ব্রোঞ্জযুগ ও মিশেনীয় সভ্যতার অবসানে নূতন গ্ৰীক সভ্যতা লৌহ হাতিয়ারের আশীৰ্বাদ নিয়ে জন্মলাভ করল। শ্রেণীভেদ ও শ্রমবিভাগ তীব্রতর হল। উদ্বত্ত উৎপাদনের পরিমাণ বহুপরিমাণে বেড়ে গেল, পণ্যের বাজার বিস্তৃতি লাভ করল, মুদ্রার প্রচলন ব্যাপকতর হল, অভিজাত ভূস্বামী, দাস ও স্বাধীন কারিগরের সঙ্গে বণিকশ্রেণীর আবির্ভাব ঘটল। এই নূতন পণ্যসভ্যতার কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠল গ্রীক উপনিবেশ আয়োনিয়া। খাস গ্রীসের তুলনায় আয়োনিরায় এই সভ্যতা বিস্তারের সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশী। বেবিলন, লিডিয়া, পাশিয়া, ফিনিসিয়া ও মিশরের সহিত আয়োনিয়ার প্ৰত্যক্ষ ও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এই অর্থনৈতিক যোগাযোগ সাংস্কৃতিক যোগাযোগের পথ উন্মুক্ত করে দিল। মিশর ও বেবিলনের বৈজ্ঞানিক প্রতিভার সঙ্গে আয়োনিয়ার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটল। ক্রমবিস্তারশীল পণ্য-সভ্যতার অন্তরালে আয়োনিয়ান সমাজের অন্তদ্বন্দ্বও প্রকট হয়ে উঠল। এ সভ্যতা ছিল মূলত দাস শ্রমের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং এ সভ্যতার সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতার কথা একই সঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন। একদিকে অভিজাত ভূস্বামীদের সঙ্গে ধনষ্ফীত বণিকশ্রেণীর সংঘাত, অন্যদিকে শ্রমজীবী নিপীড়িত শ্রেণীর অসন্তোষ বিক্ষোভ ও বিদ্ৰোহ আয়োনিয়ান নগরীগুলিতে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। এইভাবে মিশর বেবিলনের প্রাচীন বস্তুবিজ্ঞানের সহিত এক অন্তদ্বদ্বাকীর্ণ সমৃদ্ধিশালী নূতন পণ্য-সভ্যতার মিলনভূমি হিসেবে গড়ে উঠল গ্ৰীক অয়োনিয়ার সমাজমানস। প্ৰথম শ্রেণীবিভক্ত সমাজে বহুমুখী ভাঙাগড়ার পটভূমিতেই আয়োনিয়ান গ্ৰীকমানসে বস্তুতান্ত্রিক তত্ত্বজিজ্ঞাসার প্রথম উন্মেষ সম্ভব হয়েছিল।
এক সমন্বিত আদিম গোষ্ঠীসমাজ থেকে বহুধাবিদীর্ণ দাসশ্রমভিত্তিক সমাজে উত্তরণের এই দীর্ঘ দ্বান্দ্ৰিক প্রক্রিয়া সমাজমানসের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে। সমাজবাস্তবের এই বিবতন প্রক্রিয়া হিরাক্লিাটাসের দ্বান্দ্রিক দর্শনের বিশ্ববীক্ষায় পরোক্ষভাবে প্ৰতিফলিত হয়েছে, বলা বাহুল্য এক মূৰ্ত্ত ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার এই বিমূৰ্ত্ত সাধারণীকরণ ঘটেছিল অলক্ষ্যে, দার্শনিক-মনের অবচেতন অন্তরালে। তথাপি একহিসেবে হিরাক্লিাটাস ছিলেন আদিপর্বের দার্শনিকদের মধ্য সবচেয়ে সমাজ-সচেতন। আয়োনীয় দার্শনিক সম্প্রদায় কিন্তু রাজনীতি-ক্ষেত্রেও সক্রিয় অংশ গ্ৰহণ করেছিলেন। হিরোডোটাসের মতে থেলিস সমগ্র আয়োনিয়াকে নিয়ে, টিয়াস নগরীকে রাজধানী ক’রে, একটি যৌথরাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন। থেলিসের মৃত্যুর পর আয়োনিয়ার রাজনৈতিক জীবনে অন্তদ্বন্দ্ব, বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ আরও তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। দাস