জ্ঞান ও জ্ঞেয়ের সম্বন্ধের ব্যাপারেও ঐ একই কথা সত্য। মানুষের মস্তিক্ষে প্রতিফলিত বহিঃসত্যকে মানুষ জানে। নিছক অনুভূতিবাদী দার্শনিক বলেন, তবেই হ’ল। জ্ঞানের পরিধির বাইরে গিয়ে কোন কিছুই যখন জানা সম্ভব নয়, তখন সবই আমার একান্ত অন্তরের ধন। কিন্তু একথা বলে অনুভূতিবাদী নিজের অন্তরেই বিরোধের পাকে জড়িয়ে পড়লেন। একই জ্ঞান, জ্ঞান ও জ্ঞেয়, এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল; একজন জ্ঞাত এনে যদি এখন হাজির করা যায়, তবে তো বিরোধটা আরও বেশী জমে উঠবে। মানুষের ধারণা জ্ঞেয় পদার্থটা জ্ঞানের বাইরে, জ্ঞান ও জ্ঞেয় একই পদার্থ নয়। কিন্তু বিজ্ঞানবাদী যদি জ্ঞেয়কে জ্ঞানের অন্তর্গত বলে মনে করেন, তবে নিজের অন্তরে বিপরীতের বিরোধ তাকে মেনেই নিতে হবে। যদি বিরোধটা মানতেই হল। তবে সাধারণ মানুষের ধারণা নিয়ে বহির্বস্তুকে বাহির বলেই মানতে আর আপত্তি করার কি আছে। আর একথাও খাটি সত্য যে তর্কের সময় অন্তরের ধন নিয়ে যিনি যতই মেতে উঠুন না কেন, প্রকৃত জীবনে নিজের বাইরে একটা বস্তুজগতের উপর অবিচল ও অকৃত্ৰিম বিশ্বাস নিয়ে না চললে তর্কের দিনটি পর্যন্ত তার পক্ষে বেঁচে থাকার সৌভাগ্যই হত না। যে বিশ্বাস ছাড়া এক পা ইটা ষায় না, এক মুহূর্ত বাঁচা ষায় না, তর্ক করার তাকত পাওয়া যায় না সে বিশ্বাসটাকে তর্কের খাতিরে উড়িয়ে দিতে হবে এমন আবদার করলে সে তার্কিককে গাছের ডালে চড়িয়ে দিয়ে বলতে হয়, একবার কালিদাস হোন, ডালটা কেটে দেখুন না কি হয়। সুতরাং অন্তর ও বাহির এই দুই ধারণা পরস্পরবিরোধী হলেও এই দুয়ের সমন্বয়েই আমাদের জ্ঞানের সৃষ্টি। একদিকে আমায় ইন্দ্ৰিয় স্নায়ু ও মস্তিষ্ক সমন্বিত দেহ আর একদিকে বাইরের বস্তুজগৎ-এই দুয়ের সম্পর্কের মারফত জ্ঞানের উৎপত্তি। এখানে ভিতর-বাইরের বিরোধটা “বৃত্তাকার বর্গক্ষেক্ষেত্রের” বিরোধ নয়। এইরূপে বিরোধ ও সমন্বেয়ের একই সঙ্গে ধারণা না থাকলে কোন বস্তুগত ধারণাই অসম্ভব। নিছক ভাববাদী দার্শনিকরা জ্ঞান ও জ্ঞেয়ের, অন্তর ও বাইরের বিরোধকে “বৃত্তাকার বর্গের” মতই মনে করেন। এই দুই ধরনের বিরোধকে একাকার করে দেখার ফলেই শংকরাচাৰ্য তার বেদান্তভাষ্য এই বলে আরম্ভ করলেন যে জ্ঞান ও জ্ঞেয় আলো ও অন্ধকারের মত পরস্পরবিরোধী। বিরোধ পরিহারের উপায়টিও সস্তা, জ্ঞেয় পদার্থকে বাদ দিলেই লেঠা চুকে গেল। তা হলে জ্ঞানের রূপ আকার প্রকার এসব কোথায় পাওয়া যাবে? বলা হল ওগুলোও মিথ্যা, এক নিরাকার জ্ঞানই অবিনশ্বর সত্য। মার্কসবাদী এখানে সবিনয়ে বলবে,–শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত যা ধারণা করতে পারে আপনি যদি তা না পারেন তবে আপনার ধারণার অক্ষমতাকে সম্মান দেখাবার