যদি কেউ আপত্তি তোলেন রবীন্দ্ৰনাথের কায়দায় নিজের কথা বলা হচ্ছে, তাকে কবির নিজের কথাতেই নিয়ে যাওয়া যাক। তখন তিনি সত্তর বছরের বৃদ্ধি, কিন্তু ভবিষ্যৎ শিবের স্বপ্ন দেখছেন না। প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রস্তুতিপৰ্ব পৰ্যন্ত ইয়োরোপীয় ইতিহাসের অন্তরলোক বিশ্লেষণ করে “শব সাহিত্যে’র উৎপত্তির কারণ নিৰ্ণয় করলেন (সাহিত্যের পথে-“পঞ্চাশোৰ্দ্ধম”, পৃ: ২৩৭-২৩৮)। “সম্পদের জয়তোরণ তলার উপর তলা গেথে ইন্দ্ৰলোকের দিকে চুড়া তুলেছিল, সেই ঔদ্ধত্য ধরণীর ভারাকর্ষণ সইতে পারল না—একমুহূর্তে হ’ল ভূমিসাৎ। পুষ্টদেহধারী তুষ্টচিত্ত পুরাতনের মৰ্য্যাদা আর রইল না। নূতন যুগ আলুথালু বেশে অত্যন্ত হঠাৎ এসে পড়ল, তাড়াহুড়া বেঁধে গেল। অস্থায়িত্বের এই ভয়ংকর চেহারা অকস্মাৎ দেখতে পেয়ে কোনো কিছুর স্থায়িত্বের প্রতি শ্ৰদ্ধা লোকের একেবারে আলগা হয়ে গেছে। সমাজে সাহিত্যে কলা-রচনায় অবাধে নানাপ্রকারের অনাসৃষ্টি শুরু হ’ল।”
এই অনাসৃষ্টি দূর করার জন্য কবি নবীনদের আহ্বান জানালেন। এই আহ্বানের ভিতরে সাহিত্যের প্রতি কবির দৃষ্টিভঙ্গীটি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়—কেউ যদি এই দৃষ্টিভঙ্গীকে Socialist Realism-এর কাছাকাছি বলে প্রেরণা লাভ করতে চান তাকে বোধ হয় গাল দেওয়া চলে না। “যেটাকে মানুষ পেয়েছে সাহিত্য তাকেই যে প্ৰতিবিন্বিত করে তা নয়; যা তার অনুপলব্ধ, তার সাধনার ধন, সাহিত্যে প্রধানত তারই জন্য কামনা উজ্জ্বল হয়ে ব্যক্ত হতে থাকে। বাহিরের কর্মে যে প্রত্যাশা সম্পূর্ণ আকার লাভ করতে পারেনি, সাহিত্যে কলা-রচনায় তারই পরিপূর্ণতার কল্পরূপ নানাভাবে দেখা দেয়। শাস্ত্র বলে, ইচ্ছাই সত্তার বীজ-বিশেষ যুগের ইচ্ছা, বিশেষ সমাজের ইচ্ছা, সেই যুগের, সেই সমাজের আত্মরূপ সৃষ্টির বীজশক্তি।
“সাহিত্যে মানুষের ইচ্ছারূপ এমন ক’রে প্রকাশ পায় যাতে সে মনোহর হয়ে ওঠে, এমন পরিস্ফুট মূতি ধরে যাতে সে ইন্দ্ৰিয়গোচর বিষয়ের চেয়ে প্ৰত্যয়গম্য হয়। সেই কারণেই সমাজকে সাহিত্য একটি সজীব শক্তি দান করে; যে ইচ্ছা তার শ্রেষ্ঠ ইচ্ছা সাহিত্যযোগে তা শ্রেষ্ঠ ভাষায় ও ভঙ্গীতে দীর্ঘকাল ধরে মানুষের মনে কাজ করতে থাকে এবং সমাজের আত্মসৃষ্টিকে বিশিষ্টতা দান করে…যা আমাদের ভাল লাগে, অগোচরে তাই আমাদের গড়ে তোলে। সাহিত্যে শিল্পকলায় সেই ভালো লাগার প্রভাব কাজ করে। সমাজ সৃষ্টিতে তার ক্রিয় গভীর। এই কারণেই সাহিত্যে যাতে ভদ্রসমাজের আদর্শ বিকৃত না হয়, সকল কালেরই এই দায়িত্ব।” (পঞ্চাশোৰ্দ্ধম)।
ভবিষ্যৎ নূতন সমাজ সৃষ্টির কাজে সাহিত্যপ্রতিভাকে উৎসর্গ করার জন্য রবীন্দ্ৰনাথ নবীন সাহিত্যিকদের আহবান জানালেন। বাল্যাবধি যে বৃহত্তর মানবিকতার আদর্শ রবীন্দ্ৰ মানসে স্পষ্ট হতে স্পষ্টতার হয়ে গড়ে উঠেছিল এ তারই ন্যায়সংগত পরিণতি। এরই এক বছর আগে “সাহিত্য সমালোচনা” প্রসঙ্গে তিনি বললেন—“আমাদের সব সাহিত্যের গোড়াতেই যে মহাকাব্য, স্পষ্টই দেখি, তার লক্ষ্য মানুষের দৈন্য প্রচার–মানুষের লজ্জা ঘোষণা করা নয়—তার মাহাত্ম্য স্বীকার করা।” এই একই কবি যখন আবার বলেন, বিশুদ্ধ সাহিত্য অপ্রয়োজনীয়, আনন্দ দেয়া ছাড়া সাহিত্যের আর কোন উদ্দেশ্য নেই, তখন এই কথাগুলিকে আগের কথার সংগে মিলিয়ে দেখতে হবে। মানুষের গৌরব মানুষের সকল সৃষ্টির মধ্যেই প্ৰতিভাত; মানুষ যা কিছু