আমরা অনেকেই ছাদ পেটানো গান শুনেছি। গানের ভাবার্থের সঙ্গে কাজের মিল নেই। কিন্তু গানের তালের সঙ্গে কাজের তালের মিল রয়েছে। নদী থেকে কাছি বেঁধে বড় বড় গাছের গুড়ি টেনে তুলতে দেখেছি। অনেকে মিলে টানছে আর ছড়া বলছে। সে ছড়াগুলির অর্থ অনেক সময় এতই কুৎসিত যে ভদ্র সমাজে পরিবেশন করা অসম্ভব। কিন্তু ছড়ার তালে একসঙ্গে কাছিতে টান পড়ছে, বিপুলকায় তরুস্কন্ধ ডাঙ্গায় উঠে আসছে। মানুষের দৈহিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে এই যে গানের মিল এ কোন সাহিত্যিক বা দার্শনিক সৃষ্টি করে নি, সাধারণ মানুষ জীবনের তাগিদে এই মিলকে খুঁজে বার করেছে। আদিম মানুষের শিকার নৃত্য এবং তার আনুষঙ্গিক আদিম ভাষার ভিতরে নিতান্ত প্ৰাণধারণের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে যে “তত্ত্ব’ জীবনের স্বাভাবিক স্বীকৃতি লাভ করেছে তাকেও বলা যেতে পারে বৈসাদৃশ্যের ভিতরে সাদৃশ্যের অঙ্গীকার। সবাই মিলে বাচা, তাই সবাই মিলে নাচ। আর সে নাচকে সতেজ রাখার জন্য সবাই মিলে ভাষা। এ না হলে প্ৰতিকুল প্রকৃতির কোলে প্ৰথম মানুষ বাচিত না। বাঁচবে বলে মানুষ মিলেছে, মিলবে বলে নাচের সঙ্গে জান্তব্যপ্ৰায় ভাষাকেও মিলিয়ে দিয়েছে।
আমাদের দেশের ভেদাভেদবাদী দার্শনিকরাও ভেদের ভিতরে এই অভেদের উপলব্ধিকে মানুষের মুক্তির উপায় বলে নির্দেশ করেছেন। বহু বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত বস্তুকে একটি শব্দের দ্বারা একসঙ্গে প্ৰকাশ করার কৌশল মানুষ যেদিন প্ৰথম আয়ত্ত করেছিল, তখন তার অগ্রগতির ইতিহাসে একটা যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছিল বলতে হবে। পরস্পর-বিচ্ছিন্নরূপে প্ৰতিভাত মূর্ত বস্তুগুলিকে একটি বিমূর্তভাবের আধারে বিন্যস্ত করে ধরে রাখার উপায় আবিস্কৃত না হলে মানুষ মানুষ হত না, জানোয়ারই থেকে যেত। সকল মানুষকে এক “মানুষ’ নামে অভিহিত করা, সকল গাছকে “গাছ” বলে চিনতে পারা ও বলতে পারা, ন্যায়শাস্ত্রে যাকে বলে ‘সামান্য’ বাচক শব্দ, সেই একটি সাধারণ শব্দের দ্বারা বহু অসাধারণকে একত্র করে গেথে রাখা-এ হ’ল মানুষকে মানুষ করে তোলার কাজে এক অপরিহাৰ্য্য অঙ্গ। তারপর, ‘সমাজ” ‘সংসার’, ‘বিশ্ব, প্রভৃতি আরও উন্নত স্তরের বিমূর্ত-ভাবব্যঞ্জক শব্দগুলি আরও বহু বিচিত্র মূর্ত ব্যক্তিগুলিকে মানুষের মনন ও ভাবনার মধ্যে এক জায়গায় এনে একটি ভাবমূর্তিতে দাঁড় করিয়েছে। বিমূতকে পরিহার করে কেবল মুতী ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই আমাদের ধ্যান ধারণা যদি ঘুরপাক খেতে থাকত, তাহলে শুধু “সমাজ’, ‘সংসার’ই মিছে হত না, ‘জীবনের কলরব’ও মুছে যেত।