জন্য পৃথিবীর সকল মানুষের ধারণা মুছে ফেলতে মায়ামোহগ্রস্ত জীবগুলো রয়েছে তাদের উদ্ধার করার জন্য আপনি ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন কেন? ব্রাহ্মণ্ডটা যখন আপনার ভিতরেই রয়েছে তখন আর আমাদের উদ্ধার করার জন্য বারে হাত বাড়াবার দরকার কি ছিল? যদি বলেন এসব কিছু করেছেন ব্যবহারিক সত্তার খাতিরে; তা হলে বলুন না কেন ব্যবহারিক সত্তাটাই সত্য; আপনার কল্পিত পারমার্থিক সত্তাটাই ভাববিলাস মাত্র? জগৎটা যদি রাজুতে সর্পভ্রমের মতই হবে, তবে উপমাটা তো আমরা একটু উল্টেও দেখতে পারি, দড়িটাই জগৎ আর সাপটাই ব্ৰহ্ম হোক না কেন? আর এটাই ঠিক হবে, কারণ এই বস্তুজগৎটার উপর দাঁড়িয়েই আপনি ব্ৰহ্মভাবে ভাবিত হয়েছেন।
।।আট।।
বস্তুজগতের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব যখন মার্কসবাদের একটি মূলসূত্র তখন আমাদের পূর্বালোচিত অর্থে মার্কসবাদকে নিশ্চয়ই “মানবকেন্দ্ৰিক” বলা যায় না। রাসেল শেষ পৰ্যন্ত যা বলতে চেয়েছেন তাতে মনে হয় মার্কসবাদ Pragmatic অর্থে মানবকেন্দ্রিক। কিন্তু এই ধরনের মন্তব্যের মুস্থিল হল এই যে মার্কসবাদী দার্শনিকরা সুস্পষ্ট ভাবে Pragmatic মতবাদকে আত্মকেন্দ্রিক বিজ্ঞানবাদ বা Subojective Idealism বলে ঘোষণা করেছেন। স্বয়ং লেনিনের এবিষয়ে একাধিক নিঃসঙ্কোচ বক্তব্য রয়েছে। তিনি বলেছেন যে, কোন বস্তু বা ধারণা আমাদের প্রয়োজন সাধন করে বলেই সত্য একথা ঠিক নয়, বরঞ্চ সত্য বলেই প্রয়োজন সাধন করতে পারে। এ কথাই ঠিক। আমরা আগেই বলেছি যে ব্যবহারিক প্রয়োগের দ্বারা কোন বস্তু বা ধারণাকে আমরা সত্য বলে জানতে পারি; কিন্তু এর দ্বারা আমরা বস্তুর অস্তিত্বটা তৈরী করছি না, সত্যের সৃষ্টি করছি না। এর অর্থ, আমরা জানি বলেই যে বস্তুটা আছে তা নয়, আছে বলেই তাকে জানি। একই কথা অন্যভাবে বলা যেতে পারে, বস্তুসত্য নিরপেক্ষ বা absolute, কিন্তু মার্কসের মতে সত্য আপেক্ষিক, আপেক্ষিক সত্য-মানেই তো pragmatic truth, যখন যে রকম ভাবলে, যে রকম করলে কাৰ্যসিদ্ধি হয় তখন তাই সত্য। এই অপব্যাখ্যার নাম স্বেচ্ছাকৃত বিকৃতি বা বুদ্ধির অক্ষমতাজনিত বিভ্রান্তি। সত্যকে যখন আমরা আংশিকভাবে জানি তখনই আমাদের জ্ঞানটা আপেক্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই এই অর্থে কোন বস্তু বা ঘটনার অসম্পূর্ণ ধারণাকে আপেক্ষিক সত্যও বলা যেতে পারে।
