সাহিত্যের আনন্দ, প্রকাশের আনন্দ, সৃষ্টির আনন্দ কোথায় ব্যাহত হচ্ছে, তুচ্ছ প্রয়োজন কোথায় এই আনন্দকে ব্যাহত করছে তার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে রবীন্দ্ৰনাথ বার বার কেন নিঃসহায় দরিদ্রের উপর ধনীর লোলুপ শোষণের কথা উল্লেখ করছেন, উল্লেখ করতে গিয়ে তাঁর ভাষায় অমন তীব্র আবেগ কেন সঞ্চারিত হচ্ছে, গম্ভীর সাহিত্যতত্ত্বের আলোচনাকালে এই শোষক-শোষিত দ্বিধা বিভক্ত সমাজের কথা বার বার কেন তার মনে আসছে, কলাকৈবল্যবাদীদের নিশ্চয়ই এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে হবে। কিন্তু এ উত্তর তারা দিতে পারেন না-বলবেন, রবীন্দ্ৰনাথ এক split-personality। কিন্তু রবীন্দ্রসাধনার আজন্ম ও আমৃত্যু অগ্রগতির ধারা যারা সামগ্রিকভাবে অনুধাবন করেছেন তাদের পক্ষে এর উত্তর খুব সহজ। মুষ্টিমেয় মুনাফালোলুপ ধনিকের হাতে মানব সমাজের সামগ্রিক গৌরব লাঞ্ছিত। সাহিত্যের বিশুদ্ধ আনন্দরস যে মূল ভিত্তির উপর নির্ভর করে আত্মপ্রকাশ করতে পারে ধনিক সভ্যতা সেই ভিত্তিটাকেই ভেঙে দিচ্ছে, তাই রসের ধারা শুকিয়ে যাচ্ছে, সাহিত্য বন্ধ্যাত্ব প্রাপ্ত হয়ে উন্মার্গগামিতার ভিতরে প্রকাশের পথ খুঁজছে।
রবীন্দ্ৰনাথ মার্কসবাদী বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তার সিদ্ধান্তে পৌছাননি, মননধর্মী মানবিকতার আবেদন থেকে তিনি তার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। সমাজের সঙ্গে সাহিত্যের গভীর সম্পর্কও তিনি এদিক থেকেই বিচার করেছেন। আমাদের দেশের কাব্যশাস্ত্রের বিচারে এদিকটা প্ৰায় অনুপস্থিত। হয়তো বা সমাজ ও সাহিত্যের সম্পর্কটা স্ব-প্ৰতিভাত সিদ্ধান্ত বলেই অনুচ্চারিত রয়ে গেছে। কিন্তু এর ফলে কাব্যশাস্ত্রের তত্ত্বালোচনা একদেশদর্শী হয়ে পড়েছে, অলংকার, রস, ধ্বনি, চমৎকারিত্ব, সাহিত্যের এই বিশেষ ধর্মগুলির আলোচনাতেই নিঃশেষিত হয়েছে। তার ফলে মাতৃভূমির সঙ্গে সাহিত্যতত্ত্বের যোগসূত্রটা হারিয়ে গেছে। ভারতের নাট্যশাস্ত্রের ভূমিকায় একটা গভীর তাৎপৰ্যপূর্ণ উপাখ্যানের ভিতরে সাহিত্য ও সমাজের সম্পর্কের প্রশ্নটা একবার উথাপিত হয়েছিল, কিন্তু তারপর আঙ্গিক ও রসাতত্ত্বের চাপে তলিয়ে গেছে। ব্ৰহ্মা নাট্যবেদ সৃষ্টি করলেন, ভরতমুনি তার প্রচারক। এই নাট্যবেদকে বলা হল পঞ্চমবেদ এবং সকল বেদের শ্রেষ্ঠ। কারণ, চতুৰ্বেদে স্ত্রী ও শূদ্রের অধিকার নেই, এই নাট্যবেদে সমগ্ৰ জনসাধারণের সমান অধিকার। বিশ্বকর্ম রঙ্গমঞ্চ তৈরী করলেন, অভিনয় হবে। দানবরা এল রঞ্চমঞ্চ ভেঙ্গে দিতে, তারা নাটক অভিনীত হতে দেবে না। ব্ৰহ্মা তাদের ডেকে পাঠালেন-কি তাদের আপত্তি ? দানবরা উত্তর করল-দেবতাদের ইচ্ছায় আপনি নাট্যবেদ সৃষ্টি করছেন, সুতরাং তাদেরই স্বার্থে আমাদের চিত্রিত করা হবে কলঙ্কের দাগে। ব্ৰহ্মা বললেন, তোমাদের