একই জিনিষকে অন্য দিক থেকে দেখা যাক, সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্ৰনাথ উপনিষদের তত্ত্ব কি অর্থে বুঝেছেন, উপনিষদ সম্পর্কে আমাদের প্রাচীন ব্যাখ্যা কারদে ধারণা থেকে রবীন্দ্ৰনাথের ধারণা যে কত স্বতন্ত্র-সে কথাটাও বোঝা যাবে। “উপনিষদ ব্ৰহ্মস্বরূপের তিনটি ভাগ করেছেনসত্যম্, জ্ঞানম, অনন্তম।” রবীন্দ্ৰনাথ বলছেন সত্যেরই তিনটি দিক –I am, I know, I express। “আমি আছি”, এর ব্যাখ্যা করলেন–‘টিকতে হবে তাই অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, বাসস্থান চাই, স্বাস্থ্য চাই।” বলা বাহুল্য ঔপনিষদিক সত্যের এ ব্যাখ্যা কোনও প্রাচীন ব্যাখ্যাকারের ভিতর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আরও এগিয়ে চলুন—“যে পরিমাণে মানুষ বলে অন্যের টিকে থাকার মধ্যেই আমার টিকে থাকা সেই পরিমাণে সে নিজের জীবনের মধ্যে অনন্তের পরিচয় দেয়, সেই পরিমাণে “আমি আছি’ এবং “অন্য সকলে আছে’ এই ব্যবধানটা তার ঘুচে যায়।” এরই নাম অনন্তের আস্বাদ, এর থেকেই আসে প্রকাশের প্রেরণা,-“যেখানে একলা মানুষ সেখানে তার প্রকাশ নেই। এই প্ৰকাশেই আনন্দ। সাহিত্য এই অনন্তের প্রকাশের ভিতর দিয়ে আনন্দ দেয়।” এই সাহিত্যের ব্যাখ্যাকে রবীন্দ্ৰনাথ কোথায় টেনে গিয়ে গেলেন তা লক্ষ্য করার মত। টাকার ঐশ্বৰ্য্য কোথায়?-যখন “সে কোনো একজন অমুক বিশেষ লোকের ভোগ্যতার মলিন সম্বন্ধ হতে মুক্ত হয়। অশেষের প্রসাদ বঞ্চিত সেই বিশেষ ভোগ্য টাকার বর্বরতায় বসুন্ধরা পীড়িত …টাকা যখন १८छद्ध वाश्न श्न उ२न তার চাকার তলায় কত মানুষ ধূলিতে ধুলি হয়ে যায়- “টিটাগড়ের পাটকলের কারখানায় যে মজুরেরা খেটে মরে তারা মজুরি পায়। কিন্তু তাদের হৃদয়ের জন্যে তো কারও মাথাব্যথা নেই। তাতে তো কল বেশ ভালই চলে। যে মালিকেরা শতকরা ৪০০ টাকা হারে মুনাফা নিয়ে থাকে, তারা ত। মনোহরণের জন্য এক পয়সাও অপব্যয় করে না।” বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যতত্ত্বের উপর গভীর বক্তৃতা দিতে গিয়ে কবিগুরু এ সব কি কথা বলছেন, উপনিষদের কথা দিয়ে আরম্ভ করে তিনি কোথায় চলে যাচ্ছেন? সাহিত্য ও শিল্প কলার “আসল কথা হচ্ছে এই যে, তারা আনন্দের ঐশ্বৰ্য্যকে প্ৰকাশ করেছে, প্রয়োজনের দৈন্যকে করেনি। সেই দৈন্যের রূপটা যদি দেখতে চাও তবে পাটকলের কারখানায় গিয়ে ঢোকো, যেখানে গরিব চাষীর রক্তকে ঘূনীচাকার পাক দিয়ে বহু শতকরা হারের মুনাফায় পরিণত করা হচ্ছে।” এই সব উদ্ধৃতিগুলিই “সাহিত্য” প্ৰবন্ধ থেকে। কিন্তু প্ৰবন্ধের উপসংহার হলো–“সেই আনন্দের মধ্যেই যখন প্ৰকাশের তত্ত্ব তখন এ প্রশ্নের