জেমস্ সত্যের নূতন সংজ্ঞা প্রণয়ন করলেন- “কোনও ধারণার উপর বিশ্বাস রাখা যে পৰ্যন্ত আমাদের জীবনের পক্ষে লাভজনক, সে পৰ্য্যন্ত সেই ধারণাটাই সত্য।” “শেষ পৰ্যন্ত এবং সামগ্রিকভাবে যে ধরণের ধারণা
আমাদের সুবিধাজনক। তাই সত্য।” “যদি কোনও আপাতসিদ্ধ ধারণা থেকে জীবনের পক্ষে কার্যকর সুফল পাওয়া যায়। তবে আমরা তা বর্জন করতে পারি না।” জেমস এর ব্যাখ্যা করতে ঈশ্বরের উদাহরণ টেনে আনলেন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করার যদি ব্যাপকতম অর্থে কোনও সন্তোষজনক কাৰ্যকারিত থাকে তাহলে ঈশ্বর সত্য। জেমসের মতে এই কাৰ্যকারিতা আছে, তাই ঈশ্বরের ধারণা সত্য। “আধ্যাত্মিক অনুভূতির প্রমাণের উপর নির্ভর করে আমরা অনায়াসে বিশ্বাস করতে পারি। যে এমন একটা উচ্চ পৰ্যায়ের শক্তি আছে যা আমাদের ধ্যানধারণার সাথে সঙ্গতি রেখে জগৎটাকে উদ্ধার করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।”
সত্যের এই অভিনব সংজ্ঞায় ইত্যর প্রাণীদেরও আপত্তির কিছু নেই। আমরা তাদের বুঝিয়ে বলতে পারি।–তোমাদের পক্ষেও যা ভাল বা কার্যকর তাই তোমাদের সত্য।
তবু মানুষের ন্যায়শাস্ত্র জেমস-প্ৰদৰ্শিত সমাধানের বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি তুলবে। প্ৰথম আপত্তি, সত্যাসত্যের-বিচারে আমাদের ধারণার অনুরূপ বহির্জগতে কোন বস্তু বা ঘটনা আছে কি নেই জেম্স এই মূল প্রশ্নটি একেবারেই এড়িয়ে গেছেন। অথবা এ প্রশ্নটিকে তিনি কোনও প্রশ্ন বলেই স্বীকার করেন নি। ঈশ্বর আছে কি নেই সেটা আসল কথা নয়, আসল কথা হল ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখলে আমাদের পক্ষে ভালভাবে কাজ। উতরে যায়। কিনা। যদি দেখা যায় দিব্যি কাজ চলে যাচ্ছে। তাহলেই বিশ্বাসটা সত্য, তিনি থাকুন। আর নাই থাকুন। কিন্তু বিশ্বাস না রেখেও যাদের কাজ উতরে যায় তাদের বেলা ঈশ্বরের গতি কি হবে?
আমাদের দেশের মীমাংসা-দর্শনে দুটি প্রধান কথা আছে, বিধি ও অর্থবাদ। বিধি হল অভীষ্ট-সিদ্ধিকর কোন কার্যে নিযুক্ত করার জন্য কোন আদেশ বা উপদেশ (অথবা কোন নিদিষ্ট কাজ থেকে নিবৃত্ত করার জন্য)। অর্থবাদ হ’ল আদেশটা মানতে যাতে লোকে অনুপ্রেরিত হয় এমন কোন আনুষঙ্গিক স্তুতি বা কাহিনী। মনে করুন ছোট্ট ছেলে তেতো ওষুধ খেতে রাজী নয়। মা তাড়াতাড়ি পঞ্জিকার পাতা খুলে এক মস্ত পালোয়ান এনে হাজির করলেন, বললেন, দেখি খোকা কি লিখেছে; এই ওষুধ খেয়ে অত বড় পালোয়ান হয়েছে লোকটা। ছেলে পালোয়ানের দিকে তাকিয়ে ওষুধটা খেয়ে ফেলল। জেমসের মতে তা হলে পঞ্জিকার পালোয়ানটা সত্যিই পালোয়ান, কারণ সে ছেলের মায়ের কাজটা ভালমতেই হাসিল করে দিয়েছে। ওষুধের বিজ্ঞাপনদাতাও কিন্তু জেমসের মত পালোয়ানে বিশ্বাস