যখন মানবসত্যের অবগুষ্ঠিতা প্ৰজ্ঞাবাণীকে কবি স্পষ্ট করে দেখতে পেলেন তখন তাঁর নিরুদ্দেশ যাত্রার তরী ‘সভ্যতার সংকট’ পার হয়ে এসে ভিড়লো রূপ-নারাণের কুলে—
জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম আপনার রূপ–
সত্যাসত্য
মনীষী বার্ট্রাণ্ড রাসেলের একটা মন্তব্য নিয়ে আমাদের বক্তব্য আরম্ভ করা যাক–
“নিছক দার্শনিক হিসাবে বিচার করতে গেলে মাক্সের কিছু গুরুতর দুর্বলতা আছে। তিনি বড় বেশী বৈষয়িক, তার সমসাময়িক সমস্তা নিয়ে বড় বেশী ব্যতিব্যস্ত। তার দৃষ্টির প্রসার এই পৃথিবীর পর্যন্ত, এই গ্ৰহ আর মানুষ, এখানেই দর্শনের শেষ। কিন্তু কোপারনিক্যাসের পর থেকে একটি কথা পরিষ্কার বোঝা গেছে,–মানুষ এতদিন ধরে নিজের উপর যে গুরুত্ব আরোপ করে এসেছিল সেই বিশ্ববিসারী গৌরব আজ সে হারিয়ে ফেলেছে। যিনি এই ঘটনাটির মর্ম উপলব্ধি করতে পারেননি তাঁর পক্ষে নিজের দর্শনকে বিজ্ঞাননির্ভর বলে দাবী করার কোনো অধিকার নেই।”
-(History of Western Philosophy–Karl Marx)
রাসেলের বক্তব্য ব্যাখ্যা করলে অনেকটা এ রকম দাঁড়াবে–যে পৰ্যন্ত বিশ্বাস ছিল সূৰ্যটা পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে সে পৰ্যন্ত এই গ্রহবাসী মানুষের একটা যুক্তিসঙ্গত আত্মগরিমা ছিল। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড যেন তাকেই প্রদক্ষিণ করছে, সে ছিল বিশ্বের মধ্যমণি। কিন্তু পোল্যাণ্ডের এক পাদ্রীসাহেব কি কাণ্ড করে বসলেন, কলমের ডগায় সূৰ্যটাকে চেপে ধরে স্থির করে দাঁড় করালেন আর পৃথিবীটাকে ঘুরপাক খাইয়ে দিলেন সূর্যের চারদিকে। সৌরজাগতিক বিশ্বের সম্মানের আসনটি কেড়ে নিল একটা প্রাণহীন অগ্নিপিণ্ড। এই জ্বলন্ত গ্যাসপিণ্ডের চারদিকে আমরা আজ উদ্দেশ্যহীন বিরামহীনভাবে ঘুরে মরছি। মানুষ হয়ে মানুষের এমন সর্বনাশ করলেন কোপারনিকাস!
এখন বুঝতে পারছি মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের পৃথিবী একটি ধূলিকণা মাত্র, লুপ্তগৌরব হতবৈভব মানুষগুলি এই ধূলিকণার উপর ভাসমান কয়েক কোটি আণুবীক্ষণিক জীবাণুমাত্র। এই জীবাণুওগুলির ভিতরে অনেকেই নাকি আবার দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক। তারা ভাবছে তাদের দর্শন-বিজ্ঞানের ফরমান নিয়ে কোটি সূর্য তারায় ভরা ব্ৰহ্মাণ্ডটা ওঠবস করছে। রেলগাড়ীতে উঠে বাচ্চা ছেলে বাবাকে বিরক্ত করছে, গাড়ী চলছে না কেন? বাবা বললেন ধাক্কা দাও, চলবে। বালক সামনের বেঞ্চটাকে ধাক্কা দিতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে গাড়ী ছেড়ে দিল। বালক খুশী হয়ে ভাবেল তার ধাক্কার জোরেই গাড়ীটা নড়ে উঠে চলতে শুরু করেছে। জগৎটাও তেমনি দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকের নীতির জোরে চলছে।
মাক্স নিরীশ্বরবাদী, কিন্তু মানুষের উজ্জল ভবিষ্যতের প্রতি তার বলিষ্ঠ বিশ্বাস অনেকটা ঈশ্বর-বিশ্বাসীদের পরা-ভক্তির মত। ভক্তের বিশ্বাস মঙ্গলময় ঈশ্বর শেষ পর্যন্ত মানুষকে মঙ্গলের পথে নিয়ে যাবেন। এখন ঈশ্বরের আসনে Dialectics বা দ্বান্দ্বিকাপদ্ধতিকে বসান হল। মানুষের কল্যাণকামনায় প্ৰদীপ্ত একটি অপূর্ব সংবেদনশীল হৃদয় ছিল মাক্সের, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রখর বুদ্ধিভাস্কর মনীষা। হৃদয় বলে