।।চার।।
অবশ্য জেমসের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী Dr. Dewey-র মতবাদকে যিনি মার্কিনী শিল্পসভ্যতার সাগরেদ বলে বর্ণনা করেছেন তিনি মোটেই মার্ক্সবাদী নন, তিনি হলেন স্বয়ং বার্ট্রাণ্ড রাসে। রাসেলের মন্তব্যের বিরুদ্ধে Dewey-র পাণ্টা মন্তব্যটিও উল্লেখযোগ্য-“মার্কিনী শিল্পসভ্যতার ন্যকারজনক বৈশিষ্ট্যগুলির সাথে pragmatic মতবাদের একটা সম্পর্ক স্থাপন করা রাসেলের একটা সুনিশ্চিত অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, আমি যদি তার দার্শনিক মতের সঙ্গে বিলাতী অভিজাত জমিদারশ্রেণীর স্বার্থের কোনও সম্পর্ক খুঁজতে যাই তবে তাও তেমনি অদ্ভুত শোনাবে নাকি”? রাসেল প্ৰত্যুত্তরে বললেন,–“ব্রিটিশ অভিজাতশ্রেণীর সহিত সম্পর্কের প্রভাবে আমার মতামত গড়ে উঠেছে, এ রকমের ব্যাখ্যা শুনতে আমি অভ্যন্ত, বিশেষ করে কমিউনিস্টদের কাছ থেকে। তবু একথা মেনে নিতে আমার মোটেই অনিচ্ছা নেই যে আমার মতামত অন্য সকলের মতামতের মতই সামাজিক পরিবেশের দ্বারা প্ৰভাবান্বিত।”
Dewey-র মতে পারিপাশ্বিকের সাথে সামঞ্জস্য-বিধান বা খাপ খাইয়ে নেবার জন্য জীবশরীরের যে অক্লান্ত প্ৰচেষ্টা তারই নাম সত্যানুসন্ধান। কাজেই সত্য এবং অনুসন্ধান দুটি পৃথক ব্যাপার নয়, সমগ্ৰ অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটিই গতিশীল সত্য। প্ৰকৃতির কোলে জন্মগ্রহণ করা থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ সব সময়ই এই সামঞ্জস্য-বিধানের আবিরাম চেষ্টা করছে। প্ৰতিকুল পরিবেশ নিরন্তর সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে। সমস্যা সমাধানের জন্য মানুষ নিজকে পরিবেশের উপযোগী করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে, সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশকেও নিজের উপযোগী করে গড়ে তুলেজে। ফলে পুরাতন ধারণার জায়গায় নূতন ধারণার আবির্ভাব ঘটেছে। প্রাচীন যাদুবিদ্যার প্রতিজ্ঞাবাক্যগুলির স্থান গ্ৰহণ করেছে আধুনিক বিজ্ঞানের সুপরীক্ষিত প্ৰতিজ্ঞাসমূহ। কিন্তু সামগ্রিকভাবে মানুষের সমস্যার শেষ সমাধান বলে কোন কথা নেই। নিত্য নূতন পারিপাৰ্থিকে সঙ্গে নূতন সামঞ্জস্য-বিধানের সমস্যা তাকে কোনদিনই রেহাই দেবে না। কাজেই জীবক্ৰমাগত গতিশীল সত্যের প্রলম্বিত প্রক্রিয়াটিও বীর হনুমানের দেহের মত ক্ৰমশঃ লম্বা হয়ে চলবে। ”
‘গতিশীল’ কথাটা আজকাল খুবই জনপ্রিয় সন্দেহ নেই। এমনকি আমাদের রাষ্ট্রনায়করাও জনমানসে নিজেদের স্থিতি সুনিশ্চিত করার জন্য যত্রতত্র বক্তৃতায় কয়েকবার ‘গতি’-শব্দটি ছড়িয়ে রাখেন। হয়তো দুৰ্গতিটাও একরকমের গতি। চিন্তানায়ক Dewey সাহেব সত্যের যে গতিময় রূপটি আবিষ্কার করলেন তার ভিততেও দুর্গতির দুর্ভোগটা নেহাত কম না। একটি বহুপ্রচলিত গল্প অনেকেরই জানা আছে। বর্ষার দিনে ছাত্র স্কুলে আসতে দেরি করেছে। মাষ্টারমশাই জিজ্ঞাসা করলেন-দেরি হ’ল কেন? ছাত্র বললে-কি পিছল পথ, এক পা এগোই তো দুপা পিছিয়ে যাই। মাষ্টারমশাই আবার জিজ্ঞাসা করলেন-তবে স্কুলে এসে পৌঁছলে কি করে? চতুর ছাত্র বলল, মুখ ঘুরিয়ে বাড়ীর দিকে যাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু অঙ্কশাস্ত্রের নিয়মে স্কুলে এসে পৌঁছলাম। ছাত্রটির গণিতের জ্ঞান যেমন নির্ভুল, Dewey প্ৰণীত সত্যের সংজ্ঞা ও তেমনি নির্ভেজাল। পারিপাশ্বিকের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য জীবশরীরের অবিরাম