প্রতিকুল পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যবিধানের প্রচেষ্টা শুরু করার আগে মানুষকে নিশ্চয়ই প্ৰতিকুল প্ৰকৃতিত্ব কোলে জন্মগ্রহণ করতে হয়েছিল। তা হলে কোন মনুষ্য-প্ৰাণী জন্মাবার আগে যে পৃথিবীটা ছিল সে পৃথিবীটা সত্য না মিথ্যা দি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীর সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য কোন ও জীবই পৃথিবীতে ছিল না; যখন জীব এসেছে তখনও পারিপাশ্বিক সম্পর্কে বা নিজের সম্পর্কে ধারণা করার মত কোন মানুষই ছিল না। সুতরাং সামঞ্জস্য-বিধানের সমস্যাই যখন ছিল না সেই প্ৰাগজৈবিক বা প্ৰাগ মানবিক পৃথিবীটা Deweyর মতে সত্যও নয় মিথ্যাও নয়। তবে কি সে অদ্বৈত-বেদান্তের মায়া? সত্য না হলে মানুষ জন্মাল কোথায়? যদি বলা যায় প্রাগ্য জৈবিক পৃথিবীটা বর্তমানে সত্যে পরিণত হয়েছে, তা হলে বলতে হবে মানুষ যেদিন প্ৰথম পৃথিবীতে জন্মেছিল সেদিন সে সত্যই জন্মায় নি, আজই সে জন্মেছে। ব্যাপারটা। তবে খুবই অদ্ভুত দাঁড়াবে। সূর্য থেকে যে জলন্ত খাবলাটা ছিটকে গিয়ে পৃথিবীটা জন্মেছিল, সেদিনের ঘটনাটাও তা হলে আজই সত্যে পরিণত হয়েছে। তা হলে দেখা যাচ্ছে Deweyর ‘গতিশীল” সত্যের সংজ্ঞাটি অশেষ দুৰ্গতি ডেকে এনেছে। মানুষের ধারণা ও প্রচেষ্টা-নিরপেক্ষ কোন বস্তু বা ঘটনা সত্যিই আছে, এই জাতীয় একটা ধারণাকে আগে থেকেই সত্য বলে মেনে না নিলে আমাদের সকল ধারণা ও প্রচেষ্টা মহাশূন্যে প্ৰলম্বিত এক অনাদি ত্ৰিশঙ্কুর মত চিরদিন ধরে ঝুলতে থাকবে। পারিপাশ্বিক বলে একটা কিছু আছে, জীবশরীর ও তার ধারণা বলে একটা কিছু আছে এমন একটা সুনিশ্চিত নিঃসন্দিগ্ধ ধারণা আগে থেকে না থাকলে পারিপাশ্বিকের সাথে সামঞ্জস্য বিধানের প্রচেষ্টা শুরু হয় কি করে? বলা যেতে পারে ঐ মূল ধারণাটা বুদ্ধিদীপ্ত নৈয়ায়িকের ধারণা নয়। ওটা জীব-সহজাত শারীরিক ধর্মেরই একটা অংশ। তা হলেও অন্ততঃ জীবশরীরের অস্তিত্বটা অনপনেয়। সত্য বলে স্বীকৃতি পাওয়া প্রয়োজন, যে স্বীকৃতি কোনও পরবর্তী প্রক্রিয়ার পরিণতি নয়, কিন্তু সকল প্রক্রিয়ার স্ব-প্রমাণ পূর্বশর্ত। এর অর্থ হল পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বিধানের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানবিক ধারণা ও প্ৰচেষ্টা-নিরপেক্ষ একটা স্বাধীন বস্তুজগতের বিবর্তন প্ৰক্রিয়াও সমানে চলে এসেছে, এজাতীয় একটি প্রতিজ্ঞাকে পূর্বনির্ধারিত সত্য বলে “মেনে নিতে হবে। অথচ একথা মেনে নিলে Deweyর সত্যস্বরূপের সংজ্ঞাটিকে আমূল সংস্কার করার প্রয়োজন আনিবাৰ্য হয়ে পড়ে। গাড়ীতে চড়ে মানুষ যখন গতিশীল