কোনো অর্থই নেই যে আর্টের দ্বারা আমাদের কোনো হিতসাধন হয় কিনা।” এখানে ‘হিতসাধন” কথাটি রবীন্দ্ৰনাথ কি অর্থে গ্ৰহণ করেছেন তা বুঝতে হলে আরও এগিয়ে যেতে হবে। ‘সৃষ্টি” প্ৰবন্ধটির দিকে নজর দেয়া যাক-“মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচয় হচ্ছে, মানুষ সৃষ্টিকর্তা, আজকের দিনের সভ্যতা মানুষকে মজুর করেছে, মিস্ত্রি করেছে, মহাজন করেছে, লোভ দেখিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে খাটো করে দিচ্ছে …কোনখানে মানুষের শেষ কথা? যা সৌন্দৰ্য্যের সম্বন্ধ, কল্যাণের সম্বন্ধ, প্রেমের সম্বন্ধ, তারই মধ্যে, সেইখানেই মানুষের সৃষ্টির রাজ্য। …যেখানে একজন ধনী দশজনকে শোষণ করেছে, যেখানে হাজার হাজার মানুষের স্বাতন্ত্র্যকে হরণ করে একজন শক্তিশালী হচ্ছে, যেখানে বহু লোকের ক্ষুধার অন্ন একজন লোকের ভোগবাহুল্যে পরিণত হচ্ছে, সেখানে মানুষের সত্যরূপ শান্তিরূপ আপন সুন্দর সৃষ্টির মধ্যে প্ৰকাশ পেল না।” এই বক্তব্যের সঙ্গে ‘সাহিত্য” প্ৰবন্ধের উপসংহারী মন্ধব্যটির সংগতি কোথায়? প্ৰবন্ধগুলি সামগ্রিকভাবে পড়লেই সংগতি ধরা পড়ে। সাহিত্য বা আর্টের মধ্যে সৃষ্টি ও উপভোগের আনন্দটাই তার স্বকীয়তা। হিতসাধন করব বলে সাহিত্য শাস্ত্রবার্তার আসরে নেমে আসে না। কিন্তু সমাজে যখন বিপুল অহিত জমে ওঠে, একজনের ব্যক্তিহিতের স্বার্থে যখন সমষ্টির হিতস্বর্থ পদদলিত হয়, তখন এই পরম অকল্যাণের ভূমিতে সাহিত্যের রাসব্যক্তি পূর্ণ হতে পারে না, যদি তার “সাধারণীকৃতি” সার্থক না হয়। আর সাধারণীকৃতি সার্থক হতে পারে না। যদি তার কল্যাণের ভূমিকা না থাকে। এ কল্যাণের ভূমিকা কোনো প্ৰতিজ্ঞাপত্ৰ স্বাক্ষর করে আসে না। কল্যাণ করব বলে নোটিশ দিয়ে আসে না। কিন্তু যিনি আনন্দলোকের স্রষ্টা তার দরদীমন পদদলিত সামগ্রিক মানবতার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে, যেমন করেছিল কন্যা শোকাতুর মোমিন মিঞার সঙ্গে। এই ব্যাপক সাধারণীকৃতির পিছনে থাকে বৃহত্তম মানবিকতার আবেদন, অন্যের বাঁচার ভিতর দিয়েই আমি বাঁচি, এই পরম সত্যের প্রকাশ। হৃদয়ের বিপুল প্রসারজনিত আনন্দের মধ্যে বেদনাও তখন, মধুর হয়ে মিশে যায়–সাহিত্যের স্রষ্টা, উপভোক্তা ও সাহিত্যের জীবন্ত মানুষগুলি একাত্ম হয়ে মিশে যায়। এই একাত্মীয়তারই নাম সহস্ৰদয়ত। উপনিষদের আধ্যাত্মিক সত্যকে রবীন্দ্ৰনাথ যেমন মানবিক সত্যে পরিণত করলেন, সঙ্গে সঙ্গে প্ৰাচীন আলঙ্কারিকদের অলৌকিক সাধারণীকৃতি ও সহৃদয়তাকেও প্রসারিত করলেন মানবলোকে। “আমি আছি এবং আর সমস্ত আছে, আমার অস্তিত্বের মধ্যে এই যুগল মিলন। আমরা বাইরে যদি কিছুই