মানুষের শৈশব আছে, কৈশোর আছে, যৌবন আছে কিন্তু বাৰ্ধক্য নেই, কারণ তার জানার শেষ নেই। বিশ্বপ্রকৃতির পরিপূর্ণ সত্য চিরকাল মানুষের অগোচর থাকবে, কারণ সে সত্য স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ, মানুষের জানা অজানার উপর তা মোটেই নির্ভর করছে না, আর সেই জন্যই মানুষের সভ্যতা ও কোনদিন ঘুমিয়ে পড়বে না। মানুষের জ্ঞান আংশিক, আপেক্ষিক, তাই সে চরিকাল বাঁচবে। সকলের জ্ঞানকে একত্র করে আরও বেশী করে জানবে, অপূর্ণতাকে যতদূর সম্ভব পূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করবে। অনেক কিছুই অজানা থাকবে একথাও যেমন সত্য, আদিম মানুষের তুলনায় অনেক –বেশী জানা গেছে, আরও বেশী জানা যাবে একথাও তেমনি সত্য। বিশ্বপ্রকৃতির নিত্যনূতন রহস্য ভেদ করার মধ্যেই মানুষের অন্তহীন গৌরব। মার্কসবাদ এই গৌরবে বিশ্বাসী; এই জন্যই যদি তাকে “মানবকেন্দ্ৰিক” বলা যায় তবে এই মানবকেন্দ্রিকতা একনিষ্ঠ সত্যানুসন্ধিৎসার ছাড়পত্র। এই ছাড়পত্র যে দেশ পেয়েছে সেই দেশ সকলের আগে মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছে। এমন একটা সমাজব্যবস্থা যদি গড়ে তোলা যায় যেখানে মানুষের লোভ মানুষের বাঁচার পথে অন্তরায় নয়, যেখানে সকলের সম্মিলিত জ্ঞানভাণ্ডারকে অবাধে পূর্ণসত্যের সাধনায় নিয়োজিত করা সম্ভব, তাহলে মানুষ যে অসাধ্যসাধন করতে পারে—তার প্রমাণ সোভিয়েট রাশিয়া। সাম্যবাদী দর্শনের মর্মকথা সোভিয়েত সমাজের ব্যবহারিক কর্মকাণ্ডে প্ৰযুক্ত হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে একথাও প্রমাণিত হয়েছে,–সাম্যবাদী দর্শন সত্যোলব্ধির দর্শন। এ দর্শন মানুষকে বাঁচতে শেখায়, সত্যকে জানতে শেখায়। কয়েক বছর আগে রাসেল বলেছিলেন-সোভিয়েত রাশিয়ার বৈপ্লবিক সাফল্য মার্কসবাদ ছাড়াও হতে পারত। ব্যাকরণের Subjunctive mood-টা বড় বেশী subjective। উত্তরে শুধু এটুকুই বলা চলে—যে দেশের চিন্তারাজ্যে Berkley, Hume ও Russell-এর নিরঙ্কুশ আধিপত্য সেই Newton-এর দেশে রাশিয়ার অনেক আগে মহাকাশ জয় করা যেত।
সাহিত্য ও সাদৃশ্য
‘সাহিত’ থেকে ‘সাহিত্য’ হয়েছে। এ বিষয়ে কারুর সন্দেহ নেই। কারণ পাণিনির বিধান তর্কাতীত। তর্ক বেধেছে কার সহিত কে মিলেছে তাই নিয়ে। অনেকে বললেন, শব্দের সহিত অর্থ মিলেছে; কেউ বললেন, কবির হৃদয়ের সহিত রসিক পাঠকের হৃদয় মিলেছে। রবীন্দ্ৰনাথ বললেন, মানুষের সহিত মানুষ মিলেছে, তাই সাহিত্যের জন্যই “সাহিত্য’। রবীন্দ্ৰনাথ যে ব্যাখ্যা দিলেন তা শুধু প্রশস্ততমই নয় প্রসন্নতমও বটে। তর্কের কথা বাদ দিলেও কোথাও একটা মিল, একটা নৈকট্য স্থাপন না করলে সাহিত্য তার নামের সার্থকতা লাভ করতে পারে না, একথা বুঝতে বোধ হয় অসুবিধা নেই।