আমাদের ধারণা সাধারণতঃ কোন বস্তুসত্তার আপেক্ষিক সত্যকেই প্ৰকাশ করতে পারে। এই টেবিলটার উদাহরণটাই ধরুন না কেন। যে কাঠুরিয়া বনের গাছটা কেটে তক্তা করেছে, যে মিস্ত্রী তক্তা দিয়ে টেবিলটা তৈরী করেছে-টেবিল সম্পর্কে তারা যা জানে আমি কিন্তু তার কিছুই জানি না। এখন কাঠুরিয়া, মিস্ত্রী ও আমার খণ্ড খণ্ড ধারণাগুলি মিলিয়ে টেবিলটাকে যেভাবে জানা যাবে, আমার চোখের দেখায়, বা উপরে কাগজ রেখে লেখায় কিন্তু সেই পরিপূর্ণ জ্ঞানের ভগ্নাংশ মাত্র পাওয়া যাবে। মার্কস ও হেগেলের পূর্ববর্তী সমস্ত দার্শনিকরাই জ্ঞান ও জ্ঞেয়র আলোচনা করতে গিয়ে মূলত: ইন্দ্ৰিয়লব্ধ জ্ঞানের বিচারপ্রসঙ্গেই সীমাবদ্ধ রয়েছেন—চোখের সামনে যে বইটা দেখছি ওর সঙ্গে আমার দেখা বা জানার সম্পর্ক কি, এই সমস্যা নিয়েই দর্শন দিশাহারা হয়েছে। কাজেই আমার ব্যক্তিগত ইন্দ্ৰিয়লব্ধ জ্ঞানটুকু যে বস্তুস্বরূপের একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশমাত্র প্রতিফলিত করে, আমার অগ্রবতী অভিজ্ঞতা এবং সমাজের, আরও দশজনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামঞ্জস্য-বিধান করে আমাদের ধ্যানধারণা যে ক্রমশ: সমগ্ৰ বস্তুস্বরূপকে জানা ও বোঝার দিকে অগ্রসর হয়-জ্ঞানের এই ক্ৰমান্বয়ী অগ্ৰগতির দিকটা তারা বেমালুম পাশ কাটিয়ে চলে গেছেন। সামগ্রিকভাবে সামাজিক অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে অগ্রসর হতে না পারলে আমাদের খণ্ড খণ্ড জ্ঞানগুলি অন্ধের হাতি দেখারই সামিল। পূর্ণতা বা সমগ্রতাই সত্য–Truth is the whole-হেগেলের এই মতকে মার্কসবাদীরাও সত্য বলে মনে করেন। কোন বস্তুর সমগ্ৰ স্বরূপকে জানতে গেলে শেষ ধৰ্যন্ত বিশ্ব নিয়েই টান পড়ে। গাছটা ঠিক কি তা জামতে হলে গাছের উৎপত্তি ও পরিণতির সমগ্র ইতিহাস মিছিল করে মানুষের দরজায় হাজির হয়। বিজ্ঞানের সকল বিজুগ থেকে জ্ঞান সংগ্ৰহণ করতে হয়, সবকিছু মিলিয়ে একটা বিজ্ঞানসম্মত ধারণায় উপস্থিত হতে হয়। জ্ঞানটা তাহলে একদিনের ব্যাপার নয়, একজনের ব্যাপার নয়, বহুযুগের বহু মানুষের খণ্ডিত উদ্যোগ ও অভিজ্ঞতার সমন্বিত ফল হল সত্যের জ্ঞান। তথাপি এ জ্ঞান পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। কারণ অনেক রহস্য অনেকদিন ধরে অজ্ঞাত থেকে যাবে। মার্কসবাদ জ্ঞান ও জ্ঞেয়র সম্বন্ধকে পূর্ণতার দিকে অবিরাম অগ্ৰগতি হিসাবেই বিচার করে থাকে। এই অগ্রগতির বিরাম নেই, কারণ বিশ্বব্রহস্যের শেষ নেই। যা জানার তা জেনেছি, যা রোঝার তা বুঝেছি, যাকে জানলে সব জানা যায় সেই পরমপুরুষকে, জেনেছি—এমন কথ্য মানুষের পক্ষে বলা কোনদিন সম্ভব হবে না। যারা একদিন একথা বলেছেন তারা তাদের পথচারী পরিশ্রান্ত প্রজ্ঞার অক্ষমতাকে এক পরম্পুরুষ দিয়ে ঢেকে রেখে ক্লান্তি-জুড়ানো পরিতৃপ্তি নিয়ে ঘুমিয়ে শড়েছেন। সব জানা শেষ করে এই ঘুমিয়ে পড়াটাই যদি সার কথা হত। তবে পৃথিবীর বুকে আদিম মানুষের প্রথম পদধ্বনির কয়েক যুগ পরেই মানুষের সভ্যতাও হাওয়ায় মিলিয়ে যেত।