এখানে কিন্তু যে বস্তুবাদী জ্ঞানসূত্র থেকে রাসেল তার সর্বাধুনিক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গীটি আমাদের কাছে খুলে ধরবেন বলে আশা সৃষ্টি করেছিলেন সেই সূত্র থেকে তিনি বিচ্যুত হয়েছেন। কি করে জানি এটাই তাঁর কাছে শেষ সিদ্ধান্তে বড় হয়ে উঠেছে। জগৎটা প্ৰত্যক্ষ সত্য নয়, কিন্তু অনুমেয় সত্য—এটা নুনাধিক দুই হাজার বছর আগেকার সৌত্ৰিাস্তিক বৌদ্ধদের মত। কিন্তু যে যুক্তিতে প্ৰত্যক্ষ সত্যকে নিরসন করা হয়েছে সেই একই যুক্তিতে অনুমেয় সত্যকেও নিরাশ হতে হবে। মস্তিষ্কের স্নায়ুকেন্দ্রের কম্পনগুলির বাইরে আর কোনও কিছুই প্রত্যক্ষ নয় একথা মেনে নিলে অনুমানেরও নিস্তার নেই; কারণ অনুমানটাও তো মস্তিষ্কেরই একপ্রকার প্রক্রিয়া। সুতরাং এই প্রক্রিয়ার বাইরে অনুমেয় বহিঃসত্য বলে কিছু যে আছে তা জানার কোনও উপায় নেই। মস্তিষ্কের প্রক্রিয়া দিয়েই যদি জগতের সকল সত্যাসত্য ব্যাখ্যা করতে হয় তবে অনুমান ও বলে কিছু যে আছে তা জানার কোনও উপায় নেই। মন্তিকের প্রক্রিয়া দিয়েই যদি জগতের সকল সত্যাসত্য ব্যাখ্যা করতে হয় তবে অনুমান ও প্ৰত্যক্ষের ভিতরে কোনও তফাত করা দুঃসাধ্য। এ হিসাবে অনুমানটাও এক রকমের প্রত্যক্ষ । প্ৰত্যক্ষের বেলাও যেমন স্নায়বিক উত্তেজনার বাইরে কোনও স্বতন্ত্র উত্তেজক বহিঃপদার্থ আমাদের গোচরীভূত নয় ; অনুমানের বেলাতেও মস্তিষ্কাস্থিত আনুমানিক কাৰ্যকলাপের বাইরে আর কিছু অনুভব করছি এমন কথা বলা চলে না । যদি বলা যায়, কোনও উদ্দীপক বহিঃপদার্থ না থাকলে উদ্দীপনা সৃষ্টি করিল কে, তাই বহির্বিশ্ব কিছু আছে ; এর উত্তরও পরিষ্কার,- এই যুক্তিটা যে দেয়া হল এত মাথারই একটা কাজ। কাজেই মাথার বাইরের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানো অসম্ভব। সৌত্ৰিান্তিক দর্শনের বিরুদ্ধে এই দুর্লঙ্ঘ্য যুক্তি উপস্থিত করলেন প্রজ্ঞাকর গুপ্ত। ধর্মকীতির শ্রেষ্ঠ কীতি। “প্ৰমাণবাতিকে”র অপ্ৰতিদ্বন্দ্বী ভাষ্যকার প্রজ্ঞাকর গুপ্ত এইযুক্তি উপস্থিত করলেন বিজ্ঞানবাদীর তরফ থেকে। তথাপি এর ভিতর দিয়ে সৌত্ৰিান্তিক মতের গুরুতর দুর্বলতা ধরা পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বাট্ৰাণ্ড রাসেলের সর্বাধুনিক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গীর দুর্বল স্থানটিও বারোশিত বছর আগেকার প্রজ্ঞাকির দেখিয়ে দিলেন ।
এর সঙ্গে রাসেল বাণিত মগজ পরীক্ষার বিশ্লেষণ পদ্ধতিটিও মিলিয়ে দেখুন। আখেরে গিয়ে কি অবস্থা দাঁড়ায়। আমার ইন্দ্ৰিয়সমূহ, আমার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, আমার দেহের রক্তের জোয়ার, আমার স্নায়ুজাল ও মস্তিষ্ক কোনও কিছুই আমার প্রত্যক্ষ নয় ; একমাত্ৰ প্ৰত্যক্ষকতগুলি শূন্যে ভাসমান অনুভূতি। রাসেলের যুক্তিতে মস্তিষ্ক ও স্নায়ু কেন্দ্রের কম্পনগুলিও অনুমান মাত্র। সুতরাং রাসেল যখন বললেন আমরা যা কিছু দেখি শুনি সবই আমাদের মাথার ভিতরে তখনও তিনি ঠিক কথা বলেন নি। কারণ ঐ কথার কয়েক পংক্তি আগেই তিনি বলেছেন, আমার মাথাটা আমিও দেখি না অন্যেও দেখে না। তার উপরে “আমি তুমি” এগুলোও কথার কথা। দেকার্তে অন্ততঃ একটা ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিলেন—“আমি যে আছি এ বিষয়ে আমার সংশয় নেই।” এখন কিন্তু ব্যকরণের প্রথম মধ্যম উত্তর এই তিন পুরুষই ভিটেছাড়া হ’ল। বস্তুহীন মহাশূন্যে পরস্পর বিসংলগ্ন কতকগুলি অনুভূতির কণিকা ভেসে বেড়াচ্ছে, সেগুলির কোন মালিকানা নেই, কারণ তারা কারুর নয়। কারণ আর কেউ বলে কিছু নেই। দর্শনের এই “অ-পৌরুষেয়তা” আধুনিক পাশ্চাত্ত্য দর্শনে পুরুষত্বহীনতায় পৰ্যবসিত হয়েছে।।