প্রচেষ্টাকেই যদি সত্যের সংজ্ঞা হিসাবে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে বলতে হবে, প্ৰচেষ্টা যখন সার্থক হল তখন পূর্বকৃত ধারণাটি সত্যে পরিণত হল, অর্থাৎ সত্যের প্রক্রিয়ার সাময়িক পরিসমাপ্তি ঘটল। এইভাবে সত্যে পরিণত হওয়া মানেই সত্য প্ৰমাণিত হওয়া। সত্যরূপে পরিণতিই হল সত্যের প্রমাণ।। ব্যাপারটা এরকম নয় যে, আগ থেকেই একটা কিছু সত্য ছিল যাকে এখন আমরা প্রমাণের ভিতর দিয়ে জানলাম। সামঞ্জস্যবিধানের প্রচেষ্টা শুরু হওয়ার আগে সত্যমিথ্যা কিছুই ছিল না। এই প্রচেষ্টার প্রারম্ভই হল সত্যের সূতিকাগার।
জেমস সত্যের যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিলেন তার সংস্কার সাধন করতে গিয়ে Dewey যে তত্ত্ব আমদানী করলেন তাতে জেমসের মূলনীতির বিশেষ কোন পরিবর্তন হল না। যা আখেরে সন্তোষজনক-ভাবে কাৰ্যকর। তাই সত্য-Truth is that which is useful in the long run, এই সংজ্ঞাটির সহজবোধ্য রূপটিকে একটি সুগম্ভীর শব্দসম্ভারে ঢেকে দিয়ে মূলত ঐ একই অর্থে তিনি একটি নতুন সংজ্ঞার আমদানী করলেন। জেমসের ভাষার অপূর্ব প্রসাদগুণ এবং সাহিত্যিক সৌন্দৰ্য সযত্নে বর্জন করে Dr. Dewey সত্যের একটা পালোয়ানী সংজ্ঞা দিলেন–Warranted Assertibility, যার এক কথায় বাংলা তর্জমা করা আমার পক্ষে অসাধ্য। কিন্তু পালোয়ানী দর্শনকেও কায়দা করে জল করে দেয়ার কৌশল বোধ হয় রাসেলের মত আর কারুক্স জানা নেই, তাই আমরা তায়ই শরণাপন্ন হলাম। কোন নির্দিষ্ট ধারণার অনুরূপ একটি বিশেষ প্ৰতিজ্ঞাবাক্যের নাম দেওয়া যাক assertion। ধরুন “শীতলা পূজা দিলে বসন্ত রোগ হয় না।” একটি প্রতিজ্ঞা-বাক্য। এখন এই প্ৰতিজ্ঞাবিধৃত ধারণা অনুসারে কাজ করলে যদি সুফল পাওয়া যায়। তবে প্ৰতিজ্ঞা বা ধারণাটি সত্য। তাহলে অভীষ্টসাধনার দ্বারা কোন ধারণা যদি যুক্তিযুক্ত বিবেচিত হয় অর্থাৎ warranted হয়, জেমসের সহজভাষায় ইষ্টসিদ্ধির দ্বারা ধারণাটির উপযোগিতা যদি প্ৰমাণিত হয়, তখন ঐ ধারণার অনুরূপ প্ৰতিজ্ঞা-বাক্যটিও সত্য বলে প্রমাণিত হল। সুতরাং সত্য মানে “warranted assertibility”। এখন এই গম্ভীর সংজ্ঞাটির একটি গম্ভীর ব্যাখ্যা করে বলা যাক-সত্য মানে একটা স্থিরনিশ্চয় নয়। সত্য হল একটা কার্যকরী প্রক্রিরা-ইষ্টসিদ্ধিমূলক ব্যবহারিক কাৰ্য দ্বারা কোন প্ৰতিজ্ঞাবাক্য উপযোগী বলে বিবেচিত হওয়ার এই যে প্রক্রিয়া এরই নাম সত্য। সঙ্গে সঙ্গে সহজকে কঠিন করে বলার একটা পণ্ডিতী প্ৰক্ৰিয়ার নিদর্শনও আপনার পেলেন। আবার দেখুন, বহুবর্ষের অভিজ্ঞতার দ্বারা দেখা গেল শীতলা পূজা দিয়ে বসন্ত রোগ ঠেকানো যায় না। সমস্যাবিব্রত মানুষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বসন্তের টীকা আবিষ্কার করল। এই সার্থক প্ৰতিষেধক প্ৰাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সত্যবাহিকা প্রক্রিয়াটিও অনেক দূর এগিয়ে গেল। “শীতলা পূজা বসন্তের প্রতিষেধক” এই মূল প্ৰতিজ্ঞাবাক্যটির জায়গায় একটি নতুন প্ৰতিজ্ঞা বাক্য আমদানী হল-“টীকা বসন্তের প্ৰতিষেধক।” সত্যকে এভাবে একটি গতিশীল প্রক্রিয়া হিসাবে চিন্তা করলে মূল প্রতিজ্ঞাটিকেও মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে পারবেন না। কারণ শীতলা পূজার ভিতর দিয়ে যে সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তাই বর্তমানে বসন্তের টীকা পৰ্যন্ত এগিয়ে এসেছে। আরও কতদূরে এগিয়ে যাবে সে কথা এখনই বলা যায় না।