কলেজ জীবনে দর্শনের অধ্যাপক যখন নিঃসঙ্কোচে শিখিয়ে চলতেন,- গ্ৰীসদেশে এপিকিউরাস নামে এক জডবাদী দার্শনিক ছিলেন যাঁর সার নীতি ছিল—খাও দাও স্ফূর্তি কর, Eat, drink, and be merry, তখন মুগ্ধ চিত্তে অধ্যাপকের পাণ্ডিত্য ও নীতিনিষ্ঠার তারিফ করেছি। আজ বড় হয়ে অনেকদিন পরে জানতে পেরেছি। এপিকিউরাস এমন কথা কোন দিন বলেন নি। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অপরিসীম কৃচ্ছসাধক, বাল্য আর যৌবন কেটেছে তার অন্তহীন দারিদ্র্যে। শুধু রুটি আর জল ছিল তার দৈনিক খাদ্য। তার উপরে একটু চীজ মিললে তিনি সেদিন ভোজের আনন্দ অনুভব করতেন। যে যুগে ঈশ্বর বিশ্বাসী জাদরেল দার্শনিক প্লেটো বা এরিস্টেটলের ঘরে শ” পাচেক ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসী না থাকলে দার্শনিক চিন্তায় অঙ্গসেবার আমেজ জমত না, সেইযুগে পরমাণুবাদী নিরীশ্বর এপিকিউরাস ক্রীতদাস প্রথাকে নৈতিক অপরাধ বলে ঘোষণা করেছিলেন। এই মিতাহারী মিতাচারী জড়বাদীর গৃহে ক্রীতদাসীরা ঠাই পেয়েছিল সাম্য স্নেহ ও সম্মানের ভূমিতে। এমনকি সমাজের অবজ্ঞাত উৎপীড়িত বারাঙ্গনদের পর্যন্ত বিত্তবানদের লালসা থেকে রক্ষা করার জন্য নিজের স্নেহস্নিগ্ধ গৃহে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এজন্য তার বিরুদ্ধে লালসাসিক্ত ধাৰ্মিকদের কুৎসার অন্ত ছিল না । ছাত্র ও শিষ্যদের অতি সামান্ত দানে কায়ক্লোশৈ তার দিন চলে যেতে। বিত্তশালী ক্ষমতাবান প্ৰভুদের অনুগ্রহের পরোয়া না করে মানুষের প্রতি সুস্নিগ্ধ ভালোবাসায় সমুজ্জল এই দরিদ্র দার্শনিক অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার ভিতর দিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে গেলেন। জুলিয়াস সিজারের সমকালীন বিখ্যাত লাতিন কবি লুক্রেসিয়াস এপিকিউরাসকে মানুষের রক্ষাকর্তা বলে স্মরণ করেছিলেন। এপিকিউরাসের দর্শনের কাব্যময় রূপ তিনি যে কবিতায় নিবদ্ধ করেছিলেন সেই বিখ্যাত কবিতা বহুযুগ ধরে ধাৰ্মিকশাসিত সমাজে অপাংক্তেয় ছিল। মধ্যযুগের পাদ্রীদের রোষবহ্নি থেকে একখানা মাত্ৰ পাণ্ডুলিপি কোনক্রমে রক্ষা পেয়েছিল। তাই লুক্রোসিয়াস বরাতের জোরে অমরত্ব লাভ করেছেন। লুক্রোসিয়াস যে শেলীর প্রিয় কবি হয়েছিলেন তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে? আমাদের দেশের ‘ধাৰ্মিক’ দার্শনিকরাও জড়বাদী চাৰ্বাকের যে কুৎসিত চিত্ৰ একেছেন তাতে এপিকিউরাসের নামে আরোপিত “eat, drink and be merry”-র নীতিকথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এপিকিউরাসের প্রায় তিনশত গ্ৰন্থই চিরকালের মত নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে। সামান্য দু-এক টুকরো লেখা মাত্র রক্ষা পেয়েছে। এপিকিউরাস ও লুক্রেসিয়াসের গ্রন্থভাগ্য আরও মনে করিয়ে দেয় যে চার্বাকের ভাগ্যের জোর বোধহয় আরও কম ছিল। যে সব “ধর্মপ্ৰাণ” দার্শনিকরা চাৰ্বাককে খণ্ডন না করে জলস্পর্শ করতেন না তাদের বা তাদের মুরুব্বিদের রোষানলে চার্বাক-দর্শনের সকল পাণ্ডুলিপিও হয়তো অক্ষয় সদগতি লাভ করেছে!