রাসেল এতটা চরম সিদ্ধান্ত করেন নি, কিন্তু তার যুক্তি অনুসরণ করলে এ পর্যন্ত যেতে হয়। বস্তুজগতের উপর রাসেল যে নিঃসন্দিগ্ধ বিশ্বাস পোষণ করেন বলে ঘোষণা করেছেন, সে বিশ্বাসটা ঠিক তার দার্শনিক বিশ্বাস নয়, ওটা একটা সহজাত মানবিক বিশ্বাস যার সঙ্গে তার দার্শনিক যুক্তির সামঞ্জস্য নেই। মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও তিনি অনপনেয়। আশা (incurable optimism) পোষণ করেন। যদিও তার বিশুদ্ধ দর্শনের যুক্তি অনুসারে তুচ্ছ মানুষ থাকল বা গেল তাতে বিশ্বের কিছু আসে যায় না।
রাসেল “মানবকেন্দ্ৰিক” মার্কসীয় দর্শনের দুর্বলতা দেখতে পেয়েছেন, কিন্তু তাঁর নিজস্ব ‘বিশ্ব গ্রাসী।” দর্শন বিশ্ব-পরিক্রম শেষ করে অবশেষে অনুভূতি-সর্বস্বতায় বিশ্রান্তি লাভ করেছে। বহি:সত্য অনুমেয় মাত্ৰ— এই “সৌত্ৰিান্তিক” সত্যের সূত্র ধারণ করে তিনি “যোগাচারী বিজ্ঞানবাদে।” এসে পৌঁছেছেন। যোগাচার-বৌদ্ধমতে একমাত্র স্বানুভূতি বা স্ব-সংবেদনই প্ৰত্যক্ষ সত্য; অনুমিতি ও স্ব-সংবেদনেরই প্ৰকারভেদ মাত্র। বহির্বিশ্বের অস্তিত্বের প্ৰতি পরিনিষ্ঠিত বিশ্বাসটাও এক ধরনের অনুভূতি। এই বিশ্বাস-বিধৃত বিপুল ব্ৰহ্মাণ্ডটা আমার জ্ঞান-কাণ্ডেরই একটা অংশমাত্র। একদিন তিনি একথাই বলতেন। আজ তিনি বলুন আর নাই বলুন তার সকল যুক্তি ও দৃষ্টান্তের গতি ও প্রকৃতি আজও এই একই সিদ্ধান্তে আমাদের টেনে নিয়ে যায়।
।।সাত।।
যে ‘মানবকেন্দ্ৰিক” মার্কসীয় দর্শন রাসেলের দার্শনিক প্ৰজ্ঞাকে পীড়িত করেছেন তার “মানকেন্দ্রিকতা” কি ধরনের সে বিষয়ে আমাদের বিচার করা প্রয়োজন। একদিন মার্কসীয় দর্শনের বিরুদ্ধে ধাৰ্মিক মহলের প্রধান আপত্তি ছিল যে এ দর্শন ন্যাক্কারজনীক জড়বাদের নির্লজ চারণকাব্য। বিশ্ববিদ্যার আড়তগুলিতে যে আড়তদাররা সারস্বত শয্যা পেতে রেখেছিলেন তাঁরা এ দর্শনের কলুষিত স্পর্শ থেকে দেবী সরস্বতীকে শত হস্ত দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু সে যুগ আজ পাল্টে গেছে। এই “জড়বাদী” দর্শন যে দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রতিফলিত হয়ে বিশ্ববাসীর বিমুগ্ধ বিস্ময় ও বিপুল বিশ্বাস উৎপাদন করেছে সে দেশ আজ পৃথিবীর সারস্বত তীর্থ। মস্কো এখন আর কেবল কমিউনিস্টদের “মক্কা’’ নয়। বরঞ্চ এই মক্কায় এখন অকমিউনিস্টদের আনাগোনাটাই বেশী করে চোখে পডে। এমনকি পৃথিবীর অনেক কমিউনিস্ট-বিরোধীও এই “জডবাদের” তীর্থভূমির অকৃপণ প্ৰসাদ পেয়ে পরিপুষ্ট লাভ করছে। এ কথাও আজ অনেকেরই জানা হয়ে গেছে যে এই “জড়-দর্শনের” উপাসকবৃন্দ যখন সকল পার্থিব ভোগবিলাস উপেক্ষা করে মানুষকে মানুষের মত বাঁচাবার জন্য কৃচ্ছ্র-কঠোর জীবন বরণ করে নিয়েছিলেন তখন ধৰ্মরাজের বরপুত্ৰগণ বিত্তবানদের কাঞ্চন-প্ৰসাদের প্ৰত্যাশায় জড়বাদের মুণ্ডপাত করার ব্ৰত ধারণ করেছিলেন।