বা দেবতাদের কারুর পক্ষে বা বিপক্ষে কোন পক্ষপাতিত্বমূলক ভাবনা কোন নাট্যে থাকবে না, ত্ৰিভুবনের সত্য ঘটনাই নাটকীয় ভাবনায় রূপান্তরিত হবে। লোকসমাজ-বৃত্তান্তের অনুকরণই হবে নাট্য। এই নাট্যধর্ম, যশ, আয়ু, কল্যাণ, বুদ্ধি, ও লোকোপদেশ ধারণ করে আবিভূতি হবে। কাজেই তোমাদের দুঃখ ও ক্ৰোধ অমূলক। (নাট্যশাস্ত্র ১১০৩১১৫) আশ্চর্ঘ্যের কথা এই গুরুত্বপূর্ণ উপাখ্যানটির তাৎপৰ্য নিয়ে পরবর্তী কোনো কাব্যশাস্ত্রে আর আলোচনা হালনা। সমস্ত প্রশ্নটাই চাপা পড়ে গেল।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য এ প্রশ্নটি নাট্যশাস্ত্রের সূত্র ধরে উত্থাপিত করেননি। তার নিজের সামাজিক ও সাহিত্যিক অভিজ্ঞতা এবং বিশ্ব-সাহিত্যের সমীক্ষা, সর্বোপরি তার উদার মানবিকতা থেকেই এ প্রশ্ন আলোচনা করলেন। ‘সাহিত্য অর্থেই একত্ৰ থাকিবার ভাব-মানুষের “সহিত’ থাকিবার ভাবমানবকে স্পর্শ করা, মানবকে অনুভব করা…উদ্দেশ্য না থাকিয়া সাহিত্যে এইরূপ সহস্র উদ্দেশ্য সাধিত হয়” (সাহিত্যের উদ্দেশ্য)। এ প্রসঙ্গে একটি প্ৰবন্ধ বিশেষভাবে অনুধাবণীয়, ১৩০১ সালের লেখা “সাহিত্যের গৌরব”। এখানে রবীন্দ্ৰনাথ হাঙ্গেরি ও পোল্যাণ্ডের দুই সাহিত্যরখীর আলোচনা প্রসঙ্গে সমাজ ও সাহিত্যের গভীর সম্পর্কের দিকটি আলোচনা করলেন, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে উচ্চগ্রামের সাহিত্য সৃষ্টির অন্তরায়ের কথাটি যেভাবে আলোচনা করলেন তা আজকের দিনে নূতন করে ভাববার কথা; ইয়োরোপীয় সাহিত্য আমাদের তুলনায় কেন এত অধিক অগ্রসর তার কারণ নির্ণয় করারও তিনি চেষ্টা করলেন।
রবীন্দ্ৰনাথের সাহিত্যতত্ত্ব-সমীক্ষার সামগ্রিক ফল হল রসতত্ত্বকে সমাজের ভিত্তিতে, বৃহত্তম মানবিকঐক্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা। ভরতের নাট্যশাস্ত্রের ভূমিকাগত উপাখ্যানটিতে সাহিত্য ও সমাজের যে সম্পর্কের সমস্তাটি একবার মাত্র মুখ দেখিয়ে আঙ্গিকের তলায় তলিয়ে গেল, রবীন্দ্রনাথ তাকে নূতনযুগের নূতন ভাবনার ভিত্তিতে দাঁড় করালেন, প্রাচীন রসতত্ত্বকে সংস্কৃত ও পরিমাজিত করে এক উন্নততর মানবিক ভূমিতে রসের ও সমাজের মিলন ঘটালেন। এ কাজ করতে গিয়ে উপনিষদের আধ্যাত্মিক তত্ত্বকেও, হয়তো নিজেরই অজ্ঞাতসারে, পরিমাজিত ও পরিবর্ধিত করে আধুনিক ও ভবিষ্যৎ মানবসমাজের উপযোগী করে প্রকাশ করলেন। এই শেষের কথাটিতে অনেকের আপত্তি উঠতে পারে। অনেক জায়গাতেই একথা শুনতে হয়েছে -রবীন্দ্ৰনাথের মানবিকতা আর উপনিষদের আধ্যাত্মিকতা একই জিনিষ। কিন্তু এ কথাটির ভিতরে একটা মস্ত বড় ফ্যাক সৃষ্টি করেছে বাংলা ভাষার হ্রস্ব ই-কারটি। এই অক্ষরটি যাদুকর। একটুমাত্র স্থান বদল করে অর্থের ওলট-পালট ঘটিয়ে দেয়। যদি বলি “মানবিকতাই আধ্যাত্মিকতা’-মার্কসবাদীরাও আপত্তি করবেন না, কিন্তু অলৌকিক আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী অনেকেই আপত্তি তুলবেন। যদি বলি আধ্যাত্মিকতাই মানবিকতা, অলৌকিক রহস্যবাদীরা খুলী হবেন, কিন্তু বস্তুবাদীরা আপত্তি করবেন। কিন্তু একথা ধ্রুব সত্য যে রবীন্দ্ৰনাথ যে অর্থে উপনিষদের মন্ত্রগুলি ব্যবহার করেছেন তা আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে আমাদের প্রচলিত ধারণার সঙ্গে মেলে না। “মানব সত্য’ প্ৰবন্ধটি যদি “মানুষের ধর্মের”। সারাংশ হয়ে থাকে, তবে এই সত্য কোনো অলৌকিক পারলৌকিক মুক্তির বাণী নয়, ইহলোকের মহামানবে ৫ পয়ম সৌভ্রাত্র ও শান্তির বাণী। “অমানব বা অতিমানব সত্যে উপনীত হওয়ার কথা যদি কেউ বলেন, তবে সে কথা বোঝবার শক্তি আমার নেই। কেননা, আমার বুদ্ধি মানব বুদ্ধি, আমার হৃদয় মানব হৃদয়, আমার কল্পনা মানব কল্পনা- “এই বুদ্ধিতে এই আনন্দে যাঁকে উপলব্ধি করি তিনি ভূমা, কিন্তু মানবিক ভূমা। তার বাইরে অন্য কিছু থাকা না থাকা মানুষের পক্ষে সমান। মানুষকে বিলুপ্ত করে যদি মানুষের মুক্তি, তবে মানুষ হলুম কেন” (মানব সত্য)। কিন্তু এই বিশ্বমানবের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসটা ছিল আধ্যাত্মিক ধরণের। একটা অকুণ্ঠিত বিনয়নম্র ভক্তির ভাব ছিল প্রবল। হয়তো তিনি বিশ্বমানবের ভিতরেই প্রকাশমান এক বিশ্বমানবিক আত্মাতেই বিশ্বাস করতেন। কারণ, তিনি তাঁর বিরাট মানব-সত্যে পৌঁছেছিলেন স্বাভাবিসিদ্ধ মানব-প্রেম ও হৃদয়ের আবেগের ভিতর দিয়ে। এর ভিতরে অত্যুচ্চ মানবধর্মের সন্ধান পাওয়া গেলেও, ইতিহাসের বস্তুবাদী বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তিনি এ সত্যে পৌঁছাননি। কিন্তু এই সত্যে পৌঁছাতে হবে কঠোর দু:খ, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ভিতর দিয়ে এ স্থির প্রত্যয় তার কোনদিন এতটুকু শিথিল হয়নি। তাই তার নিজের কথায় ‘ফাল্গুনী’ নাটকার ব্যাখ্যা শুনলে চমকাতে হয়—“জরা সমাজকে ঘনিয়ে ধরে, প্রথা অচল হয়ে বসে, পুরাতনের অত্যাচার নূতন প্রাণকে দালন করে নির্জীব করতে চায়—তখন মানুষ মৃত্যুর মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে, বিপ্লবের ভিতর দিয়ে নববসন্তের উৎসবের আয়োজন করে। সেই আয়োজনই তো যুরোপে চলেছে। সেখানে নূতন যুগের বসন্তের হোলি খেলা আরম্ভ হয়েছে” (আত্মপরিচয় পৃ: ৬৬)। সোভিয়েট রাশিয়ার তীর্থভ্ৰমণের পর এই মানব-সত্যের আদর্শ হয়তো কবির কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এর আগে এতো স্পষ্ট করে “মানব সত্যের” বক্তব্য আর কখনও তিনি তুলে ধরেন নি। তিনি সোভিয়েট সমাজের তত্ত্বের দিকটা গ্ৰহণ করতে পারেননি, কিন্তু মানবিকতার দিকটা খোলামনে গ্ৰহণ করেছিলেন। মানবসত্যকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্ৰনাথের কোনো সাহিত্যতত্ত্ব নেই, রসতত্ত্ব নেই।