শ্ৰেষ্ঠ সাহিত্যিক এই গৌরবের শ্রেষ্ঠ অংশীদার। উপরের উদ্ধৃতিটির ভিতরে পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের মৌলিক একাত্মতা শুধু কবির উপলব্ধির ভিতরেই নিঃশেষ হয় নি, পাঠকের চেতনাতেও সঞ্চারিত হয়েছে। এই সঞ্চারপ্রক্রিয়াকে সার্থক করার জন্য কবি যে ভাষা-প্ৰতীক ব্যবহার করেছেন তার ভিতরে আধুনিক কষ্ট-কল্পিত প্রতীক-ধৰ্মিতার উৎকট কসরৎ নেই। কয়েকটি অতিপরিচিত শব্দ ব্যাকরণের পরিচিত গাথুনির ভিতরে সুবিন্যস্ত হয়ে এক অসাধারণ ধারণাকে সাধারণের ধরার সীমানার মধ্যে এনে দিয়েছে। যাদের এ ক্ষমতা থাকে না, অথচ প্ৰকাশের দীনতাকে প্ৰকাশ্যে স্বীকার করতে ও যারা কুষ্ঠিত, তারা কাব্যকে শব্দের ধাধায় পরিণত করতে কুষ্ঠিত নয়। ব্যক্তিমানসকে সমাজমানসে সঞ্চারিত করার যে প্ৰাথমিক দায়িত্ববোধ শিশুমনেও সহজ অঙ্গীকার লাভ করেছে সেই দায়িত্ব থেকে নিস্কৃতি লাভই যেন শিল্পম্বাতন্ত্র্যের পরাকাষ্ঠা।
একদল আধুনিক দার্শনিক মনে করেন—আমাদের বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড কতগুলি খণ্ড ছিন্ন ইন্দ্ৰিয়বাহিত অভিজ্ঞতার সমষ্টিমাত্র। যা কিছু অতি-প্ৰাথমিক ইন্দ্ৰিয়ানুভূতির বাইরে, তাই অর্থহীন। এই দর্শনের মতে আমি, আপনি, নদী, পাহাড়, আকাশ, প্ৰান্তর কোন ও কিছুরই মৌলিক অস্তিত্ব নেই। একজন বললেন গতিদিনের রবিনসন ক্রুশো আর আজকের রবিনসন ক্রুশোর মধ্যেও মূলতঃ কোনও ঐক্য নেই। দুই দিনের ‘এক’ ব্যক্তি এক নয়। তাই এই দুই-এর ভিতর যে সম্বন্ধ, তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে ক্রুশোরও ঐ একই সম্বন্ধ। কাজেই সম্বন্ধ থাকা না থাকা একই কথা, ওটা ‘বস্তুজগতের’ ব্যাপার নয়, একটা অর্থহীন অভ্যাস-সঞ্জাত কল্পলোকের ব্যাপারমাত্র। এদের মতে সাধারণ মানুষের ভাষাই মানুষের কাল হয়েছে। এই ভাষা বস্তুহীন জগতকে বস্তুর ভারে ভারাক্রান্ত করেছে। এই সাধারণ মানুষের ভাষার হাত থেকে নিস্কৃতিলাভের উপায় আবিষ্কার করাই দর্শনের প্রধান কাজ। সুতরাং ভাষাকে গাণিতিক সংকেতে পরিণত করতে হবে, নূতন নূতন বদখত চেহারার কতকগুলি সংকেতচিহ্র দ্বারা আমাদের প্রাথমিক ইন্দ্ৰিয়জ্ঞানকে প্ৰকাশ করতে হবে। “আমি একখানা বই দেখছি’ এজাতীয় বাক্য অর্থহীন। আমিও নেই, বইও নেই, আছে শুধু দেখা নামক একটি ইন্দ্রিয়গম্য ঘটনা বা অভিজ্ঞতা। যে দেখেছে। আর যাকে দেখছে–ওসব রহস্যবাদী কথা ভুলে যান। একটি লাল রঙের দেখা, একটি নীল রঙের দেখা, এই পৰ্য্যন্ত। এখন এই বিভিন্ন রক্ত নীল বা পীত দৃষ্টির জন্য বিভিন্ন গাণিতিক সংকেত ব্যবহার • করুন-সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল, দর্শনশাস্ত্ৰে যুগান্তর ঘটে গেল। Hume। Mach-এর দর্শন, অথবা দু’হাজার বছর আগেকার বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ দর্শন নূতন নামাবলী গায়ে দিয়ে আসরে নেমেছে। লেনিনের Empirico-Criticism এদের কাছে অপাংক্তেয়। কারণ তার প্রত্যেকটি পংক্তি এদের নিদারুণ আঘাত করে।