মানুষের মঙ্গল হোক : কিন্তু মঙ্গল হবেই, হতে বাধ্য, এই ধরনের একটা প্ৰত্যয় বা দৃঢ় ধারণাশক্তি না থাকলে মানুষের মঙ্গলের জন্য নিরলস-ভাবে কাজ করবার উৎসাহ ও উদ্যম সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। তাই হৃদয়ের আবেগকে দর্শনবিজ্ঞানের যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। মাক্স ও তাই যুক্তি দাঁড় করালেন, দেখাবার চেষ্টা করলেন, জগৎজোড়া দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি সমাজবিবর্তনের মূলেও কাজ করছে। যে পদ্ধতিতে সূৰ্য-তারা-গ্ৰহভরা বিশ্বপ্ৰপঞ্চ চলছে তারই অমোঘশক্তি মানুষকেও এগিয়ে নিয়ে চলেছে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় ভবিষ্যতের দিকে। মহাকাশময় গ্ৰহ-নক্ষত্রগুলি যেন সবাই উঠে পড়ে লেগেছে মানুষের ভাল করবার জন্য। না হলে আর জড় জগতের দ্বান্দ্ৰিক পদ্ধতিটা চেতন মানুষের সমাজকে এগিয়ে দেবার কাজে হাত লাগাতে এল কেন? এখানে তাহলে দর্শনের যুক্তিটা চলেছে হৃদয়াবেগের পিছনে পিছনে। মানুষের শুভ ইচ্ছাকে ফলবতী করতে হবে; কল্যাণকৰ্মে ব্যাপৃত একটি সংবেদনশীল মনীষী মন এই বলে নিঃসংশয় হল যে সমগ্র জগৎটাই চিরকাল ধরে দ্বান্দ্ৰিক উপায়ে এই পবিত্র কাজ সমাধান করার জন্যে সাহায্য করছে।
বার্ট্রাণ্ড রাসেলের মতে যিনি নিছক দার্শনিক তাঁর পক্ষে এজাতীয় কল্পনা অনুমোদন করা অসম্ভব। কারণ, এ হল অভীপ্সা-নির্ভর দর্শন। মানুষের মঙ্গল সম্পর্কে মাঝের একটা বদ্ধমূল ধারণা আছে। সেই ধারণাকে সমাজবাস্তবে রূপদান করতে হবে। তাই জগতের গতি ও কৃতিকৌশলকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হল যাতে কল্যাণময়ী অভীপ্সা চরিতার্থ হয়। “নিছক দর্শনের” দিক থেকে যে প্রশ্নটা বড় হয়ে দেখা দেয় তাকে এই ভাবে উপস্থিত করা যেতে পারে,–মহাবিশ্বের একটি ধূলিকণারূপিণী এই পৃথিবীর গায়ে লেগে থাকা কয়েক কোটি আণুবীক্ষণিক জীব, যাদের নাম মানুষ, যারা মহাকালের তুলনার মাত্র কয়েকদিন হল পৃথিবীতে এসেছে, তাদের ভাগ্য ফেরাবার জন্য সারাবিশ্বের বিধি-বিধানগুলি কাজ করে যাবে এমন কি দায় পড়েছে। গ্রহনক্ষত্রগুলির এমন কি মাথাব্যথা হয়েছে যে মানুষের ভাল না। হলে তাদের স্বস্তি নেই। নিউটন-আবিষ্কৃত মাধ্যাকর্ষণ নীতি মানুষের জন্য সমাজের আসরে নেমে বিপ্লবের কাজে হাত বাড়িয়েছে একথা যেমন একটি স্বচ্ছন্দ কল্পনা মাত্ৰ, তেমনি দুনিয়াজোড়া দ্বান্দ্ৰিক পদ্ধতি মানুষের সমাজে প্ৰতিফলিত হয়ে সমাজটাকে সাম্যবাদের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, এও একটা স্বৈরিণী ধারণামাত্র। এ জাতীয় কল্পনায় সুখ আছে, সাহস বাড়ে, উৎসাহের সৃষ্টি হয়, মানুষের অভীন্সিত সামাজিক লক্ষ্যে উপনীত হতে সাহায্য করে। জড় জগতের কোন লক্ষ্য নেই, উদ্দেশ্য নেই। মানুষ তার নিজের লক্ষ্য জগতের উপর আরোপ করে নিজের সীমিত উদ্দেশ্যের পথে এগিয়ে যায়। কিন্তু মানুষ মহাকাশে হাজারবার লক্ষ যোজন পাড়ি জমালেও শেষ পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সূর্যের চারদিকে ঘুরে ফেরাই সার। যে কপাল নিয়ে মানুষ পৃথিবীতে এসেছে সে কপাল নিয়েই তাকে ঘুরতে ফিরতে হবে; আর সূর্যের পোড়া কপাল, চিরকাল নিজের আগুনে নিজেকে পুড়ে মরতে হবে (যদি না একদিন ছাই হয়ে শেষ হয়ে যায়)।