হয় তখন গাড়িটা চলছে বলেই মানুষ চলে। মানুষ চলছে বলে গুড়ি চলেনা। Deweyর যুক্তিতে কিন্তু ব্যাপারটা উলটাই হওয়া উচিত। মানুষের মহাকাশ যাত্রা সম্ভব হয়েছে বলেই মাধ্যাকর্ষণের সূত্রটি সত্য নয়, সূত্রটি সত্য বলেই মহাকাশযাত্রা সম্ভব হয়েছে। Deweyর সংজ্ঞানুসারে কিন্তু প্ৰথম কথাটিই ঠিক, দ্বিতীয়টি নয়। তিনি যদি একথা বলতে পারতেন যে সফল মহাকাশযাত্রায় দ্বারা মানুষের গণিত-বিজ্ঞানের প্রতিজ্ঞাগুলি সত্য (বা মিথ্যা) বলে প্ৰমাণিত হল, তা হলে কোন গোলমাল ছিল না; গোলমাল বঁধে তখনই যখন বলা হয় যে প্ৰতিজ্ঞাগুলি এখন সত্যে পরিণত হল। এমতে সত্যের অস্তিত্বটাই নির্ভর করছে সফল পরিণতিব উপর। কিন্তু বস্তুবাদী মতে সফল পরিণতি নির্ভর করছে সত্যের উপর। যখন বলা হয় বিজ্ঞানের নীতিগুলি প্ৰমাণসাপেক্ষ তখন এর অর্থ এই নয় যে, যে পৰ্যন্ত সার্থক ব্যবহারিক পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ না হল সে পর্যন্ত নীতিগুলি সত্য নয়। তাহলে তো বুঝতে হবে, নিউটনের আগে পৰ্যন্ত বিশ্বসংসার মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম মেনে চলেনি, অথবা কোপারনিক্যাসের আগে পর্যন্ত সত্যিই পৃথিবীটা সূর্যের চারদিকে ঘুরতে শুরু করেনি। “প্ৰমাণ-সাপেক্ষা” কথাটির অর্থ হল প্রমাণের দ্বারা আমরা সত্যকে জানতে পারি, নিঃসংশয় হতে পারি, কিন্তু সত্যের অস্তিত্বটা আমাদের প্রমাণ করতে পারা না পারার উপর নির্ভর করছে না। এজন্যেই আমরা বলেছিলাম, Deweyর সত্যনিরূপণের প্রচেষ্টা স্কুলের ছেলের বাড়ির দিকে মুখ ঘুরিয়ে “পিছন টানে।” স্কুলে এসে পৌছার মত। যেদিকে তিনি চলার চেষ্টা করলেন এসে পৌছালেন ঠিক তার উল্টাদিকে। কার্যের দ্বারা কারণকে জানতে গিয়ে তিনি সিদ্ধান্তে পৌছালেন যে কার্যের দ্বারাই কারণ উৎপন্ন হয়; ব্যবহারের দ্বারা সত্যকে জানতে গিয়ে সিদ্ধান্ত করে বসলেন ব্যবহারের দ্বারাই সত্য তৈরী হয়।
Pragmatism বা ব্যবহারবাদের সাথে বস্তুবাদের এই দুস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও অনেক বিদগ্ধজন মার্কসীয় বস্তুবাদকে ব্যবহারবাদের সগোত্র বলে ঘোষণা করেছেন। অনেকে আবার Pragmatism-এর ভিতরেও প্রগতির সন্ধান পেয়েছেন। এই বিভ্ৰান্তির কারণ বোধ হয় এই যে Pragmatism ও মার্কসবাদ উভয়েই সত্যাসত্য বিচারে ব্যবহারিক পরীক্ষার ওপর অসামান্য গুরুত্ব আরোপ করেছে। সত্যের মার্কসবাদ-সম্মত সংজ্ঞা পরীক্ষা করার সময় আমরা এবিষয়ে আলোচনা করব।
।।পাঁচ।।
