আবার দেখুন-কেউ যদি এ জাতীয় অনুমান করেন— বড় বড় কাজ করতে অনেক কারিগর দরকার হয়, যেমন দালান বাড়ি নগরী তৈরী করতে অনেক মিস্ত্রী প্রয়োজন। সুতরাং বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের মত একটা বিরাট ব্যাপার ঘটাতে অন্তত কয়েক কোটি ক্ষুদে ঈশ্বরের দরকার হয়েছে। এক ঈশ্বর কল্পনা করলে আপনার কল্পনার লাঘব হলেও ব্ৰহ্মাণ্ড সৃষ্টির গৌরবটা তার প্রাপ্য নয়।
আবার ধরুন, কেউ বললেন—বিচিত্র রচনাময় দালাল কোঠা ঘর বাড়ি আমাদের মত মানুষের তৈরী, সুতরাং বিচিত্র জগৎটাও আমাদের মত আরো। অনেক মানুষ মিলে তৈরী করেছে।
যদি বলা হয় বিপুল বিশ্ব মানুষের পক্ষে তৈরী করা সম্ভব নয়, তা হলে উন্ট অনুমান করাটা আরও সহজ-বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ড কোন সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেনি, কারণ মানুষের পক্ষে এ সৃষ্টি সম্ভব নয়, এবং আমাদের সামগ্রিক অভিজ্ঞতায় মানুষ ছাড়া কোনও স্রষ্টাও আর চোখে পড়েনি (অবশ্য মৌমাছি বোলতা ইত্যাদি কিছু কীট পতঙ্গ ছাড়া)।
এভাবে পরমসত্যের চরম বিভ্রান্তি হিসাবে পরমেশ্বরকে মেনে নিয়ে সত্যানুসন্ধ্যানী নিষ্কণ্টক হতে পারেন না। পদে পদে তিনি তর্কের জালে জড়িয়ে পড়বেন। আমাদের দেশের বৈষ্ণব দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ তার্কিক মাধ্ববৈদান্তিকরাও শেষ পর্যন্ত নৈয়ায়িকদের ঈশ্বরানুমানে ঘোরতর আপত্তি তুলেছেন। নব্যন্যায়ের জনক গঙ্গেশোপাধ্যায়ের ঈশ্বরবাদ খণ্ডন করে ব্যাসতীর্থ সিদ্ধান্ত করলেন-আনুমানিক যুক্তিতর্কের দ্বারা ঈশ্বরের প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। শাস্ত্রবাক্যে বিশ্বাসের উপরেই ঈশ্বর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ—বিশ্বাসে মিলায় কৃষ্ণ, তর্কে বহুদূর।
কিন্তু অবিশ্বাসীর গতি নরক হলেও ইহালোকে ঈশ্বরের গতি খুব নিষ্কণ্টক হল না। তাই একদল দার্শনিক সত্যাসত্যনির্ণয়ের দ্বিতীয় রাজপথটি বেছে নিলেন—এটিকে এক জাতীয় শূন্যমাৰ্গ বলা যেতে পারে। তারা বললেন-শেষ পর্যন্ত আমরা এই নির্ণয় করলাম,–কিছুই নির্ণয় করার উপায় নেই। কিছুই জানা যায় না-এই হল সার সত্য। আমাদের ইন্দ্ৰিয়লব্ধ অভিজ্ঞতার চপলমুহুর্তগুলি মিছিল করে চলেছে, ঐ চপল মুহুর্তগুলি সম্পর্কেই একমাত্র আমরা নিঃসংশয় হতে পারি। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে কোন বস্তুসত্তা আছে কি নেই, বস্তুজগতের কোনও ঘটনা আমাদের অভিজ্ঞতাগুলিকে উদ্বোধিত করছে কিনা, সে কথা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। একথাগুলি যিনি বলছেন তিনি নেই, কথাগুলোও নেই, কোন শ্রোতা নেই, পাঠক নেই, কথায় ঠাসা বইগুলোও নেই, অন্তত এসব আছে বলে কোন নিশ্চিত প্ৰমাণ নেই। তাহলে আর এ অমূল্য কথাগুলো বলার জন্য, লেখার জন্য এত পরিশ্রমেরই বা কি দরকার ছিল?
