ভাষা মানুষের যৌথ সমাজ-জীবনের সব চেয়ে সার্থক অভিব্যক্তি। ভাষা ছাড়া সমাজ এক মুহূর্তে অচল হয়ে যেত, দণ্ডী বলেন-জগত অন্ধকারে ডুবে যেত। ভাষা ও অর্থের এই পূর্ণতাগ্রাহী অনুভূতি সমগ্রতাসন্ধানী মানব মোহ পাঠককে আচ্ছন্ন করে রাখে, কিন্তু তবু এহেন শক্তিধর কবির বিখ্যাত কবিতা ‘হাওয়ার রাতে’র কয়েকটি পঙক্তি নেয়া যাক–
জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার
শালের মতো জ্বলজ্বল করছিলো বিশাল আকাশ!
কাল এমন আশ্চর্য্য রাত ছিল।
আশ্চৰ্য্য রাতের বিশাল আকাশের জলজলে চিত্র আঁকতে গিয়ে বেবিলনের রাণীর ঘাড়টাকে চিতার চামড়ায় জড়িয়ে নিরীহ পাঠকের বুদ্ধিকে চিতায় চড়াবার কি খুবই প্রয়োজন ছিল?
অতি আধুনিক কবি এরকম বাড়াবাড়ি করেন না, তবে যেদিকে তারা বাড়াবাড়ি করেন তার চেয়ে জীবানানন্দের এই বাড়াবাড়ি অনেক বেশী সহনীয়। আধুনিক কবি যখন কবিতার মধ্যে সোজাসুজি উচ্চাঙ্গ গণিতের কয়েকটি ফরমুলা বসিয়ে দেন :
… বলা যাবে মিলিয়নে, বিলিয়নে…ইত্যাদি ইত্যাদি
তিনগুণ দশের শক্তি চুয়াত্তর হলে যত পরমাণু ধরে
তাদের বিভাগ্য শক্তি, ক্ষমতায়, যা কেবল শুধু E = MC²-এর সীমা জানে,…
তখন ব্যাপারটা খুবই ভয়াবহ হয়ে ওঠে। সত্যিই গণিত হলে মা সরস্বতী চমকাবেন না, কারণ তিনি গণিত-বিদ্যার ও দেবতা। কিন্তু গণিতও নয় কবিতা ও নয়–এ কেমন রূপ? এতো মা সরস্বতীর শ্রাদ্ধের মন্ত্র!
বাংলা উপন্যাসের মেদ বাহুল্য কমিয়ে দিয়ে, বাংলা কবিতায় বাণভট্ট ও রবীন্দ্ৰনাথের অতিশয়োক্তিকে ফিরিয়ে আনলে সরস্বতী বোধ হয় আমাদের মত ইতরজনের ঘরে আবার বেঁচে উঠবেন।
দার্শনিক হিরাক্লিটাস
[বিশ্বশান্তি সংসদ ১৯৬১ সালে যে সমস্ত জয়ন্তী পালনের আহ্বান জানিয়েছিলেন তার মধ্যে গ্রীক বস্তুবাদী দার্শনিক হিরাক্লিাটাস অন্যতম। তাঁহার ঐ সাৰ্দ্ধদ্বিসহস্রতম জন্মবার্ষিকী এই বিশেষ প্ৰবন্ধটি আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।]
বিশ্ববৈচিত্র্যের ব্যাখ্যানপদ্ধতিতে ‘দ্বন্দ্ব-সূত্রের প্রথম প্রবক্তা হিরাক্লিটাস ছিলেন গ্রাকদর্শনের প্রভাতীযুগের দার্শনিক। থেলিস থেকে হিরাক্লিন্টাস পৰ্য্যন্ত আনুমানিক ৬২৫-৪৭৫ খ্ৰীঃপূর্বাব্দ-ব্যাপী গ্রীকদর্শনের আদিপর্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বলিষ্ঠ বস্তুতান্ত্রিকতা। অবশ্য গ্রীকদর্শনের প্রামাণিক ইতিহাস-গ্রন্থগুলিতে প্রথম যুগের সীমারেখা টানা হয়ে থাকে লিউকিপ্লাস বা ডিমোক্রিটাস পৰ্যন্ত (বাৰ্ণেট ও য়্যুবারবেগ)। এ যুগবিভাগের