আমাদের প্রাচীন রাসবাদী অলঙ্কারিকরা রসের বিচারে এবং রসের লক্ষণ নির্ণয়ে শেষ পৰ্য্যন্ত নির্ভর করেছেন রসিক পাঠকের উপর। কবির অনুভূতিকে রস না বলে, সহৃদয় সামাজিক পাঠকের হৃদয়ে অভিব্যক্তি সাহিত্যিক আনন্দানুভূতিকে রস বলেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গীর বিশেষ গুরুত্ব আছে। কারণ এই রসদর্শন মানুষের ভাষার চিরন্তন উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই দৃষ্টিভঙ্গীকে অতিক্রম করে কোনও সাহিত্যিক বেশী দূর অগ্রসর হতে পারেন না। রবীন্দ্রনাথ যখন বললেন-কবিকৰ্ম মানে পাখীরা আপন মনে গান গাওয়া নয়, বঙ্কিমচন্দ্ৰ যখন বললেন মানুষে না বুঝলে লিখে লাভ কি, তখন তার হাটুরে সাহিত্যের কথা বলেন নি, রসা-শাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকেই কথা বলেছেন। ঋষি টলষ্টয় শিল্প-রসের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তার সঙ্গে ভারতীয় রস-শাস্ত্রের বিস্ময়কর মিল রয়েছে“দর্শক বা শ্রোতা যদি শিল্পীর অনুভূতি দ্বারা অনুবিদ্ধ হয়, তবেই তা শিল্প।” টলষ্টয়-প্ৰণীত শিল্প-রসের লক্ষণ বহুজনবিদিত হলেও এখানে তার পূর্ণ উদ্ধৃতি অপ্রাসঙ্গিক হবে না :
‘To evoke in oneself a feeling one has once experienced and having evoked it in oneself then by means of movements, lines, colours, sounds, or forms expressed in words, so to transmit that feeling that others experience the same feeling-this is the activity of art.
“Art is a human activity consisting in this, that one man consciously by means of certain external signs hands on to others feelings he has lived through, and that others are infected by these feelings and also experience them.’
এর পর টলষ্টয় টীকা করে বললেন-সবচেয়ে বড় কথা। -‘শিল্প কেবলমাত্র ব্যক্তিগত আনন্দের খেলা নয়, সমান অনুভূতির ভিত্তিতে মানুষের সঙ্গে মানুষকে মিলিয়ে দেবার উপায় হল শিল্পী। জীবনের জন্য এ অপরিহাৰ্য্য, ব্যক্তিমানুষ ও সমগ্ৰ মানবসমাজের কল্যাণকর অগ্রগতির পথে এ এক অপরিহাৰ্য্য পাথেয়।’
টলষ্টয়ের মূল শিল্পীরস-সংজ্ঞার সঙ্গে অভিনব গুপ্তের সিদ্ধান্ত-লক্ষণের আশ্চৰ্য্য সংগতি বিদগ্ধজনের দৃষ্টি এড়াতে পারে না। টলষ্টয়ের লক্ষণের যে অপূর্ণতা রয়েছে তা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। সন্তানহারা মায়ের বুকফাটা কান্না শ্রোতার হৃদয়ে সহানুভূতির মাধ্যমে যে সমান অনুভূতির সৃষ্টি করে। তাও কি শিল্পরসে অন্তর্ভুক্ত হবে? তা হলে মায়ের ঐ কান্না যখন সাহিত্যের ভাষায় রূপান্তরিত হয় তখন পাঠক হিসাবে আপন অশ্রুধারার মধ্যেও একটা আনন্দঘন পরিতৃপ্তি আমরা অনুভব করি কেন? এ একটা মৌলিক প্রশ্ন। তাই আমাদের দেশের আলঙ্কারিকরা সাহিত্যের মূল ভিত্তির কথা যখন আলোচনা করেছেন তখন সমান অনুভূতির ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে মিলনের কথা বলেছেন, কিন্তু যখন সাহিত্যের অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন তখন “বিগলিত-বেদ্যান্তর” আনন্দময় অনুভূতির কথা বলেছেন। সাহিত্যশিল্প যে কেবল অনুকৃতি নয় এ বিষয়ে অভিনব গুপ্ত প্ৰখর ভাবে সচেতন ছিলেন, মন্তব্য করেছেন যে অনুকৃতি মাত্র হলে সাহিত্য কেবল হাস্যরসের সৃষ্টি করতে পারত।
কিন্তু সাহিত্যের মূল ভিত্তিই যদি নড়ে যায়। তবে আনন্দঘন অনুভূতি একটা নিরালম্ব খেয়ালী খেলায় পর্যবসিত হতে বাধ্য।
এ সম্পর্কে রবীন্দ্ৰনাথ কতখানি সচেতন ছিলেন তার নজিরের জন্য বেশী দূর যেতে হয় না। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতার অনুভূতি কত নির্বিড় হতে পারে প্রথম উদ্ধৃতিই তার প্রমাণ। কিন্তু মানুষ হিসাবে এই ঐকাত্ম্যবোধই যে যথেষ্ট নয়। সে কথাও রবীন্দ্ৰনাথের মত এমন করে আর কে বুঝেছে?