এখন শোনা যাচ্ছে এই দর্শনের জ্ঞানাঞ্জন-শলাকায় চক্ষু উল্মীলিত করে নূতন ধরণের কাব্য সাহিত্য সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা চালান হবে, হয়ত ব| সুরুও হয়ে গেছে। মানুষের ভাষা ও ব্যাকরণকে বর্জন করে ‘বিজ্ঞানধর্মী’ সাহিত্য সৃষ্টি হবে, গণিতের সংকেতের সারি দিয়ে খণ্ডিত অভিজ্ঞতার সমষ্টিকে সার বাধা হবে। অনেক সময় মনে হয় অনেক আধুনিক বাংলা কবিতাও এই প্ৰচেষ্টারই প্ৰাথমিক পরীক্ষা কিনা। শব্দের অর্থ কোনও রকমে বুঝতে পারলেও বাক্যের অর্থ যখন বুঝি না, একটি বাক্যের সঙ্গে আর একটি বাক্যের অর্থগত কোনও মিল যখন অনেক কষ্ট করেও বুঝতে পারি না, বাক্যগঠনে চিরকাল প্ৰচলিত ‘যোগ্যতা’ ‘আসাত্তি’ ও ‘আকাজক্ষার’ নিয়ম যখন স্বেচ্ছাকৃতভাবেই উপেক্ষিত হয় তখন সত্যিই খটকা লাগে– এটা কোন অতি আধুনিক দর্শনের ছোয়ালাগা প্রগতির প্রকাশ কিনা। এই দর্শনের একটা মূল কথা, একটি লোকের দুইটি ক্ষণের অভিজ্ঞতাও একই লোকের অভিজ্ঞতা নয়। সুতরাং অপরের জ্ঞানের সঙ্গে তার মিলের কথা ত উঠতেই পারে না। ঐ মিলিটা মোটেই পারমার্থিক নয়। নিতান্তই ব্যবহারিক। এর সহজ সিদ্ধান্ত এই হওয়া উচিত-সারা দুনিয়াটাই split-personalityর ভাঁড়ার ঘর, সুতরাং ভাষা এখন আর মানুষের অর্থবোধের অপেক্ষা রাখেন, বিভিন্ন মানুষ যাতে সমানে অংশ গ্ৰহণ করতে পারে এমন কোনও ইতারজনগ্রাহ ভাববস্তুকে প্ৰকাশ করার দায়িত্ব থেকে ভাষা। মুক্তি পেয়েছে। মানুষে মানুষে যোগাযোগের সেতু হিসাবে কাজ করার ভূমিকা ভাষার শেষ হয়ে গেছে।
অনেক বন্ধু এ রকমের একটা উদার ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন যে আধুনিক জীবনটা এতই জটিল যে তাকে সাহিত্যে প্ৰকাশ করতে হলে স্বভাবতই জটিল আঙ্গিক গ্ৰহণ করতে হয়। একথার দুরকম অর্থ হতে পারে—জীবনের জটিলতা প্রকাশ করার জন্য স্বেচ্ছাকৃতভাবে জটিল আঙ্গিক প্ৰয়োগ করা হচ্ছে। অথবা জীবনের জটিলতা কবি-সাহিত্যিকের মনেও এমন জট সৃষ্টি করেছে যা তার সাহিত্য কর্মের আঙ্গিক ও ভাববস্তু উভয়ত্রই প্ৰতিফলিত হয়েছে। প্ৰথম পক্ষে বলা যেতে পারে, জট দিয়ে জটিলকে প্রকাশ করা যায় না, আরও জট পাকানো যায়। দ্বিতীয় পক্ষে কবি-সাহিত্যিক নিজেই একটা pathological case, সমাজ-চিকিৎসার রোগী, সমাজবিজ্ঞানীর গবেষণার বিষয়।
‘ব্যতিরোকি’-দর্শন জীবনের অনেক কিছুই অতিরিক্ত বলে বর্জন করেছে। ধর্মীয় অনুভূতিই বলুন, সাহিত্যিক উপলব্ধিই বলুন, নৈতিক আদর্শই বলুন। — ওগুলি দার্শনিক সত্যাসত্যের বিষয় নয়। তাই এগুলি দার্শনিক বিচারে অর্থহীন। কারণ মূল্যবোধ বা মূল্যবিচার দর্শনের পরিধির বাইরে। যে ভাষা ইন্দ্ৰিয়লব্ধ ক্ষণিক অভিজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গতি রাখে তাই কেবল অর্থপূর্ণ, বাকী সব অর্থহীন। এই নিরিখে রবীন্দ্রনাথের সত্য উপলব্ধির সঙ্গে দার্শনিক সত্যদৃষ্টির কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং পূর্বের উদ্ধৃত কথাগুলির কোন অর্থ নেই।