মার্ক্সীয়দৰ্শন বিশ্ববীক্ষার দাবীদার, কিন্তু মুস্কিল বেঁধেছে মূলঘাটে, বিশ্বের তো নিজস্ব কোন বীক্ষা নেই। তাই মানুষের মননশীল মনে যে বীক্ষণশক্তি স্থান পেয়েছে সেটাই বিশ্ব-বীক্ষা, এমন দাবী করলে মানবকেন্দ্ৰিক দর্শন পরিতৃপ্ত হতে পারে। কিন্তু এও এক ধরনের আত্মরতিময়ী পরিতৃপ্তি যার ভিতরে লুকিয়ে আছে এক পরম স্পৰ্থ-আমিই বিশ্ব। এ যেন অদ্বৈতবেদান্তেরই প্ৰতিধ্বনি, “সোহম”-বাদের এক নবরূপী সংস্করণ। কিন্তু নিখিল জগতের কোটি কোটি বছর ধরে এই যে বিরামহীন কালক্ষয়ী কালপরিক্রমা, এর ত কোন লক্ষ্য নেই, উদ্দেশ্য নেই, মূল্য নেই। তাই জগতের অণুতম ভগ্নাংশ যে মানুষ তারও কোন চরম মূল্য নেই, চুড়ান্ত সার্থকতা নেই। একই কারণে মানুষের কোনো বিশ্ববীক্ষণের ক্ষমতা নেই। তার বিশ্ব-দৃষ্টি আত্মদৃষ্টিরই নামান্তর মাত্র-একটি ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশের পক্ষে সুবিপুল সমগ্রতাকে ধারণ করা ও ধারণা করা অসম্ভব।
এত কথা বার্ট্রাণ্ড রাসেল বলেন নি। রাসেলের বক্তব্যের একটি বিস্তৃত ব্যাখ্যা আমরা এমন ভাবে উপস্থিত করলাম যাতে “মানবকেন্দ্ৰিক” মাক্সীয় দর্শনের বিরুদ্ধে “বিশুদ্ধ দর্শনের” আপত্তিটা বেশ জোরদার বলে মনে হতে পারে।
।।দুই।।
বিশুদ্ধদৰ্শনের মতে সত্যাসত্য মানুষের শুভাশুভ-নিরপেক্ষ। একদিন সমুদ্রের নাবিকরা ধ্রুবতারা দেখে দিকৃনির্ণয় করত। কিন্তু দিশাহারা নাবিককে দিগদর্শন করাবার জন্য ধ্রুবতারাটা কোন ব্ৰত গ্ৰহণ করে আকাশে ওঠেনি। এখন নাবিকের পক্ষে সে নিষ্প্রয়োজন, তাতেও তার কোনো আপশোস নেই। তবু তার অস্তিত্বটা সত্য যা মানুষের ভালমন্দর কোনো তোয়াক্কা রাখে না। এই হল দার্শনিক সত্য বা বৈজ্ঞানিক সত্য যা মানুষের আপন মনের রঙে রাঙানো নয়, অথচ মানুষ যাকে আপনি কাজে লাগালেও
লাগাতে পারে।
কিন্তু যে দর্শনের মূল লক্ষ্য মানুষ সেই মানবকেন্দ্রিক দর্শনের শেষ পর্যন্ত আত্মকেন্দ্রেইক ওঠার সম্ভাবনা আছে। কারণ এ হল মানুষেরই আত্মদর্শন। তা হলে বহুবিঘোষিত বস্তুবাদ যখন মানবতাবাদে পর্যবসিত হয় তখন দার্শনিক সত্যদৃষ্টি থেকে তার বিচ্যুতি ঘটেছে বলতে হবে।
গ্ৰীক দর্শনের সোফিস্ট সম্প্রদায়ের পূর্বতম সুরি প্রোটাগোরাস একটি বহুজন-বিদিত প্রবাদের জন্য অমরত্ব লাভ করেছেন -“যা কিছু আছে আর যা কিছু নেই, কি আছে আর কি নেই, এই সব কিছুরই মাপকাঠি হল মানুষ।” (Man is the measure of all things, of things, that are that they are, and of things that are not that they are not). First এই উক্তিটির মর্মার্থ একটি বৃহত্তর মানবতাবাদী তাৎপর্ধে রূপান্তরিত হয়েছে“সবার উপরে মানুষ সত্য”, এই মহত্তর মানবিক বাণী-ভাবনার সহিত একাত্মতা লাভ করেছে। প্রোটোগোরাসের প্রবাদবাক্যটি যে মহিমাময় অর্থে আমরা বর্তমানে ব্যবহার করছি, মূলত হয়ত সে অর্থ তার ছিল না। প্লোটোর সমালোচনায় একথাটির যে অর্থপ্রকাশ পেয়েছে তাকে মানুষের উল্লসিত হবার কোনও কারণ ঘটেনি। “সব কিছুরই মাপকাঠি মানুষ।” একথাটির প্লেটো অর্থ করেছেন-যার কাছে যখন যা প্ৰতিভাত হয়, তার কাছে তখন তাই সত্য। কামলারোগী যখন সাদাকে হলুদ দেখে তখন তার কাছে হলুদ রঙটাই সত্য, যে সাদা দেখে তার কাছে সাদাটাই সত্য। সুতরাং সত্যাসত্য শেষপর্যন্ত মানুষের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপার মাত্র। এর সহজ অর্থ হল, মানুষের দৃষ্টিনিরপেক্ষ নিছক বস্তুগত সত্যাসত্য বলে কিছুই নেই। কাজেই সত্যমিথ্যার স্বগত-পার্থক্য নির্ধারণের ও কোনো উপায় নেই। সক্রেটিসের মুখ দিয়ে প্লেটো এই মতবাদের বিরুদ্ধে যে সমালোচনা শুরু করলেন তার যুক্তিসিদ্ধ নির্দোষ ব্যঙ্গরসাটুকুও যথেষ্ট উপভোগ্য সন্দেহ নেই।
প্লেটোর সক্রেটিস বলছেন-প্রোটাগোরেসের বইখানা খুলেই আমি খুশী হয়েছি, যখন দেখলাম তিনি বলছেন—যার কাছে যা প্রতিভাত হয় তাই সত্য। তবুও আমি একটা কথা ভেবে বিস্মিত হচ্ছি, প্রোটাগোরাস আর একটু এগিয়ে গিয়ে কেন বললেন না—“সব কিছুরই মাপকাঠি শুয়োর বা বেবুন বা ব্যাঙাচি”। বিদ্রুপটির মর্মার্থ পরিষ্কার। মানুষের কাছে যা প্ৰতিভাত তা যেমন মানবিক সত্য, ব্যাঙাচির কাছে যা প্ৰতিভাত ত। ব্যাঙাচির সত্য। ব্যাঙাচির চেয়ে মানুষকে বিজ্ঞতার বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। (Plato–Theaetetus)
এখন মনে করুন, বিশ্বরহস্যের অতল গভীরতা ও অন্তহীন বিপুলতায় অভিভূত হয়ে কোনও বিনয়বিহ্বল দার্শনিক যদি ভাবতে শুরু করেন-হায় মানুষ, তোমার কিসের গৌরব, কিসের গর্ব, অনন্তের তুলনায় তুমি ব্যাঙাচির চেয়ে বড় নও, তাহলে এই ব্যাঙাচি-ভাববিভোর দার্শনিকের ভাবনার তাড়না থেকে আণনি উদ্ধার পাবেন কি করে? উদ্ধার পাবার দুটি রাজপথ অনেকদিন থেকে তৈরী হয়ে আছে। বিশ্বের রহস্য যেখানে দুৰ্গম ও দুর্ভেদ্য বলে মনে হবে, সিএ গভীর শূন্যময় অন্ধকূপে এক সর্বজ্ঞা, সর্বিনিয়ন্তা নিত্যভাস্বর পরমেশ্বরকে বসিয়ে দিন, আর ভাবুন তার আলোতে আলোময় এ বিশ্বভুবন-তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি। ভাবুকের ভাবনা রবারের মত টানলে বাড়ে। তাই ক্ষমতা থাকলে আরও ভাবুন, ভাবুন তিনিই আছেন, আর কিছু নেই, আরো ভাবুন আপনিই তিনি। এখন আর আপনি “তৃণাদপি সুনীচ” নন। জগতের জয়টীকা আপনার ললাটে। অনন্ত গৌরবে প্ৰদীপ্ত আপনি বিশ্বের পরম বিস্ময়। এখন জলের মত সব ব্যাখ্যা ইয়ে গেল, সকল রহস্তের সমাধান হয়ে গেল, হৃদয়ের সকল গ্ৰন্থি খুলে গেল, সকল সংশয় কেটে গেল।