এক আধুনিক আমেরিকান দার্শনিক বলবার চেষ্টা করেছিলেন যে মানুষের সকল দুঃখের মূল কারণ কতগুলি বিমূর্ত শব্দের অত্যাচার। তার মতে বস্তুজগতে ‘মনুষ্যসাধারণ” বলে কিছুই নেই, আছে কেবল ১নং আদমী, ২নং আদমী…এই ভাবে অনির্দিষ্ট সংখ্যা পর্যন্ত। ‘সমাজ’, ‘সভ্যতা’, ‘সংস্কৃতি’, ‘ফ্যাসিবাদ’, ‘পুজিবাদ’, ‘সাম্যবাদ’–এই সব নিরর্থক শব্দের চাপে নিপীড়িত হয়ে মানুষ নির্বোধের মত হানাহানি করে মরছে। মানুষের জীবনের ব্যাকরণ থেকে common noun, abstract noun প্রভৃতি সবগুলি বিশেষ্য তুলে দিয়ে একমাত্র proper nounকেই ধরে রাখতে জানলে আর কোন গোলমাল নেই। মানুষকে সংখ্যা মাত্রে পরিণত করার লোভ-কলুষ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রবীন্দ্ৰনাথের ‘রক্ত করবী’তে বিদ্রুপ জর্জরিত ধিক্কার উচ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু এখন মানুষকে আবার সেই সংখ্যা হিসাবে পরিচিত করার কৌশল প্রয়োগ করতে হবে।
‘ব্যক্তি স্বাধীনতার’ এই দুরন্ত দার্শনিক আন্দোলন পশ্চিম জগতে এখনও বেশ জোরদার। আমাদের দেশের প্রাচীন আলিঙ্কারিক বলেছেন-উপাম| অলঙ্কারের ভিতরে ভেদাভেদের একটা চমৎকার ভারসাম্য রয়েছে। অভেদের চেয়ে ভেদটা বড় হয়ে উঠলে উপমা পরিণত হয় ‘ব্যতিরেক’ অলঙ্কারে, এবং ভেদটাকে চাপা দিয়ে কেবল অভেদটাকেই তুলে ধরলে উপমার জায়গা দখল করে ‘রূপক’ অলঙ্কার। মানুষের জীবন-দর্শনে আজ সবচেয়ে বড় জিজ্ঞাসা-যে দৃষ্টিভঙ্গী গ্ৰহণ করলে মানুষ তার জীবন-দৃষ্টির স্বচ্ছ প্রশান্তি ফিরে পাবে সে কি উপমা, রূপক, না ব্যতিরেক? এ জিজ্ঞাসা সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক সকলকেই ব্যাকুল করে তুলেছে।
‘ব্যতিরোকি’ দৰ্শন যখন সাহিত্যকে আক্রমণ করে তখন অঘোর-পন্থী তান্ত্রিকের ব্যভিচারে সাহিত্যের আলো বাতাস বিষাক্ত হয়ে ওঠে। এই বিষেরই সর্বশেষ প্রসব বোধ হয়। বিটনিক-কাব্য। বিটানিকের বামাচার ‘কুলার্ণব তন্ত্রের’ও কুলনাশ করেছে। তাই স্বাধীন সাহিত্যে এদেরও বোধ হয় অবাধ গতিবিধি। কিন্তু এ কাব্য আমাদের আলোচ্য নয়। বস্তুত কোনও গোষ্ঠী-কাব্যই আমাদের আলোচ্য নয়। আমরা আলোচনা করছিলাম জীবনদর্শনের এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গীর কথা যা আদিমকাল থেকে বৈচিত্র্যের ভিতরে ঐক্য সাধনে ব্যাপৃত। কোন সচেতন দার্শনিকের দর্শন-সূত্রে নিবদ্ধ হওয়ার বহু আগে থেকেই এই দৃষ্টি মানুষের জীবনের মূলে অজ্ঞাত অঙ্গীকার লাভ করেছে। পৃথিবীতে মানুষ যেদিন প্রথম এসেছে সেদিন থেকেই সে ব্যক্তিসত্তাকে অতিক্রম করার কাজ সুরু করেছে। বহিঃপ্রকৃতির আলো বাতাস জল সে পান করেছে, তারই কাছ থেকে খাদ্য গ্ৰহণ করেছে, এই ভাবেই তার দেহ মন ও অনুভূতি গঠন করেছে। প্ৰতি মুহূর্তে বহির্জগতকে এই ভাবে ‘আত্মসাৎ’ করতে না পারলে তার ‘ব্যক্তিসত্তাই’ গঠিত হত না। পরকে আপন করা, বাহিরকে ঘর করার এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে মানুষ এখনও বেঁচে আছে, ভবিষ্যতেও এই ভাবেই তাকে বেঁচে থাকতে হবে। প্রতিকূল প্ৰকৃতির সঙ্গে এই অনুকুল একাত্মতা না থাকলে মানুষের বোধশক্তি প্ৰথম দিনেই লোপ পেয়ে যেত, যদিও এই একাত্মতা মানুষের বোধির ভিতরে ধরা পড়তে কয়েক যুগ সময় নিয়েছে। এই একাত্মতার ঐকান্তিক অনুভূতি যখন কবির হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে তখন তার প্রকাশভঙ্গীও বিশ্ব-কাব্যকে প্রকাশ করার উপযুক্ত গৌরব অর্জন করে। যিনি বিশ্ব-কাব্যকে প্রকাশ করতে পারেন। তিনিই বিশ্ব-কবি :