা। বউ শুনতেছ? বড়ই চমকপ্রদ কাহিনী।
আফনের চমকপ্রদ কাহিনী শুনতেছি।
হাওলাদার সাহেবের পুত্রবধূ হইল মৃতবৎসা। মৃতবৎসা বুঝলা তো–সন্তান হয়, আর বাঁচে না। আমার ডাক পড়ছে বিষয় কি দেখার জন্যে। গিয়া দেখি মেলা ডাক্তার-কবিরাজ আছে, আমিও তাদের মধ্যে শামিল হইলাম। হাওলাদার সাহেব বিরাট সম্মান করলেন। হাত ধইরা অন্দরে নিয়া গেলেন। হাঁক-ডাক শুরু করলেন।