উক্তি মাত্রই অতিশয়োক্তি বৌদ্ধদের এই চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমূহ বিপত্তি দেখা দেবে, প্ৰত্যেকটি মানুষের মুখে কাপড় গুজে চারদিকে এক একটি দেয়াল তুলে দিতে হবে। নইলে প্রত্যেকটি মানুষই মিথ্যাচারের দায়ে অভিযুক্ত হবে। অথচ আশ্চৰ্য্য, বৌদ্ধাচাৰ্য্য অশ্বঘোষ কাব্যনাটক পৰ্য্যন্ত লিখে ফেললেন। আমরা প্রসঙ্গটা আরম্ভ করেছিলাম ঠাকুর্দার গল্পের অতিশয়োক্তি দিয়ে । কোনও সাহিত্যিকের হাতে পড়লে এগল্পটি বেশ রসাল হয়ে উঠতে পারে। অনেক সময় অসাহিত্যিক সাধারণ লোকও সাৰ্থক অতিশয়োক্তি সৃষ্টি করে থাকেন। কোন প্রদেশে সাধারণ নিৰ্বাচন সুরু হবে। তখন ভারত সরকার প্রত্যেক প্রদেশে জলশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা পেশ করেছেন । আমাদের আলোচ্য প্রদেশটিতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রচুর সম্ভাবনা সত্ত্বেও কাজ তখনও কিছুই এগোয়নি। বিপক্ষদল মন্ত্রীদের নির্বাচনে ঘায়েল করতে চান। এক মন্ত্রীকে নিয়ে এক রসাল গল্প প্রচলিত হল—মন্ত্রীমহোদয় বক্তৃতা দিচ্ছেন—‘সমবেত সভ্যবৃন্দ, আপনারা জানেন আমরা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারিনি বলে বিরোধী পক্ষ আমাদের কঠোর সমালোচনা করছেন । কিন্তু আমরা বিরোধী পক্ষকে জিজ্ঞাসা করছি—দুধ থেকে মাখন তুলে নিলে দুধের কি থাকে ? অসার জল মাত্র! আমাদের প্রদেশের জল থেকে বিদ্যুৎ শক্তি তুলে নিলে শক্তিহীন জলমাত্র পড়ে থাকবে। ভেবে দেখুন বিরোধী পক্ষ কত বড় দেশদ্রোহী চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন। তারা আমাদের সমস্ত জলসম্পদকে নিবীৰ্য্য দুর্বল করে দিতে চান। এই চক্রান্ত সম্পর্কে আপনারা হসিয়ার থাকুন।” এজাতীয় গল্পে নির্বাচনী যুদ্ধের তীব্রতা ও তিক্ততার মধ্যেও একটু রসিকসুলভ মেজাজের সৃষ্টি করে। মীমাংসাশাস্ত্ৰ কথিত অর্থবাদের এ এক নবীন সরস সংস্করণ । এই গল্পটির কোনও স্বতন্ত্র প্রামাণ্য বা সত্যতা নেই। বিরোধী পক্ষ বলতে চান—মন্ত্রীরা মূঢ়। এজন্য বহু যুক্তিতর্কের মধ্যে এই গল্পটিও চালু করে দিলেন । গল্পটি লোকে বিশ্বাস করবে। এ তাদের ধারণা নয় । কিন্তু সামগ্রিকভাবে মন্ত্রীদের মুর্থতা প্রতিপাদনের জন্য এ এক সরস অতিশয়োক্তি যা শ্রোতৃবৃন্দ আন্তরিকভাবে বিশ্বাস না করে ও উপভোগ করেন। পূর্বমীমাংসকগণ বিধি ও অর্থবাদের মধ্যে যে সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন তার একটা গভীর লৌকিক তাৎপৰ্য রয়েছে। বৈদিক যাগ-যজ্ঞের লৌকিক প্রসঙ্গ থেকে সমাজের লৌকিক প্রসঙ্গে এই সম্বন্ধটি টেনে আনলে তার তাৎপৰ্য্য বোঝা যায়। তাৎপৰ্য্যটি এই যে সত্যাৰ্থপ্রকাশের বাহন হিসাবে ভাষার সার্থকতা