করে না। আমাদের দেশের দার্শনিকরাও অর্থবাদ-বাক্যগুলোকে স্বতন্ত্রভাবে সত্য বলে মনে করেন না। বিধিবাক্যগুলির প্রমাণ্যের পুচ্ছ ধারণ করেই অর্থবাদ বাক্যগুলি ধার করা প্রামাণ্য লাভ করেছে। চাপরাসীর চাপরাস মূলত মালিকের মহিমাই কীর্তন করে। জেমসের মতে কিন্তু অর্থবাদগুলো খাটি সত্য হতে বাধ্য, কারণ ওগুলো কাৰ্যসিদ্ধিকর। আমাদের দেশের এক দিকৃপাল প্ৰাচীন দার্শনিক এমন কথা বলেছেন যে স্বৰ্গ-নরকে বিশ্বাসী অনেক ধাৰ্মিক লোকের মর্মাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। ছেলে কাঁদছে, মা বলছেন, কেঁদো না, কাঁদলে বাঘে খাবে, ছেলে ভয়ে ভয়ে কান্না থামিয়ে দিল। পাপ করলে নরকে যেতে হবে, এই নরকবাসটাও ঐ কান্না থামানো বাঘের মত। ওটা সত্য নয়, কিন্তু দরকারী, কারণ পাপ থেকে নিবৃত্ত করতে সাহায্য করে। এ কথাগুলো বলেছেন স্বয়ং ভর্তৃহরি–
“ব্যাঘ্রাদিব্যপদেশেন যথা বালো নিবর্ত্যতে।
অসত্যোহপি তথা কশ্চিৎ প্রত্যবায়ো বিধীয়তে।।”
(ভর্তৃহরি—বাক্যপদীয়—দ্বিতীয় কাণ্ড)
ভর্তৃহরি যাকে অসত্য বলে ঘোষণা করলেন, জেমসের মতে কিন্তু তা সত্য, কারণ বাঘের ভয়ে কান্নাটা থামল তো!
জেমসের “সত্য-সংজ্ঞার” বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আপত্তিটাও কম জোরালো নয়। জেমস সত্যের ধারণাকে একটি নৈতিক ধারণার (ethical concept) সঙ্গে একাকার করে ফেলেছেন। তিনি যে কাৰ্যসিদ্ধির কথা বলেছেন স্বভাবতই তা ইষ্টসিদ্ধি, অনিষ্টসিদ্ধি নয়; মানুষের যাতে মঙ্গল হয়, ভাল হয় তাই সত্য। এখন মনে করুন, পরিবারের একমাত্র উপাৰ্জনশীল ব্যক্তিটিকে ওলাইচণ্ডী দেবী দয়া করলেন। এখন এই ঘটনাটি কার ইষ্টসিদ্ধি করবে? পরিবারের পক্ষে এ ঘটনাটি (দার্শনিকমতে ধারণাটি) মর্মান্তিক সত্য। কিন্তু জেমসের সংজ্ঞানুসারে ঘটনাটি মিথ্যা হতে বাধ্য, কারণ কলেরা রোগটা তো সন্তোষজনক-ভাবে কারুর কার্যসিদ্ধি করছেন। সুতরাং রোগীকে হাসপাতালে পাঠানোরও কোন প্রয়োজন নেই, কারণ রোগের ধারণাটাই মিথ্যা। আমাদের দেশের হাসপাতাল-কর্তৃপক্স ও জেমসের সত্যদর্শনে অনেকটা স্বস্তিবোধ করবেন।
William James—এর সমালোচনা আমরা সাধারণ ভাবেই উপস্থিত করলাম, বিশেষভাবে মাক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে নয়। মাক্সর্বাদের তরফ থেকে সমালোচনা অনেকদূর পর্যন্ত যেতে পারে। কিন্তু কোনও অ-মার্ক্সীয় বিশুদ্ধ দার্শনিক আপত্তি তুলতে পারেন যে সত্যাসত্য বিচারে জেমসের লেখার ভিতরে অনাবশ্যক ও দুর্ভাগ্যজনক কতগুলি শব্দ স্থান পেয়েছে–যেমন practical cash-value, payments, that which pays ইত্যাদি, এবং এই শব্দগুলি দেখেই মাক্সবাদীরা বিভ্রান্ত হয়ে জেমসের দর্শনের সঙ্গে মার্কিনীপুঁজিবাদের একটা সঙ্গতি আবিষ্কার করেছেন।