তথাপি হিরাক্লিাটাস ছিলেন এযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক, র্যার সূক্ষ্ম বস্তুদৃষ্টি এই সহজ স্কুলতাকে বহুদূর অতিক্রম করেছিল, যার কাছে বিশ্ববিবর্তনের মৌলিক সূত্র সর্বপ্রথম ধরা পড়েছিল। হিরাক্লিন্টাস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জগতের অব্যৰ্থ নিয়ামক সূত্র ঘোষণা করলেন-বিপরীতের অন্তবিরোধের উপরেই ঐক্যের প্রতিষ্ঠা। এই ক্ৰমান্বয়ী ক্রমবিকাশশীল অন্তবিরোধ নিরবচ্ছিন্ন জাগতিক গতির নীতিসূত্র। এই গতিসূত্রের ভিত্তিতেই নব নব উন্মেষশালিনী বস্তুপ্রকৃতি নিত্য নূতন সৃষ্টির পথে অগ্রসর হয়। জগতের প্রত্যেকটি বস্তু এক অস্থির প্রবাহে প্ৰবাহিত। একই নদীতে দুবার নাম যায় না, একই সূৰ্য্য দুদিন ওঠে না। হিরাক্লিন্টাস বর্তমানযুগের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের অসম্পূর্ণ আদিসূরি। তার দ্বান্দ্বিক গতিসূত্ৰকে, কোন কোন অংশে, সাংখ্যদর্শনের সহিত তুলনা করার কথা মনে হতে পারে। কেবল মাত্র গতির দিক থেকে বিচার করলে বৌদ্ধ দর্শনের ক্ষণিক্যবাদ, কেবল মাত্র দ্বন্দ্রের দিক থেকে বিচার করলে সাংখ্যদর্শনের প্রকৃতি-পরিণামবাদ আংশিকভাবে হিরাক্লিটীয় দর্শনের সাদৃশ্যবাহী বলে ধারণা হতে পারে। কিন্তু সাংখ্য ও বৌদ্ধ যোগ করলেই হিরাক্লিাটাস হয় না, দ্বন্দ্ব আর গতি যোগ করলেই দ্বান্দ্বিক গতি হয় না। বস্তুর স্বাভাবিক অন্তবিরোধ বস্তুনিরপেক্ষ বিশুদ্ধতর্কের (formal logic) পরিধির মধ্যে বাধা পড়েনা বলে বৌদ্ধ সাংখ্য ও অদ্বৈতবেদান্ত পরিবর্তনের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনটি বিভিন্ন বিভ্রান্ত সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছে। বৌদ্ধ দর্শন পূর্বাপর ক্ষণসমূহের মধ্যে কোন অন্বয় বা বাস্তব যোগসূত্র আবিষ্কার করতে পারল না। আর ক্ষণিকবাদের অর্থ দাঁড়াল–প্রকৃতি discrete e discontinuous, সূক্ষ্যতম অসংখ্য বস্তুক্ষণের নিরন্বয় সমষ্টিমাত্র। প্রবাহবিধৃত এ সমষ্টিও বাস্তব নয়, “বিকল্পের” বিলাস মাত্র। তাই শেষ পৰ্য্যন্ত কাৰ্য্যকারণ সম্পর্কের কোন বাস্তব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া তাদের পক্ষে অসাধ্য হয়ে উঠল। বিজ্ঞানবাদ ও শূন্যবাদের মননশাস্ত্ৰে কাৰ্য্যকারণ-সম্বন্ধ একটা “বিকল্প” বা বুদ্ধি-নির্মিত ধারণামাত্ৰে পৰ্য্যবসিত হল। অদ্বৈত বেদান্ত পারমেনিডিসের মত গতি ও পরিবর্তনকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে ব্যাখ্যার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেল। সাংখ্য বস্তুনিহিত দ্বন্দ্ব ও গতিকে স্বীকার করে অনেক দূর অগ্রসর হয়েও শেষরক্ষা করতে পারল না, পরিবর্তন স্বীকার করেও নূতন বস্তুর উৎপত্তি স্বীকার করতে পারল না। কিন্তু হিরাক্লিাটাসের সার্থক বস্তুদৃষ্টি বস্তুনিরপেক্ষ “বৌদ্ধ-ন্যায়ের” (formal laws of thought) কাছে নতি স্বীকার