অনুভব না করি তবে নিজেকেও অনুভব করিনে। বাইরের অনুভূতি যত প্ৰবল হয়। অন্তরের সত্তাবোধ ও তত জোর পায়। আমি আছি, এ সত্যটি আমার কাছে চরম মূল্যবান। সেই জন্য যাতে আমার সেই বোধকে বাড়িয়ে তোলে তাতে আমার আনন্দ। বাইরের যে কোনো জিনিসের “পরে আমি উদাসীন থাকতে পারিনে” (সাহিত্যতত্ত্ব)। রবীন্দ্রসাহিত্যতত্ত্বের মূল কথা— “উদাসীন থাকতে পারিনে?” এই কথাটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে। যে উদাসীন সে একক নিঃসঙ্গ, তার সংকুচিত ব্যক্তিত্বের ভারে সে অবনত, সে অনায়াসে লোভের কাছে আত্মবিক্রয় করে, পরকে পীড়ন করে আপনার শূন্য ব্যক্তিত্ব পূর্ণ করার চেষ্টা করে, তার ফলে ব্যাপক মানবতা থেকে আপনাকে আরও বেশী বিচ্ছিন্ন করে, তার একাকিত্বের দৈন্যকে আরও দুর্বাহ করে তোলে। তাই, যে সাহিত্য স্পর্ধিত একাকিত্বের সাধনা করে তার রস ব্যক্তি অপূর্ণ ও বিকৃত। মূল্যবোধহীন বিকৃত একক মানুষের আন্তরিক ও সামাজিক দৈন্তের ক্ষুধিত চেহারাটাই সে সাহিত্যেনৈর্ব্যক্তিক গৌরবের ঘোমটা পরে আত্মপ্রকাশ করে। ঐটুকুই তার সার্থকতা। কিন্তু তার রসবোধে ব্যাপ্তিও নেই, গভীরতাও নেই। প্রশ্ন উঠতে পারে ব্যাক্তি না থাক, গভীরতা থাকতে বাধা কি? সাহিত্যরস কুয়ার জলের মত নয় যে ব্যাপ্তি না হলেও গভীরতা থাকতে বাধা নেই। সাহিত্যরসের কথা বাদই দিলাম, স্কুল রসগোল্লার রসবোধও গভীর হতে পারে না। যদি তার ব্যাপ্তি না ঘটে। যে রসগোল্লা খেতে ভালবাসে সে যদি একা এক নিভৃত কোণে বসে গপগপ গিলতে থাকে। তার রসনা রসের তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু যখন দশজনে সভায় বসে তাকে আদরে ও আনন্দে খাওয়ায় তখন তার রসনার রসাতৃপ্তিও গভীর হয়। কারণ সামাজিক শ্ৰীতি ও সৌজন্যের ভিতরে সে তৃপ্তি ছড়িয়ে পড়ে। “আধুনিক কাৰ্য” প্ৰবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যে আধুনিক কবিদের নকল নৈর্ব্যক্তিকতার স্বরূপ উদঘাটিত করলেন তারা এই মানবিক মূল্যহীন একাকিত্বের সাধক। তাদের তিনি নাম দিলেন অঘোরপন্থী। সমাজের গলিত শবটাকে কথার তোড়ায় সাজিয়ে সদর রাস্তায় বের করাতেই আনন্দ। যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, ততঃ কিম। তার উত্তরের প্রয়োজন নেই। মানুষটা যে একদিন বেঁচেছিল তাও মিথ্যা, ভবিষ্যতে যে মানুষ বাঁচবে তাও মিথ্যা, মাঝখানের ঐ শবটাই সত্য, কারণ ও পথ জুড়ে পড়ে আছে। কফিন সাজাবার ভিতরেও শিল্প আছে, কিন্তু সব শিল্প যদি কফিন-সাজাতেই শেষ হয়ে যেত, জীবন্ত মানুষের জন্য যদি কিছুই বাকী না থাকত, তবে কফিন শিল্পটা ও গড়ে উঠত না, কারণ ওটা জীবনশিল্পের উচ্ছিষ্ট দিয়েই তৈরী।