‘যখন বয়স অল্প ছিল তখন নানা কারণে লোকালয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল না, তখন নিভৃতে শিল্পপ্রকৃতির সঙ্গেই ছিল আমার একান্ত যোগ। এই যোগটি সহজেই শান্তিময়। কারণ এর মধ্যে দ্বন্দ্ব নেই, বিরোধ নেই, মনের সঙ্গে মনের, ইচ্ছার সঙ্গে ইচ্ছার সংঘাত নেই। এই অবস্থা ঠিক শিশুকালেরই সত্য অবস্থা…
‘বিশ্ব প্ৰকৃতির সঙ্গে নিজের প্রকৃতির মিলটা অনুভব করা সহজ। কেন না। সে দিক থেকে কোনো চিত্ত আমাদের চিত্তকে কোথাও বাধা দেয় না। কিন্তু এই মিলিটাতেই আমাদের তৃপ্তির সম্পূর্ণতা কখনো ঘটতে পারে না। কেন না আমাদের চিত্ত আছে, সেও আপনার একটি বড় মিল চায়। BB এই মিলটা বিশ্বপ্ৰকৃতির ক্ষেত্রে সম্ভব নয়, বিশ্বমানবের ক্ষেত্রেই সম্ভব।’
প্ৰকৃতি থেকে মানব, বিশ্বপ্রকৃতি থেকে বিশ্বমানব-এই ব্যাপকতম উপলব্ধি মানুষেরই বিশ্বপরিক্রমার ইতিহাস। যে ভাষা, যে প্রতীক ও সংকেত, যে দর্শন ও সাহিত্য কখনও বিকৃত বস্তুবাদের নামে, কখনও স্বার্থন্বেষী দেশহিতৈষণার নামে, কখনও ‘বিজ্ঞান ধমিতার’ নামে মানুষের এই স্বাভাবিক বিশ্বমুখীনতাকে ব্যাহত করে, তা মানুষের গৌরবের সামগ্ৰী নয়। যানুষকে খণ্ডিত করে একরাশ পরমাণুপুঞ্জের মধ্যে বিকীর্ণ করে দেখা “বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি নয়। খণ্ডিত মানুষকে মিলিত করাই বিজ্ঞানের দৃষ্টি। এ দৃষ্টি সাহিত্যের, এ দৃষ্টি দর্শনের। কারণ এ সুস্থ মানুষের চিরায়ত স্বভাবসংগত। বিসদৃশের ভিতর সদৃশকে আবিষ্কার করে অসাহিত্যিক প্রথম মানুষ উপমা অলঙ্কার সৃষ্টি করেছিল, সকল মহান সাহিত্যিক এই আবিষ্কারকেই এগিয়ে নিয়েছেন মানুষের পরম কল্যাণের দিকে। মানুষের কল্যাণ ব্ৰতের নাম দেয়া যেতে পারে-সাদৃশ্যের অন্বেষণ।