“মানবকেন্দ্রিক” দর্শন কথাটির অর্থ কি? মানুষের বুদ্ধি ছাড়া মানুষ বস্তুসত্ত্বাকে জানবে কি করে? যে জগৎটা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র, যার অস্তিত্ব মানুষের শুভাশুভ বিবেচনার উপর নির্ভর করে না তার রহস্য বুঝতে হ’লে কোন অতিমানবের কাছ থেকে মানুষ বুদ্ধি ধার করবে? অতীতের মৰ্কটকান্তি মানুষই এখন কাতিক-কান্তি হয়েছে সত্য, কিন্তু মৰ্কটের ধ্যানধারণা ধার করে মানুষের পক্ষে জগতের রহস্য ভেদ করা অসম্ভব। এ অর্থে তো সকল মতবাদই মানবকেন্দ্ৰিক, কারণ মানবীয় ভাবনা কেন্দ্রের বাহিরে গিয়ে মানবের পক্ষে কোন কিছু ভাবাই অসম্ভব। মানুষের বুদ্ধি দিয়েই “অ-মানুষে’র জ্ঞানলাভ করতে হয়- জ্ঞানের এই নীতি স্বতঃসিদ্ধ। একে অস্বীকার করলে বলতে হবে-পাথর জানতে চাইলে পাথর হতে হবে, এমিবার রহস্য জানতে চাইলে মানুষকে আগে এমিবা হতে হবে; নোড়ী কুকুরের ট্রাজেডি জানতে পারেন নি বলে যে কবিগুরু আক্ষেপ করেছেন তারও বোধহয় বলা উচিত ছিল—“হায়, আমি নোড়ী কুকুর হতে পারলাম না!” যদি ধরেও নেই যে পুরুষ বৈষ্ণবসাধককে যেমন গোপীপ্রেমের রহস্য বুঝতে গেলে গোপী হয়ে যেতে হয় মানুষকেও তেমনি এমিবা বা নেড়ীকুকুর হতে হবে, তাহলেও এই অ-মানুষ জীবের মর্মকথা কোনদিন প্ৰকাশ করা সম্ভব হবে না; কারণ প্ৰকাশ করবে তো মানুষ, তখন ত তাকে আবার মানবিক ভাবনারই আশ্রয় গ্ৰহণ করতে হবে।
কাজেই মানবিক ভাবনা দিয়েই মানবেতর বস্তু বা প্ৰাণীর কথা ভাবতে হবে, জানতে হবে-এ নীতি স্বতঃসিদ্ধ। এই স্বতঃসিদ্ধ নীতির সঙ্গে আরও একটি স্বতঃসিদ্ধ প্ৰতিজ্ঞা মেনে নিতে হবে।-“মানুষের ভাবনার বাহিরে একটা স্বতন্ত্র বস্তুজগৎ আছে বলেই মানুষ ভাবতে পারে।” বিশুদ্ধ দার্শনিক তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়ে উঠবেন-এ নীতি দুটো তো পরস্পর বিরোধী হয়ে গেল। বিরোধ হলে কি করব? এ বিরোধটাও তাহলে দুনিয়ারই নীতি। এই বিরোধকে অতিক্রম করে বিশুদ্ধ দার্শনিক একবার ভাববার চেষ্টা করে। দেখুন না। তিনি কিছুই ভাবতে পারবেন না। শূন্যবিহারিণী ভাবনা শূন্যেই মিলিয়ে যাবে। প্রথম কথা, সকল ভাবনার আশ্রয়স্বরূপ অন্ততঃ একটা মস্তিষ্করূপী বস্তু চাই যার অস্তিত্ব আমার চিন্তার উপর নির্ভর করছে না, অথচ আমার চিন্তাই যার অস্তিত্বের উপর প্রতিক্ষণ নির্ভর কয়ে চলেছে।
দ্বিতীয়তঃ, আমার জ্ঞানের বিষয় হিসাবে গাছপালা চেয়ারটেবিল মানুষটেবিল মানুষ ইত্যাদি স্বতন্ত্র সত্যবস্তুসমূহ রয়েছে যাদের সম্পর্কে আমি জানি, যারা আমার জ্ঞানকে আকার দেয়ম রূপ দেয়, অর্থ দেয়। না হলে বলতে হয় দর্শনের কোন বিষয় নেই, দার্শনিক মানুষও নেই, শুধু দর্শনটাই আছে। অথবা যে দেখে সে নেই, যা দিয়ে দেখে সেই চোখটাও নেই, যা দেখে সেই বস্তুটিও নেই-তৰু শুধু দেখাটাই আছে। এই তবে দার্শনিকের দর্শন, পরমার্থদর্শন। আধুনিক কালে এই পরমার্থ-দর্শন প্রচার করেই নাকি দর্শনশাস্ত্রে বিপ্লব আনা হয়েছে, যখন দ্রষ্টাই নেই দ্রষ্টব্যও নেই, বইগুলোও নেই, তখন এই শূন্যময়ী বিপ্লবের বাণী প্রচার করার প্রয়োজন কি? প্রয়োজন বোধহয় একটা আছে, তবে সেটা একটু বেশি পারমার্থিক। এই মৌলিক বিপ্লবের মূল্য হিসাবে মোটা মাইমেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোটা পদ অলঙ্কত করা যায়-এই মূল্যবোধটা সব চেয়ে বাস্তব, সর্বশ্রেষ্ঠ পরমার্থ। শূন্য ভাবনার প্রস্তুতির জন্য একদিকে প্রয়োজন কোটি টাকার মঠ, অন্যদিকে প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে বিশ্বের সরস্বতী আরামে লয় পেতে পারেন।
