‘এক সময় … আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে ছিলেম” …… আমার এই যে মনের ভাব, এ যেন এই প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত মুকুলিত পুলকিত সূৰ্য্যসন্নাথ আদিম পৃথিবীর ভাব। যেন আমার এই চেতনার প্রবাহ পৃথিবীর প্রত্যেক ঘাসে এবং গাছের শিকড়ে শিকড়ে শিরায় শিরায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে, সমস্ত শস্যক্ষেত্রে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে। এবং নারিকেল গাছের প্রত্যেক পাতা জীবনের আবেগে থর থর করে কাঁপছে। … …’
‘আমি বেশ মনে করতে পারি, বহু যুগ পূর্বে তরুণী পৃথিবী সমুদ্রস্নান থেকে সবে মাথা তুলে উঠে তখনকার নবীন সূৰ্য্যকে বন্দনা করছেন তখন আমি পৃথিবীর নূতন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোস্থাসে গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলেম। তখন পৃথিবীতে জীবজন্তু কিছুই ছিল না, বৃহৎ সমুদ্র দিন রাত্রি দুলছে এবং অবোধ মাতালের মতো আপনার নবজাত ক্ষুদ্র ভূমিকে মাঝে মাঝে উন্মত্ত আলিঙ্গনে একেবারে আবৃত করে ফেলছে। তখন আমি এই পৃথিবীতে আমার সর্বাঙ্গ দিয়ে প্রথম সূৰ্য্যালোক পান করেছিলেম-নব শিশুর মত একটা অন্ধ জীবনের পুলকে নীলাম্বর তলে আন্দোলিত হয়ে উঠেছিলেম, এই আমার মাটির মাতাকে আমার সমস্ত শিকড়গুলি দিয়ে জড়িয়ে এর স্তন্যরস পান। করেছিলেম।’
‘প্রকৃতি তাহার রূপরস বর্ণগন্ধ লইয়া মানুষ তাহার বুদ্ধিমন তাহার স্নেহ প্ৰেম লইয়া আমাকে মুগ্ধ করিয়াছে—সেই মোহকে আমি অবিশ্বাস করি না। সেই মোহকে আমি নিন্দা করি না। তাহা আমাকে বদ্ধ করিতেছে না, তাহা আমাকেই মুক্তই করিতেছে; তাহা আমাকে আমার বাহিরেই ব্যাপ্ত করিতেছে, নৌকার গুণ নৌকাকে বাধিয়া রাখে নাই; নৌকাকে টানিয়া টানিয়া লইয়া চলিয়াছে। জগতের সমস্ত আকর্ষণপাশ আমাদিগকে তেমনি অগ্রসর করিতেছে।’ (আত্ম পরিচয়)
এই দীর্ঘ উদ্ধৃতির প্রথম দুইটি অনুচ্ছেদকে আলঙ্কারিক পরিভাষায় ‘উৎপ্রেক্ষা’ মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কোন গভীর উপলব্ধিকে অলঙ্কারের দ্বারা চিহ্নিত করার প্রচেষ্টার ভিতরে ‘আঙ্গিক’-প্রধান দৃষ্টির সংকীর্ণতা বিমুগ্ধ হৃদয়কে পীড়িত করে। উপলব্ধির দিক থেকে এখানে কোন অসম্ভবের সম্ভাবনা নেই। বাংলা ‘যেন’ কথাটি এখানে ইংরেজী ‘as if’ এর ধারণা বহন করে না। নদীর তরঙ্গভঙ্গীকে যখন কোন কবি ক্ৰোধোদ্দীপ্ত ভ্ৰকুট বলে কল্পনা করেন, তখন তার ভিতরে একটা সচেতন ‘অসত্য’ ভাষণের অপরূপ প্রয়াস আমাদিগকে মুগ্ধ করে। অসম্ভবের সম্ভাবনাই কল্পনা ও প্রকাশ ভঙ্গীকে গৌরব দান করে। কিন্তু বিশ্ব-কবির অনুভূতি এখানে অবস্তুকে বস্তুরূপে প্ৰতিভাত করে না, কল্পনার ঐশ্বর্যের দ্বারা ভাবনাকে পীড়িত করে না, কিন্তু এক সুনির্বিড় সত্যভাবনার ভিতরে মানুষ ও পৃথিবীর ইতিহাসের একটা বৃহৎ সত্যকে প্রকাশ করে। এই সাহিত্যিক বিশ্বদৃষ্টির সম্মুখে বিশ্বের সত্যরূপ প্রসারিত ও প্ৰকাশিত।
