কিন্তু আপনি তো এক ভাবনায় সব নিরাময় করে দিলেন। এদিকে সক্রেটিসের শুয়োর, বেবুন আর ব্যাঙাচিগুলিও তো রয়েছে। ওরা কি আপনার মত ভাবতে জানে? ভাবুকের ভাবের ঘরে পরমেশ্বর, আর শূকরের মুখগহ্বরে পঞ্চামৃত, দুয়ের কাছে দুটাই পরম সত্য। মানুষ ও শুয়োর যদি এক সঙ্গে সত্যদৃষ্টির দাবিদার হয়, তবে কোন হাকিম রায় দেবার সাহস করবে বলুন। ভাগ্যে শুয়োরের বুদ্ধি নেই তাই কোন দার্শনিকের আদালতে হাজির হয়নি; অথবা তার বুদ্ধি একটু বেশী, বুঝেছে যে মানুষ যখন নিজেই মামলার শরিক তখন তার বিচারের ওপর নির্ভর করা বৃথা, তাই নির্ভাবনায় কাঁদার গড়াগড়ি দিয়ে কসাইখানায় চলে যাচ্ছে।
কিন্তু শূকর জানে না যে মানুষের মধ্যেও নিরপেক্ষ দার্শনিক আছেন। আপনি যদি ফরাসী দার্শনিক বার্গসঁর শিষ্য হন তবে কিন্তু শূকরের দিকেই সত্যনারায়ণের পাল্লা ভারী হবার সম্ভাবনা আছে। বাৰ্গসঁর মতে মানুষের বিচারবুদ্ধি তার একটা দুৰ্ভাগ্য; এই বিচারবুদ্ধি বা intellect এর কাছে মানুষের স্বাভাবিক অনুভবশক্তি বা instinct হার মেনে আত্মগোপন করেছে। জগতের মূল সত্য একটা দুরন্ত দুনিবার জীবনীশক্তি যার নিরন্তর গতিশীল স্বরূপটি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির অগোচর। বুদ্ধির ধর্মই হল জগৎটাকে খণ্ড খণ্ড করে স্থিরভাবে দেখা। একমুহূর্তও যে থমকে দাঁড়ায় না বুদ্ধি তাকে ধরবে কি করে। তাই মানুষ তার বুদ্ধির দৌলতে জড়জগৎ সৃষ্টি করেছে। যা গতিশীল হলেও মানুষ তার গতিক্ষণগুলোকে ভাগ ভাগ করে বিশ্লেষণ করে দেখতে চায়। এই খণ্ড খণ্ড স্থির বস্তুপিণ্ডগুলিই বুদ্ধির একমাত্র পুঁজি। তাই জ্যামিতি বিন্দু সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞান অণু পরমাণু সৃষ্টি করেছে। একদিন যে আলোককে শক্তির তরঙ্গ বলে জানতাম তার ভিতরেও বিচ্ছুরিত কণিকা সমষ্টি আবিষ্কার করেছে। আসল কথা গতিশক্তির একটা আধার না থাকলে মানুষ গতির কল্পনা করতে পারেনা, আর আধারটি যদি অন্তত একটিীক্ষণ স্থির না থাকে। তবে তাকে আধার বলে চেনা যায় না, কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু বার্গসঁর মতে শক্তির আধার বলে কিছু নেই, গতিশীল বস্তু বলে কিছু নেই। আছে শুধু একটা বস্তুহীন ধাবমান গতিশক্তি যার নাম জীবন। তাই বস্তুপূর্ণ জড়জগৎ বুদ্ধির কল্পনাবিলাস মাত্র। আলোর, গতি সেকেণ্ডে একলক্ষ ছিয়াশী হাজার মাইল-একথা বলাও বুদ্ধিবিকারের লক্ষণ মাত্র। কারণ ঐ পরিমাপটাও একটা স্থির গাণিতিক সংজ্ঞা। যে সত্য অখণ্ড অপরিমেয় তাকে যত সূক্ষ্ম করে মাপার চেষ্টা করা হবে ততই তাকে খণ্ড খণ্ড করে বুঝতে হবে, আর ততই বুদ্ধি সত্যভ্ৰষ্ট হবে। গণিতশাস্ত্ৰ শেষ পর্যন্ত পরিমাপের বিজ্ঞান, তাই সে অমেয়কে মাপার স্পর্ধ রাখে, কতকগুলি স্থির সংজ্ঞার দ্বারা অস্থির জীবনকে বাঁধতে চায়।
তাহলে উপায় কি, সত্যকে জানিব কি করে? জানা যায় না। অনুভব করা যায়, বুদ্ধির বিকারমুক্ত নির্লিপ্ত স্বাভাবিক অনুভব শক্তির দ্বারা উপলব্ধি করা যায়। মানুষের বিচারবুদ্ধি উপলব্ধিকে কোণঠাসা করে রেখেছে। সেই উপলব্ধিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। পিছন দিকে তাকালে দেখা যাবে। আমরা এই উপলব্ধির পরম ঐশ্বৰ্য ফেলে রেখে এসেছি ইত্যর প্রাণী-জগতের অনুভূতি বা ভাণ্ডারে। ইত্যর প্রাণীদের ভিতরে বুদ্ধি ও অনুভূতির ব্যবধান ক্ৰমশঃ দূর হয়ে গেছে, আর আমরা যত ওপরের দিকে উঠেছি ততই ব্যবধানটা বেড়ে গেছে। উন্মাৰ্গগামী বুদ্ধির যে দৌরাত্ম্য দেখা গেল বানরের মধ্যে, মানুষের মধ্যে এসে তা উৎকটরূপে পরিপূর্ণ হল। উপলব্ধির