বলাবাহুল্য, এই অতি আধুনিক অথচ অতি পুরাতন বিপ্লবী দর্শনের উপর মার্কসীয় দর্শনের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। “মানুষ নামে একজাতের জীব আছে, মানুষের বাইরে বস্তুজগৎ একটা আছে, এবং মানুষ তার আপনি বুদ্ধির দ্বারা এই বস্তুজগৎকে জানতে পারে”-মার্কসবাদের মতে এই স্বতঃসিদ্ধ নীতিসূত্ৰকে গ্ৰহণ না করে এক পা এগোবার জো নেই। যারা এই নীতিসূত্ৰকে অস্বীকার করে তারা নয় উন্মাদ, নয় ভণ্ড, নয় বিভ্রান্ত। তারা মাকড়সার মত আপনার জালে আপনি আবদ্ধ, তাদের দর্শন মানবকেন্দ্ৰিক নয়, কিন্তু শূন্যকেন্দ্রিক। এই মূলনীতি স্বীকার করার জন্য মার্কসীয় দর্শন যদি “মানবকেন্দ্ৰিক” হয়ে থাকে, তাতে দুঃখের কিছু নেই।
“বিরোধ” কথাটার মার্কসীয় দর্শনে প্রচুর ব্যবহার দেখা যায়। প্রচলিত ন্যায়শান্ত্রেও এর ব্যবহার নিতান্ত অপ্রচুর নয়। তবু এর অর্থ সম্পর্কে এই দুয়ের ধারণা স্বতন্ত্র। আমরা বৃত্ত ও বর্গক্ষেত্রের সংজ্ঞা জানি। এই সংজ্ঞানুসারে আমাদের দুটি পৃথক পৃথক ধারণা আছে। “বৃত্তাকার বৰ্গক্ষেত্ৰ” বলামাত্র আমরা বলি এটা স্ববিরোধী কথা। এর কারণ আমাদের পক্ষে বৃত্তাকার বর্গক্ষেত্রের ধারণা করাই অসম্ভব। এ জাতীয় বিরোধ জ্ঞানকেই অসম্ভব করে তোলে। কিন্তু আমার ধরুন যোগ ও বিয়োগ, গুণ ও ভাগ-এখানেও যুগল ধারণার মধ্যে বিরোধ আছে। তবু চার সংখ্যাটিকে আমরা দুই আর দুইয়ের যোগফল হিসাবেও ভাবতে পারি। আবার ছয় থেকে দুই-এর বিয়োগফল হিসাবেও ভাবতে পারি। চৌদ্দকে সাত দিয়ে ভাগ করে দুই পাওয়া, আর সাত ও দুই-এ গুণ করে চৌদ্দ পাওয়া মূলত একই প্রক্রিয়ার দুইটি বিপরীত বৈশিষ্ট্য; এখানে কিন্তু বিপরীতের বিরোধ বৃত্তাকার বর্গক্ষেত্রের মত জ্ঞানের বন্ধ্যান্ত্বে পরিণত হয় না; বরঞ্চ সংখ্যার প্রকৃতি ও প্ৰক্ৰিয়া সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে আরও স্বচ্ছ ও গভীর করে তোলে। আবার দেখুন, বনের গাছটা মিস্ত্রীর হাতে পড়ে টেবিল হয়ে গেল। বিশুদ্ধ ন্যায়ের অনুরাগী দার্শনিকরা কি তুমুল তর্ক তুললেন, টেবিলটা গাছ কিনা, গাছটাই টেবিল কিনা? কিন্তু সাধারণ মানুষ জানে গাছ আর টেবিল এক নয়, অথচ একও বটে। এখানে এই বিরোধ ও সমন্বয়কে একই সাথে মেনে না নিলে গাছের টেবিলে পরিণত হওয়ার কথা ভাবাই যায় না। কোনও ন্যায়শাস্ত্রীকে সস্তুষ্ট করার জন্য সত্যকে বিকৃত করা সম্ভব নয়। জগতে প্ৰতিমুহূর্তে এক বস্তু আর একবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। একের ভিতরে বহু বিপরীতের সমন্বয় ও বিরোধ একই সঙ্গে স্বীকার করতে না পারলে প্ৰতিক্ষণের এই পরিণাম বা পরিবর্তনের ধারণাই করা যেত না। সুতরাং এখানে বস্তুর অন্তনিহিত বিরোধ বস্তুর স্বরূপ সম্পর্কে আমাদের সত্যদৃষ্টিকে আরও গভীর ও প্রসারিত করে।