বিচার করতে হলে শব্দ এবং অর্থ উভয়কেই সামগ্রিকভাবে গ্ৰহণ করতে হবে। সত্যের স্বরূপ সামগ্রিক, অর্থস্বরূপ সামগ্রিক, শব্দস্বরূপও সামগ্রিক। পূর্ণতাই সত্য এই ঔপনিষদিক সিদ্ধান্ত উজ্জ্বাসমােত্র নয়। বাক্যার্থবোধের বিচারে এই অখণ্ডার্থ উপলব্ধি করা সহজ। ‘বৃষ্টি পড়ছে’–এই বাক্যটির অর্থ এবং শব্দ বিশ্লেষণ করে আপনি বলতে পারেন-বৃষ, ধাতু, তি প্রত্যয়, প্রথম বিভক্তি, পড়া ধাতু, ছে৷ প্ৰত্যয়-এই সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি যোগ করে একটি বাক্য তৈরি হয়েছে, এদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা অর্থগুলো যোগ করে একটি বৃহৎ অর্থ তৈরি করা হয়েছে। এজাতীয় অর্থনির্মাণ ও বাক্যনিৰ্মাণ পদ্ধতি-বৈয়াকরণের বৈঠকখানায় প্রচলিত থাকতে পারে। কিন্তু নির্বোধ বালক বা প্রাজ্ঞ পণ্ডিত বস্তুজগতে বাক্যার্থ উপলব্ধির সময় এজাতীয় বিশ্লেষণী নৈপুণ্যের মারফত অর্থগ্রহণ করেন না, অর্থাৎ বাক্য ও অর্থ আমাদের উপলব্ধির ক্ষেত্রে পাটিগণিতের যোগফল নয়। একটি সমগ্ৰ বাক্যের সমগ্র একটি অর্থ আমরা একটি মানসিক প্রযত্বের দ্বারা অখণ্ড ভাবেই গ্ৰহণ করে থাকি। কর্তা, কর্ম, অধিকরণ, উদ্দেশ্য, বিধেয়, বিশেষ্যবিশেষণ, ধাতু, শব্দরূপ, প্রত্যয় ইত্যাদি বিশ্লিষ্ট রূপগুলির সংশ্লেষণের দ্বারা যদি পদে পদে অর্থাহরণ করতে হত তাহলে সমাজ-জীবন একদিনে আচল হয়ে পড়ত। বৃষ্টি পড়া একটি ঘটনা যা বৃষ্টি-রূপী কর্তার সঙ্গে পড়া’ ধাতুর অর্থযোগ করে তৈরী হয়নি। অপণ্ডিতের সহজ সামগ্রিক অর্থবোধকে পববর্তীকালে পণ্ডিতেরা বিশ্লেষণ করেন এবং মনে করেন যে বোধবিধৃত অর্থটিই বােধ হয় সংশ্লিষ্ট অংশগুলির যোগফল রূপে তৈরী হয়েছে। “নীল শাড়ীটা নিয়ে আয়’ বললে ‘নীলরূপ বিশেষণের দ্বারা বিশিষ্ট একটি তত্ত্ববিন্যাসময় পরিধেয় বস্তু আমাকে আনতে বলা হল”। এই মনে করে আপনার মেয়েটি শাড়ী আনতে ছুটবে না। পণ্ডিতেরা অনেক সময় নিজেদের চাতুৰ্য্যের দ্বারা নিজেরাই প্ৰতারিত হন, বিশ্লেষণী প্ৰতিভার দ্বারা অখণ্ডকে খণ্ডিত করেন আর মনে করেন ইটের ওপর ইট চাপিয়ে ইমারত তৈরির মত খণ্ড খণ্ড শব্দার্থ জোড়া দিয়েই একটি সমগ্ৰ শব্দার্থ তৈরী হয়ে থাকে। যদি বলা হয়। অর্থবোধের সময় আমরা খণ্ডগুলিকে খুঁজে পাইনা কেন, অনুভব করিনা কেন, তারা উত্তর দেন, ‘আছে বুঝতে পারছিনা। ন্যায় ব্যাকরণ পড়লে বুঝতে পারবে।” অনেকটা ‘চিকিৎসা-সংকটের” কবিরাজ মহাশয়ের ‘হয়, জানতি পারো না’ গোছের উত্তর হল।
