চান্দ শাহের স্ত্রীর নাম ফুলবানু। সে দীর্ঘদিন রোগ ভোগ করে এখন বিছানায় পড়ে গেছে। নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই তবে জিহ্বা অত্যন্ত সচল। সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে–কি মন্ত্রের কথা কইলেন?
মারী-মন্ত্র। মন্ত্র ঝাড়া মাত্র গ্রামের ঈশাণ কোন থাইকা শুরু হবে রোগব্যাধি–আস্তে আস্তে পুরা গ্রাম। বড় কঠিন মন্ত্র। একবার ঝাড়লে মন্ত্র কাটান দেওয়া মুশকিল। তুমি যদি বল একবার মন্ত্র ঝাড়ি। উচিত শিক্ষা হউক। গ্রামের সব মুরুব্বী যখন পায়ের উপরে উপুড় হয়ে পরব তখন একটা বিবেচনা হবে।
ফুলবানু বলল, এই জাতের কথা বলতে আফনের শরম লাগে না? মন্ত্রের আফনে কি জানেন? কাচকলাটা জানেন।
বউ, কি বললা?
বললাম মন্ত্রের আফনে কাচকলাটা জানেন। আফনে হইলেন ঠগ। বিরাট ঠগ।
ঠগ বললা?
হ্যাঁ বললাম। অহন কি করবেন? বান মারবেন?
বান তো মারতেই পারি। বান মারা কোন বিষয় না। হাতের ময়লা।
মারেন দেখি একটা বান।
চান্দ শাহ হুঁকায় তামাক ভরতে ভরতে বলল, তুমি রোগী মানুষ বইল্যা ছাইড়া দিলাম। না হইলে সরিষা মন্ত্র দিয়া দিতাম। দেখতা, বিষয় কি! হাতের তালুর মধ্যে পাঁচটা কাঁচা সরিষা নিয়া মন্ত্র পড়তে হয়, তারপরে সেই সরিষা ছুইড়া দিতে হয় শইল্যে। সরিষা তো না, সাক্ষাত হাবিয়া দোজখের আগুন। শইলের যে জাগাতে লাগবে সেই জাগাত সাথে সাথে গোল আলুর মত ফোঁসকা। সারা শইল্যেও মনে হইব আগুন জ্বলছে। ইচ্ছা হবে শীতল পানিতে ঝাঁপ দিয়া পড়ি। ঝাঁপ দিয়া পড়লে আরো বিপদ। পানি তখন আগুনের মত। শইল্যে পানি লাগল কি গেল।
দেন না এট্র সরিষা পড়া। আফনের ক্ষমতাটা দেখি। দেখি আফনে কত বড় গুণীন। বিয়ার পর থাইক্যা আমি শুনতাছি–আমার এই ক্ষমতা, সেই ক্ষমতা, মারী-মন্ত্র, সরিষা মন্ত্র। ভর ভর কইরা বলেন, বলতে শরমও লাগে না। ছিঃ ছিঃ!
রাগ উঠাইও না বউ। রাগ উঠাইলে নিজের ক্ষতি হবে।
আহারে–রাগ উঠাইলে নিজের ক্ষতি হবে! কি আমার উস্তাদ। দুনিয়ার বেবাক মন্ত্র জানে। তার হুকুমে চলে জ্বীন পরী। হেই লোক দুই বেলা ভাত পায় না। আফনের পুষা জিন যেন কয়টা আছে?
তামাক টানতে টানতে চান্দ শাহ উদাস গলায় বলে–আমার পোষা না। আমার বাপজান পুষেছিলেন–এখন আমার দখলে আছে। তিনটার ভেতর একটার মৃত্যু হয়েছে। এখন আছে দুইটা। একজনের নাম দাস্তিন, আরেকজনের নাম নাস্তিন। এরা দুই সহোদর ভাই।
দুই জ্বীন আফনের হুকুমের চাকর। হেই দুই জ্বীনরে দিয়া এক কলসি সোনার মোহর আনাইয়া দেন। যে কয়টা দিন বাচি আরাম কইরা বাচি। ভালমন্দ কিছু খানা খাই। দুই হাতে ছয় গাছি, ছয় গাছি সোনার চুড়ির আমার বড় শখ।
চান্দ শাহ গম্ভীর মুখে বলে, সোনার মোহরের কলসি কোন ব্যাপারই না বউ। জ্বীনেরে আইজ বললে আইজ আইন্যা দিবে। কিন্তু নিষেধ আছে। নিজের লাভের জন্যে কিছু করার উপায় নাই। আমার হাত-পা বান্ধা বউ। তাহলে শোন তোমারে একটা গল্প বলি–আমার পিতার আমলের কথা। উনার যেমন জ্বীনসাধনা ছিল, তেমনি ছিল পরীসাধনা। একটা পরী ছিল ওনার খুব পেয়ারের। তার নাম একরার বেগম। বড় সৌন্দর্য ছিল সে। চান্দের আলোর মত গায়ের রঙ। আহা রে, কি বিউটি!