মার্কসীয় দর্শনের আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা যে এপিকিউরাসের প্রসঙ্গ মুখ-বন্ধ রূপে উত্থাপন করলাম তার তাৎপৰ্য বুঝতে পাঠকদের বোধ হয় বেগ পেতে হয়নি। মার্কসীয় দর্শনের বিরুদ্ধে ধৰ্মধ্বজীদের আক্রমণের লক্ষ্য মূলত তার তথাকখিত। “জড়বাদ” নয়। এই দর্শনের মর্মনিহিত মানবতাবাদই এ আক্রমণের লক্ষ্যস্থল। কিন্তু মানুষকে স্ব-মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার কাজে এ দর্শন এতখানি সাফল্য অর্জন করেছে এবং এই অনাস্বাদিত-পূর্ব সাফল্য সমগ্ৰ মানবসমাজে এত বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, মানুষের চিন্তাধারাকে এমন এক নূতন খাতে প্রবাহিত করেছে যে এই দর্শনকে নিছক ‘জড়বাদ” বলে আক্রমণ করলে চিন্তাশীল মানুষের সাধুবাদ আকর্ষণ করা সম্ভব নয়। যে দৰ্শন মানুষকে জড়পদাৰ্থ বলে মনে করে না, কিন্তু জড়পদার্থেয় উপর মানুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে, তার বিরুদ্ধে জড়বাদের কুৎসা আর কতদিন চালানো সম্ভব? কাজেই এখন ঠিক উল্টে দিক থেকে আক্রমণ চালানো দরকার হয়ে পড়েছে,–“মার্কসীয় দর্শন বড় বেশী মানবিক; কারণ মানুষের প্রয়োজনের কল্পনা দিয়ে সত্যকে সাজিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে।”
অবশ্য রাসেল কোন কুটিল অভিপ্ৰায় নিয়ে এ আপত্তি তোলেন নি। তাঁর মতে মানুষের শুভাশুভ বিচার নৈতিক দর্শনের সমস্যা, আর জাগতিক সত্য সত্যের বিচার মানবকল্যাণ-নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ দর্শনের সমস্যা। মার্কসবাদ এদুটাকে মিশিয়ে একাকার করে ফেলেছে। আমরা বিচার করব মার্কসবাদের বিরুদ্ধে রাসেল যে মৌলিক আপত্তি তুলেছেন তার বাস্তবিকই কোন ভিত্তি আছে কি না। কোন মার্কসবাদী কি এমন কথা কোনদিন বলেছেন। যে বস্তুজগতের সত্যাসত্য নির্ধারণ করা হবে মানুষের ভালমন্দের নিরিখে? রাসেলের মতে তা হলে মার্কসবাদও < এক ধরনের Pragmatic মতবাদ। একাধিক জায়গায় রাসেল বলেছেন যে আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির ফলে বিশ্বাসত্যের তুলনায় মানব-সত্যের মর্যাদা অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে। নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রতিষ্ঠা মানুষের আত্মবলিয়কে সংকুচিত করেছে, “সবার উপরে মানুষ সত্য” এই আত্মপ্রসন্ন বিদগ্ধবাণীর ব্যর্থতা প্রমাণ করেছে, বস্তুজগতের তুলনায় মানুষের নগণ্যতাকে প্রকটিত করার মারফত তার স্বাতন্ত্র্যের গৌরব খর্ব করে দিয়েছে।
আমরা আগেই দেখেছি রাসেলের নিজের ঘাড়ে বার্কলি ও হিউমের প্ৰেতাত্মা এখনও ভর করে আছে, তার দার্শনিক যুক্তি অনুসারে ব্ৰহ্মাণ্ডটাই মানুষের মগজের ভিতরে ঢুকে গিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে, এবং সে মগজটাও যে আছে এমন কোন নিশ্চিত প্ৰমাণ পাওয়া দুষ্কর। রাসেলের নিজস্ব দর্শন আত্মকেন্দ্ৰিক নয়, কারণ আত্মা বলে কিছু নেই; মানবকেন্দ্ৰিক নয়, কারণ মানব বলে কিছু নেই এবং বস্তুতান্ত্রিক নয় কারণ বস্তু বলে কিছু নেই। অনুমেয় সত্য এই বহির্জগৎটাও আনুমানিক অনুভূতিতে সীমাবদ্ধ। এই নিরালম্ব অনুভূতির ভৌতিক দীর্ঘনিঃশ্বাসকে এখন তিনি মার্কসের নাসিকাপ্রসূত বলে অনুভব করছেন। আবার অন্ধকার শ্মশানে অনেক সাহসী লোকও অনেক সমর্থ নিজের নিঃশ্বাসকে ভূতের নিঃশ্বাস বলে অনুভব করে।