কুদ্দুস ব্যাকুল গলায় বলল, স্যার, গোলাম হয়ে থাকব মানে হল স্যার আপনার সার্ভেন্ট হয়ে থাকব। আমি আপনার মুখ দেখতে পারছি না। মুখ দেখতে পারলে ভয়টা একটু কমত।
আমরা ইচ্ছা করেই তোমাকে মুখ দেখাচ্ছি না। মুখ দেখালে ভয় আরো বেড়ে যেতে পারে।
স্যার, যে ভয় লিফটের ভিতর পেয়েছি, এরপর আর কোন কিছুতেই কোন ভয় পাব না। রয়েল বেঙ্গলের খাচার ভেতর ঢুকে রয়েল বেঙ্গলকে চুমু খেয়ে আসব। তার লেজ দিয়ে কান চুলকাব, তাতেও স্যার ভয় লাগবে না।
তোমার নাম যেন কি বললে–কুদ্দুস?
জ্বি স্যার, কুদ্দুস।
একটা জিনিশ একটু বোঝার চেষ্টা কর–তুমি হচ্ছ ত্রিমাত্রিক জগতের মানুষ। তোমাদের জগতের প্রাণীদের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এই তিনটি মাত্রা আছে। এই দেখে তোমরা অভ্যস্ত। আমরা চার মাত্রার প্রাণী। চার মাত্রার প্রাণী সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই।
স্যার, আপনি আমার মত বাংলা ভাষায় কথা বলতেছেন, এইটা শুনেই মনে আনন্দ পাচ্ছি। আপনার চেহারা যদি খারাপও হয়, কোন অসুবিধা নাই। চেহারার উপর তো স্যার আমাদের হাত নাই। এটা হল বিধির বিধান।
আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি আমাকে দেখ।
কুদ্দুসের শরীরে হালকা একটা কাপুনি লাগল। হঠাৎ এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া লাগলে যে রকম লাগে, সে রকম। তারপরই মনে হতে লাগলো তার চারপাশে যত বেগুনী রঙ আছে সব তার চোখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আবার চোখের ভেতর থেকে কিছু কিছু রঙ বের হয়ে আসছে। এ কি নতুন মুসিবত হল!
এ আচমকা রঙের আসা-যাওয়া বন্ধ হল। কুদ্দুস তার চোখের সামনে কি একটা যেন দেখল। মানুষের মতই মুখ, তবে স্বচ্ছ কাচের তৈরি। একটা মুখের ভেতর আরেকটা, সেই মুখের ভেতর আরেকটা–এই রকম চলেই গিয়েছে। মুখটার চোখ দুটাও কাচের। সেই চোখের যে কোন একটার দিকে তাকালে তার ভেতরে আর একটা চোখ দেখা যায়, সেই চোখের ভেতর আবার আরেকটা … ঘটনা এইখানে শেষ হলে হত, ঘটনা এইখানে শেষ না। কুদ্দুসের কখনো মনে হচ্ছে সে ভয়ংকর এই মানুষটার ভিতরে বসে আছে, আবার পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে ভয়ংকর এই মানুষটা তার ভেতরে বসে আছে। এই কুৎসিত জিনিশটাকে মানুষ বলার কোন কারণ নেই, মানুষ ছাড়া কুদ্দুস তাকে আর কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
জ্বি না, স্যার। যদি কিছু মনে না করেন–একটু পেসাব করব, পেসাবের বেগ। হয়েছে।
কি করবে?
প্রস্রাব করব। আপনাদের বাথরুমটা কোন দিকে?
তোমার কথা বুঝতে পারছি না–কি করতে চাও?
স্যার, একটু টয়লেটে যাওয়া দরকার।
ও আচ্ছা। আচ্ছা, বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন। তুমি তো আমাদের মহা সমস্যায় ফেললে। আমাদের এখানে এরকম কোন ব্যবস্থা নেই।
বলেন কি স্যার!