পাণিনি ব্যাকরণের দার্শনিক সম্প্রদায় কিন্তু এ বিষয়ে খুবই স্পষ্টবাদী। তারা স্পষ্ট বলে দিলেন–বাক্যের অখণ্ড রূপ এবং অর্থের অখণ্ড রূপটাই সত্য। খণ্ডাংশগুলি এই অখণ্ড সত্তাকেই অভিব্যক্ত করে মাত্র। অংশগুলির স্বতন্ত্র সত্তা সত্য নয়, সামগ্রিক সত্যের প্রকাশে অংশগ্রহণ করে বলেই অংশগুলির সার্থকতা। আধুনিক ভাবনায় সমাজ ও ব্যক্তির সম্বন্ধ নির্ণয়ে এই সমগ্ৰতাবাদ অধিক প্রযোজ্য। সামাজিক চিন্তা চেতনা ও কর্মে অংশ গ্ৰহণ করেই ব্যক্তিসত্তা। সার্থকতা লাভ করে। সামাজিক সম্বন্ধের দ্বারাই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। সুতরাং কতগুলি স্বতন্ত্র ব্যক্তির যোগফল হিসাবে সমাজ গড়ে ওঠেনি। বাক্যার্থ বিচারে পাণিনীয় সমগ্ৰতাবাদ “পূর্ণতাই সত্য।’ এই ঔপনিষদিক সিদ্ধান্তের প্রতিফলিত রূপান্তর মাত্র। সমগ্রতাকে অস্বীকার করলে বাক্যার্থবোধ অসম্ভব হয়ে পড়ে-ধরুন ‘আকাশকুসুম নাই’; একটি বাক্য। এখানে খণ্ডাৰ্থ যোগ করে সমগ্র অর্থটি নির্মাণ করার চেষ্টা করে দেখুন প্রথম ধরুন ‘আকাশকুসুম’ শব্দটির একটি আলাদা অর্থ আছে। এই অর্থটি কি নাই? অর্থ যদি আছেই। তবে নাই বলছেন কাকে? আর অর্থই যদি নাই, তবে “নাই” ক্রিয়ার কর্তা কে?। আকাশকুসুম শব্দটির অর্থ না থাকলে সমগ্ৰ বাক্যটিই তো নিরর্থক হয়ে পড়বে। অথচ এর স্পষ্ট অর্থ তো আমরা অনুভব করি। যদি বলেন আকাশকুসুম শব্দটির একটি মানসিক ধারণাগত অর্থ আছে, কিন্তু সে অর্থটি বাইরে নাই, তাহলেও আকাশকুসুম ‘নাই’ ক্রিয়ার কর্তা হতে পারে না, কারণ বুদ্ধিগত ধারণাটা সত্যিই আছে। যদি বলেন “ধারণা ব্যাতিরিক্ত বস্তুস্বরূপ নাই’ বিপদ আরও বেড়ে যাবে, কারণ যা নিঃস্বরূপ তা ক্রিয়ার কর্তৃত্বস্বরূপ লাভ করতে পারে ন। তাই কর্তা নিঃস্বরূপ হলে “নাই” এই ক্রিয়াপদটি নিরর্থক। এইরূপে ‘বইটি আছে’ বা “বইটি নাই’ প্ৰভৃতি যে কোন বাক্যকে বিশ্লেষণ করে দেখানো সম্ভব যে খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করলে সমগ্ৰ বাক্যার্থটি ব্যর্থতায় বিলীন হয়ে যাবে। এই জটিল কুটিল তর্ক তর্কের খাতিরেই করা হচ্ছে না। এ কথাটাই দেখাবার চেষ্টা করা হচ্ছে যে আমাদের বুদ্ধির সহজ স্বভাব সমগ্ৰতামুখী। খণ্ড-সত্যবাদী বার্ট্রাণ্ড রাসেল তাই বিপদে পড়ে বললেন, ‘A does not exist’-এই বাক্যটির কর্তা A কোনো না কোনো রকমে অবশ্যই আছে, না হলে বাক্যের কর্তা হ’ল কিরূপে? আমরা কিন্তু সমগ্রতাবাদী পাণিনীয় দর্শন অনুসারে বলতে পারি-আমাদের অনুভব-ধূত বাক্যার্থটি সমগ্ৰ অখণ্ড। এ অখণ্ডত। আপামর পণ্ডিতজনের অনুভবসিদ্ধ। পণ্ডিতের পরিতৃপ্তির জন্য এই সামগ্রিক বোধকেও বিশ্লেষণ করে পাণ্ডিত্য প্ৰকাশ সম্ভব। কিন্তু সে প্রচেষ্টা থেকে সম্প্রতি আমাদের বিরত থাকতে হবে। পারিপাশ্বিকের সঙ্গে একাত্মতা অনুভবের দ্বারা শিশুমানসেও সমগ্র বাক্যার্থবোধ কিভাবে জাগ্রত হয় সে বিষয়টি কুতুহলী গবেষকের অনুসন্ধিৎসার উপযুক্ত লক্ষ্য হতে পারে।