সঙ্গে বুদ্ধির দূরত্ব এতখানি বেড়ে গেল, এমন সর্বগ্রাসী প্ৰতাপ নিয়ে বুদ্ধি আবিভূতি হল যে বেচারা উপলব্ধি মনের অতল গহবরে ভয়ে নিজীব নিঃসার হয়ে পড়ে রইল। কিন্তু ইত্ন প্রাণীর বিচারবুদ্ধি দুর্বল, তাই অনুভূতিটাই প্ৰবল। পিপড়া, মৌমাছি বা উইপোকার দিকে তাকান, তাক-লাগামো এত সুন্দর সুন্দর কাজগুলি তারা বিচার বিশ্লেষণ করে করছে না, করছে স্বচ্ছ স্বাভাবিক অনুভব-প্রবণতার ক্ষমতায়, যে ক্ষমতা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে প্ৰযুক্ত হয় না, অথচ যা জীবনীশক্তির স্বাভাবিক বিকাশ ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিরুদেশে, নির্বিচারে কাজ করে চলে। মানুষের সুপ্ত অনুভূতিকে প্রথম যুগের গৌরবের ভূমিকাটি ফিরিয়ে দিন, তাকিকের বুদ্ধিকে স্তব্ধ করে রাখুন, সত্যের চিরভাস্কর গতিময় স্বরূপটিকে উপলব্ধি করুন।
তাই বলেছিলাম, বার্গসঁর শিস্য হলে শূকরের দিকে সত্যানুভূতির পাল্লা ভারী হবার সম্ভাবনা আছে, কারণ ওর ভিতরে নিছক জীব-সহজাত অনুভূতি ছাড়া আর কোন বুদ্ধির তাড়না কল্পনা করা যায়না। কিন্তু শূকরের কাছে সত্যদৃষ্টি শিখতে বললে মানুষের অপমানিত ৰোধ করা স্বাভাবিক। অত কদাকার চেহারা, আর অত বদভ্যাস বরদাস্ত করা অসম্ভব। খাবার টেবিলে ভোজনরসিকের শ্ৰীতি জন্মালেও হরিজনের বস্তিতে পঙ্ককেলিনিমগ্ন ওর দৃষ্টি মোটেই মনকে প্ৰসন্ন করে না। সুতরাং আমরা মৌমাছিকেই সত্যদ্রষ্টা ঋষি বলে ধরে নেব, কবি-মানুষের মনও আনন্দিত হবে, এদের নিরলস নিরুদেশ ও নির্বিচার নির্মাণ-কৌশলে দার্শনিক দৃষ্টিও বিমুগ্ধ হবে।
।।তিন।।
কিন্তু সক্রেটিসের শূকর এত সহজে আমাদের ছাড়বে কেন? কথায় বলে শুয়োরের গোঁ। তারপর অতবড় দার্শনিকের কাছ থেকে কিছু বুদ্ধি ধার করে সে ও তর্ক জুড়ে দিতে পারে, বলতে পারে,–বাৰ্গসঁ তো বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করেই বুঝিয়েছেন যে বুদ্ধির দ্বারা সত্যকে পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় নিছক অনুভূতির দ্বারা। তাহলে শেষ পর্যন্ত ঐ হ’ল-মানুষের বুদ্ধিতে যা প্রতিভাত তা মানবিক সত্য, তার কাছে—“Man is the measure of all things.” তবে আমার কাছে “The measure of all things is the pig” (Plato–Theaetetus), এ আমার ‘শৌকরিক’ সত্য। এখন দার্শনিকের উপায় কি? উপায় বাতিলালেন ‘William James, যিনি ব্যবহারবাদ বা Pragmatism-এর প্রধান আচার্য বলে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তিনি বললেন।–একদিকে চেতন মানুষের ধারণা-নিরপেক্ষ একটা বহির্বিশ্ব, আর একদিকে তার ধারণা, এই দুইয়ের ভিতর মিল থাকার নামই সত্য-সত্যের এ জাতীয় সুকঠোর সংজ্ঞা নির্ধারণ করেই দার্শনিকেরা বিপদে পড়েছেন। এই মিলটা কোথা আছে কি নেই এ বিষয়ে কিছুই নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই, অন্ততঃ মিলাটা যে কোথাও আছেই এমন নিশ্চিত কোন প্ৰমাণ খুঁজে বার করা অসম্ভব। এখানে বিজ্ঞানবাদীদের যুক্তি যেমন সূক্ষ্ম তেমনি সুদৃঢ়। আমার চেতনার বাইরে গিয়ে আমি বাহিরকে জানতে পারি না। অথচ বাহিরকে চেতনার আলোতে স্নান কারাবার আগেই তাকে না জানলে তার সঙ্গে চেতনার মিল খুঁজব কেমন করে? মিল খুজতে গেলে যার সঙ্গে মিল তাকে আগে জানা চাই, অথচ জানতে গেলে মিল চাই, নৈয়ায়িকের পরিভাষায় এই অন্যোন্যাশ্রয় দোষ থেকে মুক্তি পাওয়া মুস্কিল। সুতরাং জেমস্ ঠিক করলেন -জ্ঞান ও জ্ঞেয়ের ভিতরে সামঞ্জস্যের নাম সত্য, সত্যের এই সংজ্ঞাটিকে পরিত্যাগ করে নূতন কোন সংজ্ঞা নির্ধারণ করা উচিত।