এখন যদি বলা যায় কবির এই অনুভূতি নিতান্তই তার ব্যক্তিগত, যার গভীরে অবগাহন করার মত ক্ষমতা সাধারণের নেই, তাহলে কবিকে সম্মান দেয়া হল, কি অসম্মান করা হল, এ নিশ্চয়ই ভাববার কথা। শুধু কবির কথাই বলছি কেন। যে কোন মানুষের ভাবনা ও বাসনা এক হিসাবে ব্যক্তিগত, আর এক্ল হিসাবে সমাজগত। আমাদের প্রাচীন আলঙ্কারিক রসগ্ৰাহী পাঠক ও দর্শকের নাম দিয়েছেন ‘সহৃদয়’ ও ‘সামাজিক’। এই পারিভাষিক নামকরণ দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কবির হৃদয়ের সমান হৃদয় রয়েছে পাঠকের, একই ভাবনায় ভাবিত হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে—এ ক্ষমতা এই সহৃদয়তা শুধু তার একার নয়। সমাজের মানুষের চিন্তা ও ধারণা ব্যক্তিহৃদয়ের মধ্যে ঠাই পেয়েছে; মানুষে মানুষে যত প্ৰভেদই থাকুক, সমান হৃদয়, সমান ভাবনা, সমান চেতনা না থাকলে মানুষের সঙ্গে মানুষের কোনদিন কোন সম্পর্ক গড়ে উঠত না, এমন কি কোন শক্রিতার সম্পর্কও গড়ে উঠতে পারত না। আপনি যাকে গাছ ভাবেন, আমি যদি তাকে মানুষ ভাবতাম, আমি যাকে টেবিল ভাবি, আপনি যদি দেখতে পেতেন। সে চাৱ পা ফেলে দৌড়াচ্ছে, আপনার দুঃখের অশ্রুকে আমি যদি সুখের জলসেক বলে মনে করতাম, তাহলে পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, দাস-ভৃত্য, বন্ধুত্ব আর বৈরিতা— মানুষের সকল সম্পর্কই ঘুচে যেত। প্ৰত্যেকটি মানুষ তার নির্জন দ্বীপে একটি নির্বাসিত রবিনসন ক্রুশো হয়ে থাকত। প্রাচীন আলঙ্কারিক বুঝেছিলেন মানুষ যে সহৃদয়, মানুষ যে সামাজিক, এ তার সাহিত্যানুভূতিরও মূল ভিত্তি, যে ভিত্তিতে সাহিত্যিক অসাহিত্যিক বিদ্বান ও মুর্থ এক জায়গায় মিলেছে। এই সর্বসাধারণ সহৃদয়তা ও সামাজিকতাকেই আরও বেশী সুসংস্কৃত ও পরিচ্ছন্ন করে তুলতে পারলে আমরা সাহিত্যিক সামাজিকতা ও সহৃদয়তায় পৌছাতে পারি।
শৈশব থেকে শিশুর সাধনা চলেছে তার অনুভুতির ব্যক্তিসত্তাকে অতিক্রুম করে সমাজ সত্তায় পৌঁছাবার জন্য। মা শিশুকে আঙ্গুল দিয়ে চাঁদ দেখাবার পর শিশু যেদিন আঙ্গুল দিয়ে মাকেই আবার চাঁদ দেখাতে শিখল, সেদিন এই শিশু নিছক অন্ধ জৈব প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে তার নিস্কৃতির পাল| সুরু করল। শুধু ব্যক্তিগত প্ৰতিক্রিয়া প্ৰকাশ করাই নয়, একটি সমান প্রতীকের ব্যবহার দ্বারা অন্যের ভিতরে ও সমান প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা সম্ভব, এই প্রারম্ভিক সামাজিক সত্য তার কাছে আবিষ্কৃত হল। তারপর অঙ্গুলিনির্দেশের এই স্কুল প্রতীককে অতিক্রম করে যখন সে ভাষাগত প্রতীকে উপনীত হল। তখন শিশুমনের সমাজীকরণ যেন একলাফে অনেকদূর এগিয়ে গেল। প্ৰথম শব্দটি শেখার সঙ্গে বার বার তার উচ্চারণ, আর ঐ উচ্চারিত শব্দের দ্বারা কোন বস্তুর সনাজীকরণ শিশুচেতনার অগ্রগতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শব্দের ব্যবহার শেখার সঙ্গে সঙ্গে মানবশিশু সমাজের মানুষ হতে শিখেছে। অন্যের ভাবনাকে আত্মসাৎ করা ও নিজের ভাবনা দ্বারা অন্যের চেতনাকে অনুবিদ্ধ করা, এই দেনা পাওনার কৌশল সে আয়ত্ত করেছে। বিভিন্ন ব্যক্তিচেতনায় বিধৃত ভাব ও বস্তুকে একটি শব্দপ্রতীকের মাধ্যমে একটি সর্বসাধারণ ভাবনার আকারে বেঁধে রাখা যে সম্ভব, এ আবিষ্কার মনুষ্যত্বের গৌরব।