সত্যাসত্য নির্ধারণে পরিশ্রান্ত দার্শনিকদের কাছে সমস্যা সমাধানের দুটি চিরপরিচিত রাজপথ খোলা আছে একথা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। মানুষের অজ্ঞতার বিরাট ফাকটাকে ততোধিক বিরাট এক পরমেশ্বর দিয়ে ভতি করা যেতে পারে। সেই পরমসত্যের লীলা-ললিত প্ৰকাশভঙ্গী এই বিশ্ব, এই ভেবে সান্ত্বনা লাভ করা যেতে পারে। কিন্তু এই সান্ত্বনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করার মত দার্শনিকের অভাব নেই। ঈশ্বরকেও যুক্তিতর্ক দিয়ে প্ৰতিষ্ঠা করতে হবে। গ্রীসের এরিস্টোটল থেকে আরম্ভ করে আমাদের দেশের সর্বশেষ নৈয়ায়িক-চূড়ামণি পৰ্যন্ত যুক্তিটা একই ধরণের। এরিস্টোটল বললেন, পালঙ্ক তৈরী করতে মিস্ত্রী চাই; নৈয়ায়িক বললেন, ঘট তৈরী করতে কুমোর চাই। কোনও বস্তু তৈরী করতে হলে তার উপযোগী উপাদানগুলিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে কাজটা করার জন্য একজন অন্ততঃ কর্তা চাই। এমন চমৎকার বিধিনিয়মে আবদ্ধ সাজানোগুছানো এই ব্রহ্মাণ্ডটার পিছনেও একজন কর্তা থাকা প্রয়োজন। না হলে এই বিরাট ব্যাপারটা করল কে? কিন্তু তিনি তো আর কামার কুমোরের মত সীমিতশক্তি স্বল্পজ্ঞ ব্যক্তি হতে পারেন না। তাঁকে অমিতশক্তি সর্বজ্ঞ হতে হবে। এই সর্বজ্ঞপুরুষের নাম দেওয়া হল ঈশ্বর। কিন্তু এতেও ঈশ্বরের প্রতিষ্ঠা নিরঙ্কুশ হল না। গোলমাল বেঁধেছে। অনুমানের মূলনীতি নিয়ে। ঘট তৈরী করেন। কুম্ভকার, সুতরাং জগত তৈরী করেন ঈশ্বর, একথা বললেই চলবে না। এ যুক্তির পিছনে একটা সাধারণ নিয়ম আছে, যাকে একটা ব্যাপক মূলসূত্র হিসাবে দাঁড় করানো প্রয়োজন, যেমন, “যা কিছু কাৰ্য বলে প্ৰতিভাত হয় তার পিছনে একজন কর্তা আছেন।” এই মূল সূত্রটিকে দাঁড় করাতে না পারলে ঈশ্বরকেও দাঁড় করানো অসম্ভব। প্রশ্ন হল, ঘট-পটের কর্তা কুম্ভকার-তত্ত্ববায়কে দেখেই সকল কার্যেরই একজন কর্তা আছে এতখানি কল্পনা করার মত এতবড় একটা উল্লস্ফন দেওয়া কি যুক্তিযুক্ত? তাহলে সব জায়গাতেই লাফটা দিয়ে দেখুন না? মনে করুন। আপনি এক লম্ফৰীরের সঙ্গে চলেছেন। পথে একটা খাল পড়েছে, বীরবির একলাফে পgর হয়ে গেল, আপনার দেহটি দুর্বল, কিন্তু অনুমানী শক্তিটি প্ৰবল; আপনি লম্ফৰীরের উদাহরণ থেকে একটা নৈয়ায়িকসুলভ মানসিক লাফ দিয়ে একটা সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করে ফেললেন,–এইমাত্র যে খাল পার হল সে মানুষ, তা হলে “মানুষে এই খাল পার হতে পারে।” এই সূত্রটি পাবার পরই—“আমিও মানুষ, সুতরাং আমিও পার হতে পারি,” এই আপনার সিদ্ধান্ত। এখন তা হলে লাফটা দিয়ে দেখুন, মজাটা কি হয়। তখন আপনাকে বলতে হবে,–ঐ রকমের বিশেষ-শক্তিসম্পন্ন মানুষই খালটা পার হতে পারে,–আপনার সাধারণ নীতিসূত্রে মানুষের ঐ উপাধিটা বাদ দিয়েছিলেন বলেই আপনি এখন জলে পড়েছেন।