কানের কাছে ভ্যান ভ্যান কইরেন না। জ্বীনসাধনা পরীসাধনা, ওরে আমার সাধক রে! দূর হন দেখি, দূর হন।
স্ত্রীর কটু কথায় চান্দশাহর মত বড় সাধককে খুব বিচলিত হতে দেখা যায় না। সে হুক্কা হাতে বাড়ির সামনের উঠানে ছাতিম গাছের নিচে এসে বসে। দিনের বেশিরভাগ সময় এই গাছের নিচেই সে বসে। কিছুদিন আগেও ছাতিম গাছে একটা সাইনবোর্ড ঝুলতো।
চান্দশাহ ফকির
জ্বীনসাধনা, পরীসাধনা,
তাবিজ, যাদু-টোনা, বশীকরণ,
মারণ, উচাটন, কড়ি চালনা,
বাটি চালনা, তেলপড়া, চুনপড়া
(বিফলে মূল্য ফেরত)
রোদে, বৃষ্টিতে, ঝড়ে, তুফানে সাইনবোর্ড পচে গলে গিয়েছে। নতুন সাইনবোর্ড কিনতে একশ কুড়ি টাকা লাগে। এত টাকা চান্দ শাহর নেই। সে হত-দরিদ্র। কাজেই। তাকে এখন মূর্তিমান সাইনবোর্ড হিসেবে বসে থাকতে হয়। বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ গেলে গভীর আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে–কে যায়? আজিজ মিয়া না? খবর কি?–বস, দুই একটা গফসফ করি। শরীর ভাল? মুখটা মলিন দেখতেছি কেন?
আজিজ মিয়ার তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। ভিন গ্রামের কেউ গুণীনের খোঁজে এলে চান্দশাহ ফকিরের ভাবভঙ্গি বদলে যায়। সে ভারি গলায় বাড়ির দিকে তাকিয়ে ডাক দেয়–মোবারক, তামুকে আগুন দেও দেখি। মোবারককে এমিতে তুই তুই করে বলা হলেও এই সময় তার সম্বোধন হয়ে যায় তুমি।
মোবারক চান্দ শাহ ফকিরের সঙ্গে থাকে। ফকিরকে সে মামা ডাকে। তার বয়স এগারো। অকাট গাধা। গাধারা যেমন কাজকর্মে ভাল হয় মোবারকও কাজকর্মে ভাল। রান্নাবান্না, কলসি করে টিউবওয়েলের পানি আনা, হাট-বাজার করা, কাপড় ধোয়া, রোগীর যত্ন–সব সে একাই করে। হাসিমুখে করে। চান্দশাহ ফকির মোবারককে বেতন দেয় না, সেই সামর্থ তার নেই–দুবেলা খাওয়া দিতে পারে না, বেতন তো অনেক পরের ব্যাপার। মোবারকের তা নিয়ে মাথাব্যথাও নেই। সে আনন্দেই আছে, কারণ চান্দশাহ ফকিরের আশেপাশে থাকাকেও সে ভাগ্য বলে মনে। চান্দ শাহ ফকির তাকে পছন্দও করে। মন টন খুব উদাস হলে মোবারককে ডেকে বলে–
ও মোবারক! তোর কোন চিন্তা নাই–মন দিয়া কাজকর্ম কর। আমার মৃত্যুর আগে তোরে একটা ফকিরি বিদ্যা দিয়া যাব। সব দিতে পারব না। বড় কঠিন বিদ্যা। তবে একটা পাবি। একটা বিদ্যাই যথেষ্ট। সারা জীবন এই বিদ্যা বেইচ্যা খাবি। সুখে থাকবি। ক দেহি কোন্ বিদ্যা চাস? নখ-পড়া শিখবি? টেলিভিশনের পর্দায় যেমুন ছবি দেখা যায় তেমুন নখের উপরে ফকফকা কালার ছবি দেখবি। তোর রাশিটা কি? তুলারাশি ছাড়া আবার হয় না।