।।ছয়।।
যে বাট্ৰাণ্ড রাসেল “মানবকেন্দ্ৰিক” মার্ক্সীয় দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গীতে আপত্তি জানিয়েছেন তার নিজের নিরালম্ব দর্শন একসময় কতদূর পর্যন্ত এগিয়েছিলেন তাও একটু ভেবে দেখা দরকার। একসময় “মনোবিকলনের” ( ‘Analysis of Mind’ ) ভিত্তিতে তিনি এতদূর পর্যন্ত এগিয়েছিলেন যে মানুষের মগজ বলে কিছু আছে কিনা সে সম্পর্কেই সন্দেহ জাগে। আমি আমার মগজটা দেখতে পাই না । কোনও শরীরতত্ত্ববিদ বা Physiologist আমার মাথার খুলিটা ভেঙে আমার মগজ দেখার চেষ্টা করতে পারেন । কিন্তু তখনও তিনি আমার মগজ দেখতে পাবেন না। তার চক্ষুরিভিদ্ৰয়ের ভিতর দিয়ে আমার মগজের ছবি তার মগজে যে কম্পন জাগাবে তিনি তাই শুধু অনুভব করতে পারবেন। এর বেশী তার কিছু জানিবার কথা নয়। অথচ তিনিও তো তঁর নিজের মগজটা দেখতে পারেন না । মগজের এই মজা দেখে ওটাও যে আছে সেকথা নিশ্চয় করে বলার জো নেই। কিন্তু তার চেয়েও মজার কথা আজ নব্বই বছরের বৃদ্ধ এই প্ৰতিভাশালী দার্শনিক পরমাণু বোমার আঘাতে ব্ৰহ্মাণ্ডের মানুষের জীবন যাতে লণ্ডভণ্ড না হয়। সেজন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও কুষ্ঠিত নন। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়েও যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তিবাদী আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য বিনা দ্বিধায় তিনি বিলাতের জেল খেটেছিলেন । “বিশুদ্ধ দর্শনের’ পক্ষ থেকে “মানব-কেন্দ্ৰিক” দর্শনের বিরুদ্ধে যিনি মৌলিক আপত্তি জানিয়েছেন জীবনের প্রান্তিক সন্ধ্যায় উত্তীর্ণ সেই দার্শনিকের সুনিবিড় মানবপ্ৰেম আজ মানুষের অকৃপণ শ্রদ্ধা ও সন্ত্ৰম আকর্ষণ করেছে।
তথাপি তার মূল দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গীর শেষ পরিণতি হিসাবে ১৯৫৯ সালেও যে ঘোষণা তিনি করেছেন তার ভিতরেও একথা স্পষ্ট যে বার্কলি ও হিউমের ভুত তার ঘাড় থেকে এখনো নামেনি। এখন তিনি অবশ্য আপন অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ একটা বহির্বিশ্বের অস্তিত্বের উপর নিঃসংশয় বিশ্বাসের কথা ঘোষণা করেছেন । তাহলেও শেষরক্ষা যে করতে পারেন নি তার প্রমাণটাও স্পষ্টভাবে তাঁর কথার মধ্যে ধরা পড়েছে। “জগত সম্পর্কে আমার বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গী” বলতে গিয়ে তিনি একটি মূল্যবান নীতিসূত্রের অবতারণা করেছেন যা বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর সগোত্র। “দার্শনিকরা সাধারণতঃ, কি করে আমরা জানি,-জ্ঞানলাভের এই পদ্ধতি থেকে শুরু করে, মুমরা কি জানি, সে সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার চেষ্টা করছেন। আমি মনে করি এ দৃষ্টিভঙ্গীটা ভুল। কারণ কি করে আমরা জানি তা আমরা যা জানি তারই একটা ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র।” এ কথাটি এইজন্য মূল্যবান যে আমাদের জ্ঞান-নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র বস্তুজগতের অস্তিত্ব মেনে না নিলে আমরা কি করে জানি তাও জানতে পারি না। কিন্তু মানুষের মগজের উদাহরণ থেকে তিনি আগে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে চেয়েছিলেন তার ছাপ এখনও তাঁর মগজে আঁকা আছে -“আপনি যে মগজটার দিকে তাকিয়ে আছেন সেটা নিঃসংশয়ে বস্তুজগতেই অংশ, কিন্তু এই বাস্তব মগজটা আপনার জ্ঞানের বিষয় নয়। … আমি একথাই বলতে চাই, আমরা কেবল আমাদের নিজেদের মাথার ভিতরে যা ঘটছে। তাই দেখতে পারি, অনুভব করতে পারি। তার বাইরে আর কোন কিছুই দেখতে বা অনুধাবন করতে পারিনা … গাণিতিক পদার্থবিদ্যার পদার্থগুলি কোন বাস্তব পদার্থ নয়, ওগুলি গণিতবিদের সুবিধার জন্য কতগুলি ঘটনাকে মিলিয়ে নিয়ে তৈরী করা বুদ্ধিগত কল্পনামাত্র। দ্বিতীয়তঃ, অনুমানের মাধ্যম ছাড়া আমরা যা কিছু জানি তা সবই আমাদের ব্যক্তিজগতের ব্যাপারমাত্র। এবিষয়ে আমি বার্কলির সঙ্গে একমত। চাক্ষুষ অভিজ্ঞতায় যে তারাভরা আকাশটাকে আমরা জানি সে আকাশ আমাদের অন্তরে। বাহিরের আকাশটা আমরা অনুমান করি। তৃতীয়তঃ যে কাৰ্যকারণ-ধারার মারফত আমরা বিচিত্র ও বিভিন্ন ধরনের বস্তুকে জানতে পারি, সেই ধারাগুলিও মরুভূমিতে নদীর মত মিলিয়ে যায়।” (My Philosophical Development-My Present View of the World)