হিরাক্লিন্টাসের সূক্ষ্ম সমাজ চেতনার দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি সূত্রের উল্লেখ করা যেতে পারে। বার্গেট ও টমসন উভয়েই এই সূত্রটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন -“অগ্নির বিনিময়ে সকল বস্তু, সকল বস্তুর বিনিময়ে অগ্নি; যেমন স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে পণ্যদ্রব্য, পণ্যদ্রব্যের বিনিময়ে স্বর্ণমুদ্রা।” সূত্রের উপমাটি খুবই তাৎপৰ্য্যপূর্ণ। পণ্যসঞ্চারী সমাজে সহস্র পণ্যের সঞ্চালনশক্তি মুদ্রাতে কেন্দ্রীভূত, কারণ মুদ্র পণ্যমূল্যের ঘনীভূত প্ৰকাশভূমি। এই সর্বশক্তিময়ী আধারশক্তি থেকে পণ্যসমূহ আপন গতি্, শক্তি আহরণ করে। বিনিময়প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুদ্রাদেবী যেন আপনাকে সহস্ররূপে বিকশিত করে। তেমনি বিশ্ববিবর্তনের মূল গতিশক্তি অগ্নিতে কেন্দ্রীভূত। বিবর্তন-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অগ্নি আপনাকে অজস্ররূপে অনাদিকাল ধরে প্রকাশ করে চলেছে।
হিরাক্লিটাসের মতে এক ও বহু উভয়েই সত্য। প্রতিক্ষণে পুরাতনের মৃত্যু ও নূতনের অভ্যুদয় ঘটছে—তাই বস্তু বহু ও অনন্ত। আবার নিরবচ্ছিন্ন প্ৰবাহবিধৃত সমষ্টি হিসাবে বস্তু একও বটে। “তাই আমরা একই নদীতে নামি আবার নামি না”—এখানে হিরাক্লিাটাস বৌদ্ধমতের একদেশী দৃষ্টিকে অতিক্রম করেছেন। বৌদ্ধমতে সন্তান বা প্রবাহ মূলত সত্য নয়। উহা সংবৃতি, বিকল্প বা বস্তুশূন্য বুদ্ধিনির্মিত ধারণামাত্র। প্রবাহপতিত এক একটি বস্তুক্ষণই শুধু সত্য। তেমনি অবয়ব বা অংশগুলিই একমাত্র সত্য, অবয়বী, অংশী বা সমুদয় (the whole) মিথ্যা। সুতরাং বৌদ্ধমতে organic ৭unity-ও বিকল্প মাত্র। হিরাক্লিটাসের মতে একটি বস্তু ঐ একই ক্ষণে এক ও বহু। কারণ, বিপরীতের দ্বৈত-দ্বন্দ্ব ছাড়া একের ঐক্য সম্ভব নয়। একের অভ্যন্তরেই উন্মেষমুখী নূতনের সাথে পুরাতনের বিরোধ আরম্ভ হয়। বৌদ্ধমতে একক্ষণের বস্তু সম্পূর্ণ এক ও অদ্বৈত। পূর্বক্ষণ কখনও পরীক্ষণের বস্তুকে গর্ভে ধারণ করে না। এই নিরন্বয় ক্ষণবাদ দ্বান্দ্রিক দর্শনের বিরোধী। হিরাক্লিটাস বলেন “Men do not know how what is at variance agrees with itself. It is an attunement of opposite tensions like that of the bow and the lyre” (fragment-45). “Couples are things whole and things not whole, what is drawn together and drawn asunder, the harmonious and the discordant. The one is made up of all things and all things issue from the one” (fragment-59)” যাহা মৃত্যুশীল তাহা অমর, যাহা অমর তাহা মৃত্যুশীল। একের মৃত্যুতে অন্য বাঁচে, একের বাঁচায় অন্য মরে” (fragment:-60)। বস্তুর অন্তরে বিপরীতের বিরোধ এবং বিরোধের মারফত প্ৰতিমুহূর্তে বস্তুর পরিবর্তন—এই বস্তুনীিতি সাংখ্যদর্শনে স্বীকৃত। পরিবর্তনের তিনটি ধারা-ধর্মপরিণাম অবস্থাপরিণাম ও লক্ষণপরিণাম সম্পর্কে যোগদর্শনের ব্যাসভান্যে