সৃষ্টি করেছে, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প, কলা, সাহিত্য সব কিছুর মধ্যেই এই একটি সাধারণ মিল রয়েছে-প্ৰত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে মানুষের সকল সৃষ্টি সকল বিদ্যা মানুষেরই বিজয় গৌরব ঘোষণা করেছে। সাহিত্যের কাজ আনন্দ দেওয়া, কিন্তু তার এই সাধারণ ধর্ম থেকে বিদ্যুত হয়ে সে কাজ করা সম্ভব নয়। সমাজের সংগে সাহিত্যের যে সম্বন্ধ তা মূলত এই গৌরবকে প্রতিফলিত করা, ভবিষ্যতের জন্য পরিবর্ধিত করা, পথের বাধাকে অপসারিত করার সম্বন্ধ। কদৰ্য্যতার দিকটাও সাহিত্যে প্ৰতিফলিত করা, ভবিষ্যতের জন্য পরিবর্ধিত করা, পথের বাধাকে অপসারিত করার সম্বন্ধ। কদর্য্যতার দিকটাও সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়, কিন্তু তা এই সৌন্দর্য্য ও গৌরবকে আরও ভাস্কর করার জন্য। সাহিত্য তার বিশেষ কারুকর্মের ভিতর দিয়ে, বক্ৰোক্তি, অলংকার, ব্যঞ্জনার ভিতর দিয়ে একাজটিই করে, তাই সে প্ৰকাশ পায় আনন্দরূপে; শৃঙ্গার, করুণ বীভৎস, ভয়ানক, রৌদ্র সব মিলিত হয় একটি আনন্দের স্বপ্ৰকাশ অনুভূতিতে। এখানে ম্যাকবেথ ও হামলেটেরও অত্যুচ্চ স্থান আছে। মানুষের গৌরবকে অবমাননা করলে তার পরিণতি কি সুকঠোর, আর সেই অবমাননার বিরুদ্ধে দুর্বার সাহসে সংগ্ৰাম করতে না পারলে তার পরিণতি কি মর্মান্তিক-সেই রহস্য অপূর্ব কলাকৌশলের সাহায্যে উদঘাটিত ক’রে ম্যাকবেথ আর হ্যামলেটও মানুষকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখানে আনন্দের প্রকাশ বেদনায় মধুর, কারণ ট্রাজেডি অন্তরাত্মাকে শুদ্ধ করার দাম দেয় বেদনার মধ্য দিয়ে।
তাই “আনন্দ দেওয়া ছাড়া সাহিত্যের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই” সাহিত্যের এই নিতান্ত বৈশিষ্ট্যগত তত্ত্বটিকে যখন মানবিক মূল্যবোধহীন সাহিত্যিকরা কফিন-সাহিত্য সৃষ্টির কাজে লাগিয়ে অনাসৃষ্টি শুরু করে, তখন কবিগুরুকেই রাশ টেনে ধরতে হয়, বলতে হয়-গোড়াঘাটের নোঙরটি ছিড়ে উধাও হয়ে না, জন্মাবধি মানুষের দুর্বার অগ্রগতির কথা ভুলো না, জড় প্রকৃতির উপর মানুষের জয়যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ভাবি জগতেও তার গৌরব? দীপ্ত অভিযানের কথা ভুলোনা। ‘মানুষ বিশ্ব প্ৰকৃতির অন্তর্গত।…কিন্তু সে পৃথিবী তার ইচ্ছার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিশ খায়নি, তাই আদিকাল থেকেই প্ৰাকৃতিক পৃথিবীকে মানব বুদ্ধিকৌশলে আপনি ইচ্ছানুগত মানবিক পৃথিবী করে তুলছে” – উপকরণ পাচ্ছে এই পৃথিবীরই কাছ থেকে, শক্তি ধার করছে। তারই গুপ্ত ভাণ্ডারে প্রবেশ করে। সেগুলিকে আপনি পথে আপন মতে চালনা করে পৃথিবীর রূপান্তর ঘটিয়ে দিচ্ছে।… মানুষের বিশ্বজয়ের এই একটা পালা বস্তু জগতে; ভাবের জগতে তার আছে আর একটা পালা। ব্যবহারিক বিজ্ঞানে একদিকে তার জয়ন্তম্ভ, আর একদিকে শিল্পে সাহিত্যে। যে দিন থেকে মানুষের হাত পেয়েছে নৈপুণ্য, তার ভাষা পেয়েছে অর্থ সেই দিন থেকেই মানুষ তার ইন্দ্ৰিয়বোধগম্য জগৎ থেকে নানা উপাদানে উদ্ভাবিত করেছে তার ভাবগম্য জগৎকে…কল্পনা দিয়ে তাকে এমন রূপ দিয়েছে, হৃদয় দিয়ে তাতে এমন রস দিয়েছে, যাতে সে মানুষের মনের জিনিষ হয়ে তাকে দিতে পারে আনন্দ” (সাহিত্যের তাৎপর্য্য)। কথাগুলি রবীন্দ্রনাথের—কোটেশন মার্ক না থাকলে মার্কস এঙ্গেলসের কথা বলেও মনে হতে পারতো।