করল না। তিনি নিরন্তর দ্বান্দ্ৰিক শক্তির মাধ্যমে নূতনের উদ্ভব-সূত্র উদ্ভাবন করলেন। কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মূলতঃ বস্তু বুদ্ধিকে অনুসরণ করে না। কিন্তু বুদ্ধিই বস্তুকে অনুসরণ করে। ঠিক একথাটি তিনি তার সংক্ষিপ্ত পংক্তিগুলির মধ্যে ঘোষণা করেন নি। কারণ, জেনোর Paradox-এর দুষ্ট সরস্বতী তখনও জাগ্ৰত হয়নি। প্লেটোর বিচার-দ্বন্দ্বের কুট পদ্ধতি তখনও আবিস্কৃত হয় নি, এবং এরিষ্টোটলের ন্যায়শাস্ত্র তখনও জন্মলাভ করেনি, তাহলে হিরাক্লিাটাস স্পষ্ট ভাষায় বলে যেতে পারতেন–Contradiction যখন বস্তুর স্বভাবসিদ্ধ ন্যায়ধর্ম (The Natural Law of Things) তখন এরিষ্টোটলের Law of Contradiction সামগ্রিক দৃষ্টিতে অচল ও অক্ষম।
এরিষ্টোটল তার মেটাফিজিক্সের প্রথম খণ্ডে প্লেটো-পূর্ব দার্শনিকদের আলোচনা প্রসঙ্গে মন্তব্য করলেন-থেলিস থেকে আরম্ভ করে আদিপর্বের দার্শনিকদের মধ্যে একটা বিষয়ে ঐক্য সুস্পষ্ট। এরা সবাই মনে করেন যে বস্তু থেকে বস্তুর উৎপত্তি। বস্তুতেই বস্তুর লয়। বস্তুই বস্তুর আদি কারণ, বস্তুজগতের উৎপত্তি ও গতির জন্য এই জগতের বহির্ভূত কোন দ্বিতীয় বা নিমিত্ত কারণের প্রয়োজন নেই। অবশ্যই এরিষ্টোটল এই মতের বিরোধিতা করলেন। তিনি বললেন যে, আদি দার্শনিকদের এই মত থেকে কেউ মনে করতে পারেন যে বস্তুজগতের উৎপত্তি ও গতির জন্য উপাদান-কারণই যথেষ্ট, কোন সর্বশেষ সাধারণ নিমিত্ত কারণের প্রয়োজন নেই। কিন্তু মানুষের অগ্রগতির সঙ্গে একটা চেতন নিমিত্ত কারণের প্রয়োজন অনুভূত হল। কাঠ নিজের থেকেই পালঙ্ক তৈয়ার করেন, ব্রোঞ্জ নিজের থেকেই মুতি গড়ে না। অর্থাৎ উপাদানের অতিরিক্ত একজন চেতন কারিগরের প্রয়োজন। সুতরাং বস্তুজগতের নিমিত্তকারণ হিসেবে মূল বস্তুতে অন্ততঃ প্ৰাথমিক গতি-সঞ্চার করার জন্য এক শাশ্বত সত্তার উপস্থিতি আবশ্যক, যে নিজে গতিহীন, কিন্তু গতিসঞ্চারী। চেতন নিমিত্তকারণের স্বপক্ষে এরিষ্টেটলের এই যুক্তির সাংখ্যদর্শনের বিরুদ্ধে শংকর-প্ৰযুক্ত যুক্তির সাদৃশ্য উল্লেখযোগ্য, শয্যানির্মাণের উদাহরণটিতেও বিস্ময়কর মিল রয়েছে।
এরিষ্টোটল কর্তৃক সমালোচিত এই আদি বস্তুতন্ত্রের শিরোমণি সূত্রকার হিরাক্লিাটাস ঘোষণা করেন -“সর্বসাধারণের এই বস্তুজগৎ কোন দেবতা বা মানুষ সৃষ্টি করেন নি। বস্তুজগৎ এক চিরঞ্জাব অগ্নিস্বরূপ-চিরকাল ছিল, বর্তমানে আছে এবং চিরকাল থাকবে। এ আগুন প্ৰতিমুহূর্তে সমভাবে জলে আর নিভে” (অর্থাৎ প্ৰজ্বলন আর নির্বাপণ একই প্রক্রিয়ার দুইটি সমান্তরাল প্ৰকাশভঙ্গী)। হিরাক্লিটাসের বাচনীতি অনেকটা সংক্ষিপ্ত সূত্রাকার দৈববানীর মত, আপাতদৃষ্টিতে রহস্যময়। তখনকার ধর্মবিশ্বাসে দৈববাণীর প্রতিষ্ঠা বোধহয় হিরাক্লিটাসের বাক্য-বিন্যাসরীতির উপর অলক্ষ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তথাপি বিশ্বের সারবস্তুকে এক অনিৰ্বাণ অগ্নিরূপে কল্পনা করার