‘চাঁদপান মুখ’ কথাটি যে মানুষ প্রথম আবিষ্কার করেছিল সে বোধ হয় সাহিত্যিক ছিল না। শৈশবের বর্ণপরিচয়ে মা যখন বলতেন চাঁদমুখে ভ, হাঁটুভাঙা দ, তখন মাও সাহিত্যিক ছিলেন না। তবু এই শব্দগুলির ভিতরে সাহিত্যের একটা মৰ্মকথা লুকিয়ে রয়েছে। অলঙ্কারশাস্ত্রীরা তার মর্ম উপলব্ধি করে অনেক বিচার বিশ্লেষণও করেছেন। বেশ কিছুদিন আগে ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় চাঁদপান মুখ, বাঁশীর মত নাক ও পটলচেরা চোখের এক কাটুন দেখেছিলাম। কাটুর্নকারের উদ্দেশ্য হয়ত ছিল একটু বিশুদ্ধ হাস্যরস সৃষ্টি করা। কিন্তু এর ভিতর দিয়ে অলঙ্কারশাস্ত্রের একটা গভীর তত্ত্বও হয়ত অজ্ঞাতসারেই বার হয়ে পড়েছে। মনে করুন কারুর মুখ চাদের মত থালাকার গোল, আর চাঁদের মতই সে মুখ থেকে আলো বার হচ্ছে। তাহলে কিন্তু চাঁদপানা মুখ দেখে খুন্সী হওয়া যেত না, সাহিত্যেও সে মুখের কোন ঠাই হত না। আকাশের চাঁদ ও মাটির মানুষের মুখের ভিতর যে মিলটুকু মানুষ গ্রহণ করেছে সে এক মিগ্ধোজ্জল কমনীয় কান্তি যা মানুষের সৌন্দৰ্য্যবোধকে পরিতৃপ্ত করে, প্ৰসন্ন করে। অমিলের ভিতরে এই মিলকে উপলব্ধি করা, দূরের ভিতর এই আত্নীয়তাকে আবিষ্কার করা উপমা অলঙ্কারের মূল কথা। সাহিত্যশাস্ত্রীরা বলেছেন সব অলঙ্কারের মূলে রয়েছে এই উপমা অলঙ্কার; উপমা এক নিপুণা নটিনী, কত বিচিত্ৰ বেশে, কত বিচিত্ৰ অলঙ্কারের সাজে। সে বার বার সাহিত্যের আসরে অবতীর্ণ হয়।
এই তত্ত্বটিকেই এক বিখ্যাত আলঙ্কারিক ব্যাখ্যা করে বললেন-উপমা অলঙ্কারের ভিভরে রয়েছে এক বিচিত্র ভেদাভেদ সম্বন্ধ। এখন আবার প্রশ্ন করা হল, চাঁদের কান্তি, আর মুখের কান্তি কি এক, কোথায় এদের মিল। তখন আলঙ্কারিক আবার সুনিপুণ দার্শনিক বিশ্লেষণ সুরু করলেন; শেষ পৰ্য্যন্ত বলতে বাধ্য হলেন, এই মিলটি আর ভাষা দিয়ে বোঝান যাবে না, হৃদয় দিয়ে এর চমৎকারিত্ব অনুভব করতে হবে। সাহিত্যিক বা দার্শনিক না হয়ে ও কিন্তু সহজ মানুষ সহজ ভাবেই বিভেদের ভিতর এই মিল বা নৈকট্যকে উপলব্ধি করেছিল। সাধারণ মানুষের এই আত্মীয়তার উপলব্ধিকে আরও ব্যাপকতর ও উন্নততর। পৰ্য্যায়ে উন্নীত করতে পারার ভিতরেই সাহিত্যিকের কৃতিত্ব। তখন সে সাধারণের মধ্যে অসাধারণ।
মানুষ ভাষা পেয়েছিল ভাবকে প্ৰকাশ করার জন্য, গোপন করার জন্য নয়, সহজকে দুৰ্বোধ করার জন্য নয়। একই সমাজে, একই পরিবারে, এই একই সংসারে ভাষা মানুষের সঙ্গে মানুষকে মিলিয়ে দেয়। ভাবকে প্ৰকাশ করার অর্থই হ’ল যা ব্যক্তিগত তাকে ব্যক্তির বাইরে নিয়ে গিয়ে শেষ পৰ্য্যন্ত সমাজগত করে তোলা। মানুষের ভাষা সামাজিক সম্পত্তি, ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। সেজন্যই ভাষা-বাহিত ভাব রাশিকে ব্যক্তির হাত থেকে সমাজের হাতে তুলে দেয়াই তার কাজ। এই ‘depersonalisation’ বা নির্ব্যক্তীকরণ অর্থাৎ সমাজীকরণ মানুষের শৈশব থেকে সুরু হয়েছে। এ না হলে মানুষই বাঁচত না, সাহিত্য সৃষ্টি করা ত দূরের কথা।