হিরাক্লিাটাস ছিলেন এশিয়া মাইনরের গ্রীক উপনিবেশ এফিসাসের অধিবাসী। গ্ৰীকদর্শনের আদিপর্বের বস্তুবাদী দার্শনিকগণ কেহই মূল গ্রীসের অধিবাসী ছিলেন না। থেলিস, এনাক্সিমেন্তার, এনাক্সিমেনিস, ও হিরাক্লিটাস এরা সকলেই ছিলেন আয়োনিয়ার অধিবাসী। এশিয়া মাইনরের উপকূলভাগ ও তার সমীপবর্তী দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে যে গ্ৰীক উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল তখন তার নাম ছিল আয়োনিয়া। পিথাগোরাস, পারমেনিডিস, এমপিডোক্লিস, লিউকিপ্লাস, ডিমোক্রিটাস, প্রথম যুগের এইসব বিশিষ্ট দার্শনিকরাও কেহই খাস গ্রীসের অধিবাসী ছিলেন না। এনাক্সাগোরাসের জন্ম ও শিক্ষা-দীক্ষা আয়োনিয়ায়, যদিও পরে তিনি পেরি ক্লিসের আমন্ত্রণে এথেন্সে বসবাস করেছিলেন। পিথাগোরাস সামোস থেকে দক্ষিণ ইতালীর ক্রোটনে চলে যান। লিউকিপ্লাস আয়োনিয়ার নগরী মিলেটাসের অধিবাসী, যেখানে থেলিস গ্রীক দর্শনের গোড়াপত্তন করেন। গ্রীক দর্শনের শৈশব কৈশোর ও যৌবনের এই স্থানগত বৈশিষ্ট্য নিশ্চয়ই অনুধাবনযোগ্য। বিশেষ করে গ্রীকদর্শনের প্রথম চারণভূমি এথেনীয় গ্রীস না হয়ে আয়োনিয়া হ’ল কেন এ প্রশ্ন মনে জাগা স্বাভাবিক।
মার্ক্সীয় দর্শন যে আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের সূচনা করেছে, সেই মতে কোন সমাজের সাংস্কৃতিক ধ্যান ধারণা, তার শিল্প সাহিত্য দর্শন সেই সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্কের পরোক্ষ প্ৰতিচ্ছবি। এই মত বর্তমানকালে ব্যাপকতম স্বীকৃতি লাভ করেছে। অবশ্য দর্শনের গবেষণায়, বিশেষত প্ৰাচীন দর্শনের ইতিহাস বীক্ষণে এই দৃষ্টিভঙ্গী প্রয়োগ করতে গিয়ে কোন হঠকারী যান্ত্রিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার বিরুদ্ধে যথেষ্ট হুশিয়ারী থাকা প্ৰয়োজন। অনেক সময়ে বলা হয়ে থাকে যে, সমাজে শ্রেণীবিভাগের আবির্ভাবের পূর্বে ভাববাদী বা অধ্যাত্মবাদী দর্শনের আবির্ভাব সম্ভব নয়। বস্তুজগৎ সত্য না বস্তুনিরপেক্ষ বিশুদ্ধ জ্ঞানসত্তাই সত্য, বস্তু ও জ্ঞানের দ্বন্দ্ব-বন্ধুর এই তর্কময় তত্ত্বজিজ্ঞাসার প্রথম আবির্ভাব তখনই সম্ভব যখন সমাজে বিপরীতমুখী স্বাৰ্থদ্বন্দ্বের প্রতিনিধিস্থানীয় দুইটি শ্ৰেণী আবিভূতি হয়েছে; যখন একদিকে এজাতীয় তত্ত্বনির্ণয়ে কালক্ষয় করার মত অবসর ভোগী পরশ্রমোপজীবী এক শাসক ও শোষক শ্রেণী, অপরদিকে এই পরভুক শ্রেণীর বিলাসব্যসন ও বাঁচার উপকরণ উৎপাদনে ব্যস্ত শ্ৰমমাত্র সম্বল এক শাসিত ও শোষিত শ্রেণী আবিভূতি হয়েছে। সমাজের ইতিহাসে একথা সত্য বলেই প্রমাণিত। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আরও একটু বলা প্রয়োজন যে শুধু ভাববাদী দর্শন কেন, দার্শনিক চিন্তার প্ৰথম উন্মেষ যে বস্তুবাদী দর্শন তারও উৎপত্তি শ্রেণীবিভক্ত সমাজ ছাড়া সম্ভব নয়। তত্ত্বজিজ্ঞাসা ও বিশ্ববীক্ষণ ব্যতীত কোন চিন্তাকে দার্শনিক চিন্তা বলা যায় না। এ জাতীয় চিন্তায়, তা যতই প্ৰাথমিক স্তরের হ’ক না কেন, কিছু-পরিমাণে যুক্তি ও সূক্ষ্মমননের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। সূক্ষ্ম মননের উপযোগী ব্যাকরণের নিয়মনিয়ন্ত্রিত ভাষাবিন্যাস-কৌশলও আয়ত্তে থাকা আবশ্যক। ইন্দ্ৰিয়লব্ধ অভিজ্ঞতার সাধারণীকরণের (universalization) দ্বারা বিমূর্ত ভাবধারণার (abstract concepts) সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন। হিরাক্লিটাসের সংক্ষিপ্ত ও খণ্ডিত গ্রন্থের পংক্তি কয়টির দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায়, এজাতীয় জটিল ভাবনার অভ্যুদয় প্ৰাচীনতম শ্রেণীহীন সমাজে কল্পনা করা যায় না। কঠোর কায়ক্লেশে কোনও রকমে জান্তব জীবন বাঁচিয়ে রাখার দায় থেকে মুক্ত এক পরাভুক অবসর ভোগী শ্রেণীর উদ্ভব না হলে প্রথম যুগের বস্তুবাদী মনন ও ভাবনাও সম্ভব হতনা। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে। কিন্তু শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থার ভিতরেই সূক্ষ্ম মননের উপযোগী অবসর মেলার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী।
আদি দর্শনের উৎপত্তির প্রশ্নটি অন্য এক দিক থেকেও বিচার করা যেতে পারে। প্রথম যুগের তত্ত্বজিজ্ঞাসার স্বরূপ কি? মূলতত্ত্ব বস্তু না জ্ঞান-এ DBBB DBDD DY S S BDBDBBD BDBB DBD D DBDBS BDD ছিল প্ৰাথমিক জিজ্ঞাসার রূপ। একথা যেমন গ্ৰীক দৰ্শন সম্পর্কে তেমনই ভারতীয় দর্শন সম্পর্কেও সত্য। এক বিজ্ঞানস্বরূপ অদ্বৈততত্ত্বের তুলনায় এক মূল-বস্তুতত্ত্ব থেকে বহুর উৎপত্তির ধারণা প্রাচীনতর। সে তত্ত্ব বস্তু না বিজ্ঞান এ পরিবর্তীকালের প্রশ্ন। লক্ষ্য করার বিষয় যে অদ্বৈতবাদী পারমেনিডিসও তার অদ্বৈততত্ত্বকে কোথাও বিজ্ঞানস্বরূপ বলেননি। অবিশ্য গতি, পরিবর্তন ও বহুত্বকে অস্বীকার করার যুক্তিসঙ্গত পরিণতি হিসাবে বস্তুজগতও বিলুপ্ত হয়, তখন অদ্বৈততত্ত্বে বিজ্ঞান ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা। পারমেনিডিস নিজে তাঁর মতবাদের এই যৌক্তিক পরিণতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন কিনা জানা যায়না। আদিম শ্রেণীহীন গোষ্ঠীসমাজে যেমন বস্তু ও জ্ঞানকে বিভক্ত করা সম্ভব ছিল না তেমনি এক ও বহুকেও পৃথকভাবে বিচার করা সম্ভব ছিল না। শ্রম বিভাগ, উদ্বত্ত উৎপাদন, পণ্যের উৎপত্তি, মুদ্রাপ্ৰচলন ও লৌহনির্মিত যন্ত্রপাতির আবির্ভাবে যখন আদিম গোষ্ঠীসমাজে ভাঙ্গন ধরলা, একের ভিতরে যখন শ্রেণী:স্বার্থের সংঘাত উপস্থিত হল, এক যখন দ্বিধা ত্ৰিাধা বহুধা বিভক্ত হল, তার পূর্বে সমাজমানসে এক ও বহুর দার্শনিক তত্ত্বজিজ্ঞাসা জাগ্রত হয়নি। একের অন্তরে বহুর আবির্ভাবের এই সামাজিক প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা বহুদিন ধরে সমাজমানসে সঞ্চিত হয়েছে আর তারই তাত্ত্বিক রূপ এক ও বহুর সম্বন্ধজিজ্ঞাসায় বস্তুবাদী বিশ্ববীক্ষণে প্ৰতিফলিত হয়েছে।