নিশ্চয়ই একটা সংগত কারণ আছে। লিউকিপ্লাস ছিলেন কণাদ-কল্প দার্শনিকঅর্থাৎ পাশ্চাত্য চিন্তাজগতে পরমাণুবাদের প্রথম সূত্রকার। ডিমোক্রিটাস এই পরমাণুবাদের পরিপূর্ণ রূপকার। এরিষ্টেটলের মেটাফিজিক্স” অনুসারে ইনি বোধহয় ছিলেন প্ৰবীণ লিউকিপ্লাসের ঘনিষ্ঠ শিস্য ও সহকর্মী। পরমাণুবাদ বস্তুবাদের একটি সুনিশ্চিত গুরুত্বপূর্ণ বিকাশধারা। আদি পরমাণুবাদের পরের যুগটি প্রধানতঃ প্লেটো-এরিষ্টেটলের যুগ। এই দুই যুগের সন্ধিকাল পূর্ণ করেছেন প্রোটাগোরাস ও তার সোফিষ্ট সম্প্রদায় এবং স্বয়ং সক্রেটিস।
ডিমোক্রিটাস ছিলেন থেসের অধিবাসী, সোফিষ্টদের ও সক্রেটিসের সমসাময়িক। এথেন্সে তিনি একবার এসেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর ভাগ্যে জুটেছিল অপরিচয়ের অবজ্ঞা। খাস গ্রীসের শিক্ষাসংস্কারের মধ্যেও বোধহয় র্তার দার্শনিক প্রতিভাকে অঙ্গীকার করার মত উপযুক্ত প্ৰস্তুতি তখন ছিল না। পরবর্তীকালে প্লেটো তার দুর্ধর্ষ বস্তুবাদ বরদাস্ত করতে পারেননি, তাই মনে হয়, ঘৃণায় তাঁর নামটা পর্য্যন্ত উল্লেখ করেন নি, তাঁর গ্রন্থগুলি আগুনে সৎকার করার সৎবাসনা প্ৰকাশ করেছিলেন বলেও শোনা যায়। কিন্তু প্লেটোর কল্পলোকবিহারী উত্তঙ্গ দর্শনের অনস্বীকাৰ্য্য প্রভাব সত্ত্বেও গ্রীকদের বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিক প্রতিভাকে বিন্দুমাত্র স্নান করা সম্ভব হয়নি। এরিষ্টেটলের সর্বতোমুখী বিস্ময়কর মনীষা অন্ততঃ প্লেটোর “ভাব-নগরের” (World of ldeas) বিশুদ্ধ নাগরিকদের বিশেষ সন্মান দেখাতে রাজী হয়নি। এরিষ্টোটলের পরে আর একজন মহান মনীষী ইপিকিউরিয়াস ডিধোক্রিটাসের পরমাণুবাদকে পূৰ্বগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করেন, সঙ্গে সঙ্গে নিৰ্ভীক মানবিকতার আবেদন-সংবাহী এক সুনিয়ন্ত্রিত নীতিশাস্ত্র প্রবর্তন করেন। আর এক দিকে, প্ৰাচীন পিথাগোরাস যে বিশুদ্ধ ‘গণিত’শাস্ত্র প্রবর্তন কবে ছিলেন তারই ধারা ধারণ করে গণিতবিজ্ঞান নব নব শাখায় বিকাশ লাভ করে এবং বিশুদ্ধ ও ফলিত বিজ্ঞানের বহুক্ষেত্রে বস্তুমুখী গ্ৰীক প্রতিভা সুদূরপ্রসারী সাফল্য অর্জন করে।