ভিতরে কোন অতিপ্রাকৃত অতীন্দ্ৰিয় রহস্য লুকিয়ে নেই। এই কল্পনার দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে। প্রতিমুহুর্তে পুরাতনের মৃত্যু ও নূতনের অত্যুদয়, অথচ প্রবাহরূপে এক অনির্বাণ অবিচ্ছিন্ন ঐকিক সত্তা,- এই বস্তুবাদী অদ্বৈত ধারণাকে প্ৰকাশ করার পক্ষে অগ্নিশিখা অপেক্ষা সার্থকতর উদাহরণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ভারতীয় বৌদ্ধ দর্শনের ক্ষণিকবাদের ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানপ্ৰবাহ ও বস্তুপ্রবাহের ধারণা স্পষ্ট করার জন্য অগ্নিশিখার দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হতে পারে, হিরাক্লিাটাস নদীর স্রোতের দৃষ্টান্তও টেনেছেন। তাহলে থেলিসের মত আদি বস্তুকে জল বলে কল্পনা করতে বাধা কোথায়। এখানেই অগ্নিকল্পনার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিশ্বপ্ৰকৃতিতে যে বস্তু মানুষের ধ্যানধারণার উপর সব চেয়ে বেশী প্রভাব বিস্তার করে তা হল সূৰ্য। সূৰ্য্যের সঙ্গে পৃথিবীর সম্বন্ধ সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ। সূৰ্য্য একটি প্ৰজ্বলিত অগ্নিপিণ্ডরূপেই প্ৰতিভাত-“উজ্জ্বলতম, বিশুদ্ধতম, উত্তপ্ততম অগ্নির আধার। এই সূৰ্য্য।” আকাশের অগণিত নক্ষত্ৰকেও এক একটি অগ্নিময় বস্তুলোক বলে ধারণা করাই স্বাভাবিক। হিরাক্লিাটাসের দর্শন ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে পরবত্তী যুগে থিওফ্রেস্টাস বলেছেন—হিরাক্লিটাসের মতে সূৰ্য্য যেন একটা প্ৰজ্বলিত অগ্নিপাত্র; তার অনাবৃত মুখের দিকটা পৃথিবীর দিকে ফেরানো; সাগরের উত্তপ্ত নিশ্বাস শুষে নিয়ে সেই মুখ দাউ দাউ করে জলছে। বিশ্বময় পরিব্যাপ্ত এই মহাগ্নিকে সর্ববস্তু সর্বতেজ ও সর্বশক্তির আধার বলে কল্পনা করা হিরাক্লিটাসের পক্ষে সঙ্গত ও স্বাভাবিক। বস্তুজগৎ এই অনাদি অগ্নির প্ৰজ্বলিত প্রবাহ। জরাথুষ্টীয় ধর্মমতে অগ্নির ঐশ্বৰ্য্য প্ৰতিফলিত। ঋগ্বেদের প্রারম্ভ। অগ্নিতেজে দীপ্তিমান। ঈশোপনিষদের ঋষি প্রার্থনা করেছেন -“হে সূৰ্য্য, তোমার সত্যের মুখ স্বর্ণপাত্রে ঢাকা। এই মুখ তুমি খুলে দাও, আমাদের সত্যদৃষ্টি অবারিত হোক।” স্পষ্টতই প্ৰভাতের সূৰ্য্যকে সমগ্রতেজে আবিভূতি হবার জন্য এ উদাত্ত আবেদন। প্ৰসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য ঈশোপনিষদের শাংকরী ব্যাখ্যায় অনেক কষ্ট-কাল্পনিক অপব্যাখ্যার সুস্পষ্ট ছাপা পড়েছে। এই সূৰ্য্যপ্রার্থনার ঠিক পূর্বের শ্লোকটির দিকে একবার দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন।-“সৃষ্টি ও ধ্বংসকে যে একই সঙ্গে জানে সে ধ্বংসের দ্বারা মৃত্যুকে অতিক্ৰম করিয়া সৃষ্টির দ্বারা অমৃত ভোগ করে।” ঠিক এর পরেই সুৰ্য্যের স্বর্ণ/বরণ অবারিত করার প্রার্থনা। ঈশোপনিষদের বহু শ্লোকে বস্তুজগতের প্রক্রিয়া সম্পর্কে দ্বান্দ্ৰিক চিন্তার ইঙ্গিত রয়েছে।