আমরা দেহধারী প্রাণী নই। দেহধারী প্রাণীদের মত আমাদের খাদ্যের যেমন প্রয়েজন নেই তেমনি টয়লেটেরও প্রয়েজন নেই। এখন তুমি টয়লেটে যেতে চাচ্ছ, আমাদের ধারণা কিছুক্ষণ পর তুমি বলবে খিদে পেয়েছে।
সত্যি কথা বলতে কি স্যার, খিদে পেয়েছে। সকাল বেলা নাসতা করি নাই। মারাত্মক খিদে লেগেছে। চক্ষুলজ্জার জন্যে বলতে পারি নাই। সকাল থেকে এই পর্যন্ত কয়েক চুমুক চা শুধু খেয়েছি, পত্রিকাও পড়া হয় নাই–আপনাদের এখানে। পত্রিকা আছে স্যার?
না, পত্রিকা নেই।
জায়গা তো তাহলে খুব সুবিধার না।
আমাদের জায়গা আমাদের মত, তোমাদের জায়গা তোমাদের মত।
আপনাদের তাহলে ইয়ে হয় না?
ইয়ে মানে কি?
পেসাব-পায়খানার কথা বলতেছি–বর্জ্য পদার্থ।
না, আমাদের এই সমস্যা নেই। তোমাকে তো একবার বলা হয়েছে আমরা। তোমাদের মত দেহধারী না। শুধু দেহধারীদেরই খাদ্য লাগে। খাদ্যের প্রশ্ন যখন আসে তখনই চলে আসে বর্জ্য পদার্থের ব্যাপার।
তবু স্যার, আমার মনে হয় বাইরের গেস্টদের জন্য দুই-তিনটা টয়লেট বানিয়ে রাখা ভাল।
দেহধারী কোন অতিথির আমাদের এখানে আসার উপায় নেই। আপনি তো স্যার একটা মিসটেক কথা বললেন। আমি চলে এসেছি না?
হ্যাঁ, তুমি চলে এসেছ। অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিভাবে এসেছ সেই রহস্য এখনো ভেদ করা সম্ভব হয়নি।
স্যার বিশ্বাস করেন, নিজের ইচ্ছায় আসি নাই। যে দেশে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা নাই, পেসাব-পায়খানার উপায় নাই, সেই দেশে খামাখা কি জন্যে আসব বলেন? তাও যদি দেখার কিছু থাকত, একটা কথা ছিল। দেখারও কিছু নাই। স্যার, আপনাদের সমুদ্র আছে?
হ্যাঁ আছে। তবে সে সমুদ্র তোমাদের সমুদ্রের মত না। আমরা সময়ের সমুদ্রে বাস করি। তোমাদের কাছে সময় হচ্ছে নদীর মত বয়ে যাওয়া। আমাদের সময় নদীর মত প্রবহমান নয়, সমুদ্রের মত স্থির।)
মনে কিছু নেবেন না স্যার, আপনার কথা বুঝতে পারি নাই।
সময় সম্পর্কিত এই ধারণা ত্রিমাত্রিক জগতের প্রাণীদের পক্ষে অনুধাবন করা খুবই কঠিন। অংক এবং পদার্থবিদ্যায় তোমার ভাল জ্ঞান থাকলে চেষ্টা করে দেখতাম।
এটা বলে স্যার আমাকে লজ্জা দিবেন না। আমি খুবই মুর্খ। অবশ্য স্যার মূর্খ হবার সুবিধাও আছে। মুর্খদের সবাই স্নেহ করে। বুদ্ধিমানদের কেউ স্নেহ করে না। ভয় পায়। মতিয়ুর রহমান স্যার যে আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করে তার কারণ একটাই–আমি মুর্খ। বিরাট মুর্খ।
ও আচ্ছা।
উনার স্ত্রীও আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। গত ঈদে আমাকে পায়জামা আর পাঞ্জাবি দিলেন। পাঞ্জাবি সিল্কের। এই রকম সিল্ক সচরাচর পাওয়া যায় না, অতি মিহি–এক্সপোর্ট কোয়ালিটি সিল্ক। যা তৈরি হয় সবই বিদেশে চলে যায়। ওনাদের কানেকশন ভাল বলে এইসব জিনিশ যোগাড় করতে পারে। যাই হোক, পাঞ্জাবি সাইজে ছোট হয়ে গিয়েছিল, সেটা আর উনাকে বলি নাই, মনে কষ্ট পাবেন। শখ করে একটা জিনিশ কিনেছেন।