কিন্তু ডিমোক্রিটাসের পরে গ্রাকদর্শনে বস্তুবাদী চিন্তাধারায় সাময়িক ছেদ ঘটেছিল বলেই, এবং বস্তুবিমুখ বিশুদ্ধ ভাববাদী দর্শনের চূড়ামণি প্লেটোর শাণিত তর্ক-তরবারির আঘাতেই প্ৰধানতঃ এই ছেদ ঘটানে| সম্ভব হয়েছিল বলেই দর্শনশাস্ত্রের ইতিহাসে থেলিস থেকে ডিমোক্রিটাস পৰ্য্যন্ত নৃত্যুনাধিক আড়াইশ বছরের এই কালখণ্ডকে গ্রীক দর্শনের প্রথম পৰ্য্যায় বলে চিহ্নিত করা মোটেই অসংগত নয়। স্বয়ং এরিষ্টোটল এই যুগবিভাগের সাক্ষী। তথাপি থেলিস থেকে হিরাক্লিাটাস পৰ্য্যন্ত আনুমানিক দেড়শ বছরের একটা অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। কারণ, হিরাক্লিাটাস ছিলেন গ্রীকদর্শনে বস্তুবাদী ডায়লেক্টিক্সের শীর্ষবিন্দু। আর থেলিস ছিলেন। পুরাকল্পকাহিনীর অযত্নসিদ্ধ স্থূল বস্তুতন্ত্র থেকে মননশীল বস্তুবাদে উত্তরণের প্রথম সোপানভূমি। নিরন্তর দ্বান্দ্ৰিক গতিবাদী হিরাক্লিটাসের পর যে প্রধান পুরুষ দর্শনের দরবারে অবতীর্ণ হলেন তার নাম পারমেনাইডিস। তিনি প্রচার করলেন এক গতিহীন নিষ্কম্প অদ্বৈততত্ত্ব-গতি মিথ্যা, বহু মিথ্যা, দ্বন্দ্ব মিথ্যা, এক শ্বাশত স্থিতিশীল অখণ্ডসত্তাই একমাত্ৰ সত্য। গ্রীকদর্শনে হিরাক্লিাটাস পৰ্য্যন্ত প্ৰবাহিত বস্তুবাদী মননধারার পর পারমেনাইডিস হলেন সর্বপ্রথম বিপরীত ব্যতিক্রম। এ ব্যতিক্রম সম্পূর্ণ, কিন্তু সাময়িক। পারমেনাইডিসের জীবন শেষ না হতেই সিসিলি দ্বীপের আক্রাগাস অধিবাসী, তৎকালীন গণতান্ত্রিক শিবিরের বিশিষ্ট নেতা এমপিডোক্লিাস গ্রীক চিন্তাধারায় বস্তুতান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রত্যাবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্ৰহণ করেন। রহস্যবাদী পিথাগোরীয় ধর্মমতের প্রভাব থেকে মুক্ত না হলেও বিশ্ববীক্ষণ পদ্ধতিতে হিরাক্লিন্টীয় দর্শনের গভীর বস্তুদৃষ্টি এমপিডেক্লিসের দার্শনিক মতকে সংগঠিত করতে সাহায্য করেছিল। তাছাড়াও এরিষ্টেটলের মতে ইনি ছিলেন অলঙ্কার শাস্ত্রের প্রবর্তক এবং “গেলেনে”র মতে ইনি ছিলেন ইতালীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা। তথাপি বস্তুবাদী চিন্তাধারায় পারমেনাইডিস সর্বপ্রথম একটি বিশিষ্ট ও পরিপূর্ণ ব্যতিক্রম এ কথা চিন্তা করে থেলিস-হিরাক্লিাটাস যুগটিকে গ্ৰীক দর্শনের আদিপর্ব বলে চিহ্নিত করাই যুক্তিসংগত। “The Earlier lonic Natural Philosphy’ যুবারবেগের এই নামকরণ যথার্থ। এ নামকরণের বিশেষ তাৎপৰ্য্য হ’ল এই যে বিশ্বপ্ৰকৃতির বস্তুতান্ত্রিক বীক্ষণ ও ব্যাখ্যান প্রচেষ্টাতেই দর্শনের আদি অভ্যুদয়। বলা বহুল্য আদিপর্বের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী মূলতঃ বস্তুমুখী ও বিজ্ঞানমুখী হলেও প্রাথমিক অনুসন্ধিৎসার সময়ে চিন্তানায়কদের চিন্তাধারার মধ্যে কিছু পরিমাণে অকপট অবৈজ্ঞানিক স্থূলতা অপরিহাৰ্য্য।