এখন তাহলে “কাৰ্যমাত্রেরই কর্তা আছে।” এই সাধারণ সূত্রটিরও একটু সংকোচ সাধন করা প্রয়োজন হতে পারে। মানুষের বহুযুগব্যাপী অভিজ্ঞতার ফলে কোনটা প্ৰাকৃতিক জিনিস আর কোনটা কৃত্রিম অর্থাৎ কোনও প্ৰাণী বা মানুষের তৈরী, এবিষয়ে একটা ধারণা হয়েছে, যার ফলে চেয়ার টেবিল দেখামাত্র বলতে পারা যায় যে কোনও মিস্ত্রী এগুলি তৈরী করেছে। তাই চোয়ারটা ভেঙ্গে গেলে আমরা মিস্ত্রী ডেকে মেরামত করাই, পরমেশ্বরকে ডাকি না। সুতরাং কাৰ্যমাত্রেরই কর্তা আছে এই সাধারণ সূত্রটির সংস্কার সাধন করে এ রকমভাবে দাঁড় করানো যেতে পারে—“যেসব জিনিসের ভিতরে প্রাকৃতিক বিধিবিধানের অতিরিক্ত বুদ্ধি-কৌশল প্রয়োগ করার ছাপ আছে তার কোন না কোন কর্তা আছে।” তাই বনের গাছটা। যখন তক্তা ও টেবিল হয়ে গেল তখন আমরা সূত্রধরের কৃতিত্ব অনুমান করি। এর দ্বারা প্ৰাকৃতিক গাছপালা পাহাড়-পর্বত গ্ৰহ-নক্ষত্রেরও এক অতিমানব কর্তা আছে-এ জাতীয় অনুমান অযৌক্তিক। এই অতি প্ৰলম্বিত অনুমানটি শক্তিহীন অবিবেকী বামন ব্যক্তিটির অমূলক লম্ফ প্রদানেরই সামিল। সুতরাং ন্যায়শাস্ত্রীয় পরিভাষা অনুসারে “কার্যমাত্রেরই কর্তা আছে।” এই ‘ব্যাপ্তি” বা সাধারণ সূত্রটি “ব্যভিচারী।” কুম্ভকার, সূত্রধর বা তন্তুবায়ের মত সুৰ্য চন্দ্ৰ তারা ও সসাগর। পৃথিবীর কোনও কর্তা কখনও পরিদৃষ্ট হয় না। কাজেই কাপড়খানা দেখে বর্তমানে সামনে অনুপস্থিত কোন কারিগর বা তাতীর কৃতিত্ব অনুমান করা সম্ভব। কিন্তু তাই বলে, এই কাপড়ের দৃষ্টান্ত টেনে পৃথিবীর পিছনে ঈশ্বরের কৃতিত্ব অনুমান করা যায় না।
S 8V • সমাজ সাহিত্য ও দর্শন
ঈশ্বর বিশ্বাসী তাকিক তুমুল আপত্তি তুলবেন । বলবেন-এ কেমন কথা! অনুমান মানেই হল যা দেখা যায় তার ভিত্তিতে যা দেখছি তার অনুসন্ধান করা। জগৎ সংসারের কোন কর্তায় অস্তিত্বই তো অনুসন্ধান করছি। আর তুমি বলছি—তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। তাই আমার মূলসূত্রটিই ভুল। এখন যদি তাকে দেখাই যেত তা হলে আর অনুমানের দরকারটা কি ? প্ৰত্যক্ষ পাচ্ছিন বলেই তো অনুমান করছি। তোমার কাপড় কেনার সময় তঁাতীকেও সঙ্গে কিনে নিয়ে আসছ না তো ? তুমি যেমন বর্তমানে অপ্রত্যক্ষ তঁাতীর অনুমান করছি আমি তেমনি বর্তমানে অপ্ৰত্যক্ষ ঈশ্বরের অনুমান করছি। যে বিষয়ে আমি অপ্ৰত্যক্ষ কর্তার অনুমান করছি সেই বিষয়টি দেখিয়েই বলা চলে না৷-“কাৰ্যমাত্রেরই কর্তা আছে’ এই সূত্রটি ভুল। তা হলে “কাপড় মাত্রেই ভঁাতীর তৈরী” এই সূত্রটিও ভুল বলতে পারি। তোমার কাপড়খানু দেখিয়ে বলব। এ কাপড়ের তো তাতী দেখছি না। তখন নিশ্চয়ই প্ৰত্যুত্তরে বলা হবে, এই কাপড়ের বেলাই তো আমি তত্ত্ববায়ের কৃতিত্ব অনুমান করছি। কাজেই এরই নজির দেখিয়ে “কাপড় মাত্রেই তাতীর তৈরী” এই সূত্রটি ভুল বলা যাবে কি করে ? তা হলে আমার ঈশ্বরের বেলাও ঐ একই কথা খাটবে।