প্ৰাঞ্জলভাবে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু তথাপি সাংখ্যযোগদর্শন পুরাতনের মৃত্যু ও নূতন বস্তুর জন্ম স্বীকার করতে পারল না। পরিবর্তন মানে পুরাতনের নিত্য নূতন প্রকাশভঙ্গী মাত্র। যাহা অব্যক্ত ছিল তাহারই অভিব্যক্তি মাত্র। এই দুর্বলতা, “formal law of thought”-এর নিকট দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গীর এই নতিস্বীকার সাংখ্যদর্শনকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ থেকে সরিয়ে রাখল। (চৈতন্য-স্বরূপ বহু আত্মার প্রসঙ্গ আর তুলছিনা।)
বৌদ্ধ ও সাংখ্যদর্শনের এই দ্বিবিধ দুর্বলতা হিরাক্লিন্টাসকে স্পর্শ করেনি। তিনি পিথাগোরাসের বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব স্বীকার করেছেন, কিন্তু দার্শনিক ও ধর্মীয় মতের কঠোর সমালোচনা করেছেন। বহু বিষয়ের জ্ঞান থাকা ভাল। কিন্তু বহুর জ্ঞান থাকলেই লোক বিজ্ঞ হয় না। বিশ্ববিবর্তনের মূল নিয়ামক সূত্র সম্পর্কে গভীর দৃষ্টি অর্জন করাই বিজ্ঞতা (fragments-16, 17, 18, 19)। এই নিয়ামকসূত্ৰকেই তিনি বলেছেন logos, যার ইংরেজী অনুবাদ করা হয়ে থাকে word, (fragments-1, 2)। সে যুগে বহুল প্রচারিত ডায়োনেশীয় ধর্মমতের রহস্যময় ক্রিয়াকলাপকে তিনি তীব্ৰতম ভাষায় আক্রমণ করেছেন (framents 126-180)। আয়োনিয়ার দার্শনিকগণ প্রথম থেকেই মূল গ্রীসের তুলনায় ধর্মীয় সংস্কার থেকে অনেক বেশী মুক্ত ছিলেন।
আধুনিক বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের সকল কয়টি সূত্র প্রাচীন হিরাক্লিটাসের কাছ থেকে আশা করা যায় না। তিনি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রাথমিক রূপকার, প্ৰাচীন মনীষীদের মধ্যে অব্যৰ্থ বস্তুসত্যের সার্থকতম নমস্যতম আবিষ্কারক। আধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের প্রথম প্ৰবক্তা ছিলেন নিগৃহীত নিপীড়িত মানবের মুক্তি সংগ্রামের মহান নেতা, আর প্রাচীন যুগের দ্বান্দ্ৰিক বস্তুবাদের প্রথম সূত্রকার ছিলেন লাঞ্ছিত জনতার শত্রুশিবিরের সদস্য ও সমর্থক-এও বোধ হয় ইতিহাসে দ্বান্দ্ৰিক প্রক্রিয়ার এক চমৎকার অভিব্যক্তি।
বিবেকানন্দ বেদান্ত ও ভারতীয় সমাজ
“আমি সমাজতন্ত্রী, তার কারণ এই নয় যে সমাজতন্ত্রকে আমি একটা পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ সমাজব্যবস্থা বলে মনে করি, কারণটা এই যে উপবাস করার চেয়ে আধখানা রুটি মেলাও ভাল।
“অন্য সব সমাজব্যবস্থাই পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেগুলি ত্রুটিপূর্ণ। এই অবস্থাটাকেও একবার পরীক্ষা করে দেখা যাক; আর কিছুর জন্য না হলেও অন্তত এর নূতনত্বের জন্যই একবার পরীক্ষা করা দরকার। একই মানুষের দল সব সময় সুখ বা দুঃখ ভোগ করে যাবে; তার চেয়ে বরং সুখদুঃখের একটা পুনর্বণ্টন হওয়াই ভাল! ভাল-মন্দের মোট পরিমাণ পৃথিবীতে সব সময় একই থাকে। নূতন নূতন ব্যবস্থার দ্বারা জোয়ালটা কাঁধ বদল করে মাত্র, আর কিছু নয়।