ও প্রভুর মৌলিক সংঘাতের পরিধির অভ্যন্তরে অভিজাত ভুস্বামীশ্রেণী ও পণ্যবাহী বণিকতন্ত্রের সংঘৰ্য প্ৰচণ্ড আকার ধারণ করল। হিরাক্লিাটাস এ সংঘাতের নিরপেক্ষ দর্শকমাত্র ছিলেন না। তিনি অভিজাত প্ৰতিক্রিয়ার পক্ষে এবং গণতন্ত্র ও জনসাধারণের বিপক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। গণতন্ত্র, বণিকতন্ত্র ও জনসাধারণের প্রতি তার অবজ্ঞা ও শ্রেণী-বিদ্বেষ ছিল অপরিসীম। নিজ শ্রেণী স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি এই সংঘাতের তাৎপৰ্য্য বুঝতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন তাঁর অভিজাত শ্রেণীকে বাঁচতে হলে তীব্ৰ সংঘর্ষের ভিতর দিয়েই বাঁচতে হবে। এফিসিয়া থেকে তাঁর ভ্রাতার নির্বাসনের পর গণতন্ত্র ও জনসাধারণের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা আরও প্রবল হয়ে উঠল। শুধু আয়োনীয় সমাজের অন্তদ্বন্দ্বই নয়, তিনি তার জীবনে পারস্যের আধিপত্যের বিরুদ্ধে আইয়োনিয়ান গ্রীকদের সফল বিদ্রোহও প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সুতরাং বস্তুজগতের অন্তর্দ্বন্দ্ব তাঁর কাছে একটি দার্শনিক তত্ত্বমাত্র ছিলনা। এই তত্ত্বকে তিনি তাঁর শ্রেণীস্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজজীবনে প্ৰতিফলিত হতে দেখেছিলেন। বস্তু প্ৰকৃতির গতিধর্ম ও অন্তদ্বন্দ্ব তার পূর্ববর্তী মিলেশীয় দার্শনিকদের ধারণাতেও ধরা পড়েছিল। মিলেশীয় এনাক্সিমেণ্ডারও বিপরীতের দ্বন্দ্বের কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি এই দ্বন্দ্বকে নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছিলেন। তিনি এই দ্বন্দ্বকে অন্যায় মনে করতেন এবং সমন্বয়ের ভিতরে দ্বন্দ্বের অবসানের পথ খুঁজেছিলেন। কিন্তু হিরাক্লিাটাস অন্তর্দ্বন্দ্বকে অনতিক্রমণীয় বস্তুস্বভাব হিসাবে দেখেছিলেন। তাঁর মতে ঐক্য সাময়িক ও আপেক্ষিক, কিন্তু সংঘর্ষ সর্বাত্মক। তাই সংঘৰ্ষই ন্যায়ধর্ম। সমাজের মূল সংঘর্ষ যে প্ৰভু ও দাসের ভিতরে এ উপলব্ধি তার ছিল। “যুদ্ধ সকলের পিতা, সকলের প্রভু। যুদ্ধই দেবতা ও মানুষ সৃষ্টি করেছে। স্বাধীন মানুষ ও দাসদের সৃষ্টি করেছে”-এ,উক্তি হিরাক্লিটাসের। বস্তুজগতে বিপরীতের বিরোধকে তিনি যুদ্ধের নৈতিক ন্যায্যতায় প্রতিষ্ঠিত করলেন। হোমার যুদ্ধের অবসান কামনা করেছিলেন বলে হিরাক্লিন্টাস তাকে ক্ষমা করতে পারেন নি। “হােমার বুঝতে পারেন নি যে তিনি জগতের ধ্বংসের কামনা করছেন, তার প্রার্থনা চরিতার্থ হলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।” “হোমারকে চাবুক মারা উচিত।” বিশ্বমনীষার ইতিহাসে হিরাক্লিাটাস যে অমোঘ দার্শনিক সত্য আবিষ্কারের প্রথম গৌরব অর্জন করেছিলেন, তার নিজ শ্রেণীস্বার্থের কলুষিত দৃষ্টিভঙ্গী সেই সত্যকে অপব্যাখ্যার স্তরে টেনে নামিয়েছিল। বিপরীতের অন্তদ্বন্দ্বই যে একদিন শ্রেণীহীন যুদ্ধহীন উচ্চতম মানবিক সভ্যতা গড়ে তোলার পথে অগ্রসর হবে এ বিশ্বাস ও দূরদৃষ্টি সে যুগের হিরাক্লিটাসের কাছ থেকে আশা করা অন্যায় অতিরিক্ত ও অসঙ্গত।