ঈশ্বর-বিশ্বাসী তাকিকের এ যুক্তি মেনে নিলে কিন্তু অনেক বিপদের সম্ভাবনা আছে। তা হলে কোনও অনুমানকেই আর ব্যভিচারী বলা চলবে না। জগৎটা ঈশ্বর আর শয়তান দুয়ে মিলে তৈরী করেছে এরকম অনুমানও করা যেতে পারে। জগতে মঙ্গল অমঙ্গল দুই-ই যখন আছে তখন স্রষ্টার ভিতরে সুবুদ্ধি আর কুবুদ্ধি দুই-ই থাকতে হবে। ঈশ্বর যদি শুধু মঙ্গলময়ই হন, তবে অমঙ্গলকারী এক শয়তানও থাকতে হবে। এই দুয়ে মিলে অনেকক্ষণ পাঞ্জা লড়ার পর বোধহয় একটা আপোস্য-রফা হল ; কিছু মঙ্গল আর কিছু অমঙ্গল মিশিয়ে জগৎ সৃষ্টি করা হল। এখন আরও কল্পনা করা যাক ঈশ্বর ও শয়তান পালা করে রাজত্ব চালাচ্ছেন। যখন ঈশ্বর রাজা তখন মঙ্গলের দিকটাই ভার হয়। যখন শয়তান রাজা তখন অমঙ্গলের দিকটাই প্রবল হয়। ঈশ্বর-বিশ্বাসী তাকিক যে যুক্তি দিলেন তাকে ন্যায়ের পারিভাষিক সূত্রে রূপান্তরিত করলে দাঁড়ায়-“পক্ষে সাধ্যের আদর্শন দেখিয়ে কেউ অনুমানকে ব্যভিচারী বলতে পারে না।” “ঘট মাত্রেই কুম্ভকারের সৃষ্টি” এই সাধারণ সূত্র গ্রহণ করার পর, যখন একটা ঘটা দেখছি, কিন্তু কুম্ভকারকে দেখছি না, তখন এ ঘটটিও কোন কুম্ভকার কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে বলে অনুমান করছি। এ অনুমান নির্ভুল। এখানে ন্যারের পরিভাষায় এই বিশেষ ঘটটিকে বলা হয় “পক্ষ”, এবং ‘কুম্ভকার কর্তৃক সৃষ্ট” এই অনুমেয় বিষয়কে বলা হয় “সাধ্য”। এখন একথা বলা চলবে না,– এই ঘটটির বেলা কুম্ভকারকে দেখছি না, সুতরাং “ঘট মাত্রেই কুম্ভকারের সৃষ্টি” এই সাধারণ সূত্রটি ভুল।
কথাটা ঠিকই। কিন্তু প্রশ্ন হল কি জাতীয় দৃষ্টান্ত থেকে কত বড় সাধারণ সূত্রে আপনি যেতে পারেন, তার একটা সীমা থাকা দরকার। আপনার খুশিমত কোন একটা পক্ষ স্থির করে একটা অতি ব্যাপক সাধারণ সূত্রে যাবার অধিকার আপনার আছে কিনা? ঘটের কর্তা কুম্ভকারকে দেখে জগতেরও একজন কর্তা সাব্যস্ত করা আপনার প্রয়োজন পড়েছে; তাই ঘটের দৃষ্টান্ত থেকে কাৰ্যমাত্রেরই কর্তা আছে এরকম একটা সৰ্বব্যাপক সাধারণ সূত্রে যাওয়ার আপনার অধিকার আছে কিনা? সর্বশ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ দার্শনিক আচাৰ্য ধৰ্মকীর্তি ঠিক এই মৌলিক প্রশ্নটিই তুলে ধরেছেন। তিনি বললেন এ জাতীয় কোন সীমা না মানলে অনেক অদ্ভুত সিদ্ধান্তে যেতেও আমাদের বাধা থাকবে না। ধৰ্মকীতি একটি উদাহরণ দিলেন যার ব্যঙ্গরাসটুকুই শুধু উপভোগ্য নয়, মৌলিক প্রশ্নের দিক থেকে যার তাৎপর্যটিও খুবই গভীর। ধরুন, মাটি দিয়ে তৈরী ঘটটার সৃষ্টিকর্তা কুম্ভকার-এই দৃষ্টান্ত থেকে কেউ একটা সাধারণ সূত্র বা ব্যাপ্তি ঠিক করে ফেলল। “যা মাটি দিয়ে তৈরী তাই কুমোরের কাজ” তারপরে একটা উইয়ের ঢিবি দেখেই,–“এই ঢিবিটাও মাটির তৈয়ী, সুতরাং এটিও কুমোরের কাজ” এই বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেল। এখন এই অনুমানকে আপনি ঠেকাবেন কি করে? যদি বলা হয় উই-চিবির পিছনে কুমোরের কর্তৃত্ব দেখা যায় না বলে “যা মাটি দিয়ে তৈরী তাই কুমোরের কাজ” এই সাধারণ সূত্রটি ভুল; তবে জগৎসংসারের পিছনে ঈশ্বরের কর্তৃত্ব দেখা যায় না বলেই “কাৰ্য মাত্রেরই কর্তা আছে।” এই সাধারণ সূত্রটিও ভুল। এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যার ফলে গৃহিণীর নিত্য নূতন গঞ্জনা থেকে আপনি রেহাই পাবেন না। মনে করুন দশদিন, দশটা পকেট মেরে কোন পকেটমার একটা সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করে ফেলল“পকেট কাটলেই টাকা পাওয়া যায়”, আর আপনার গৃহিণীও জানেনপকেটমার পকেট কাটে টাকা পায় বলেই। একদিন আপনি কাটা পকেট নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। আপনি জানেন বেচারা পকেটমার বেয়াকুব হয়ে সেদিন আপনার চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করেছে। কিন্তু আপনার গৃহিণী ও পকেটমার একই সাধারণ সূত্রে বিশ্বাসী। আপনি পকেটমারের দুৰ্গতি ভেবে আনন্দে ঘরে ফিরছেন-জানেন না। আপনার কপালে কি দুৰ্গতি আছে। কাটা পকেট দেখে ভীতিকাতরা গৃহিণীকে আপনি বুঝবেন কি করে যে আপনার টাকা মারা যায়নি। নিশ্চয় মারা গেছে, না হলে পকেটমার পকেট কেটেছে কেন? পরদিন আপনার অফিসের পথখরচ ও টিফিন বাবদ পকেটের বরাদ চার আনায় নেমে দাঁড়াল। গৃহিণী আপনার বুদ্ধিমতী, যদিও তার সেদিনের অনুমানটি আপনার মতে মিথ্যা। কিন্তু কেন মিথ্যা হবে? পকেটে টাকা দেখা না গেলেও কোন অদৃশ্য টাকা নিশ্চয়ই ছিল। “পক্ষা’রূপী পকেটে ‘সাধ্যা’রূপী টাকার দেখা পাওয়া না গেলেই কি অনুমান ভুল হবে? যার পকেট কাটা গেছে তিনি ঈশ্বর-বিশ্বাসী তার্কিক হলে গৃহিনীর এই তর্কের জবাব দিতে হিমসিম খাবেন।