এর কিছু পরেই মুক্তধারার আবির্ভাব। কিন্তু এই প্ৰবন্ধগুলি যে পিছনের পটভূমি তৈরী করেছে মুক্তধারার তাৎপৰ্য্যকে তা থেকে বিচ্ছিন্ন করা কি রসবোধের সহায়ক হবে? মুক্তধারার প্রতিবাদ যন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়, এ প্ৰতিবাদ তাদেরই বিরুদ্ধে যারা উছিত অহঙ্কারে, শক্তির স্পর্ধায় যন্ত্রশক্তির অপপ্ৰয়োগ করেছে, শিবতারাইয়ের কৃষকদের জীবিকার জল থেকে বঞ্চিত করেছে। কলসী, গলায় বেঁধে যে আত্মহত্যা করল তার দুৰ্গতির জন্য কলসীটাকেই দায়ী করার মত অবিবেচক বোধ হয়। রবীন্দ্ৰনাথ ছিলেন না। পাশাপাশি প্ৰবন্ধগুলির ভিতরে রবীন্দ্রনাথের যে বুদ্ধিদীপ্ত প্রখর সামাজিক অনুভূতি স্পষ্টভাবে আত্মপ্ৰকাশ করেছে সমসাময়িক নাটকগুলিকে তাঁর জ্যোতিঃস্পর্শ থেকে আড়াল করে দেখবার চেষ্টা করলে ভারতীয় আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের গৌরব কতখানি রক্ষা পায় জানি না, কিন্তু রবীন্দ্ৰনাথের গৌরব নিশ্চয়ই রক্ষা পায় না।
সবচেয়ে মজার কথা হ’ল, যে পশ্চিমীবিকারগ্রস্ত আধুনিক কবি রবীন্দ্ৰ মানসকে পশ্চিমী সভ্যতার সন্তান বলে প্ৰমাণ করতে উদ্ব্যস্ত, আর যারা পশ্চিমের ‘জড়বাদ” বিরোধী নির্ভেজাল ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার একনিষ্ঠ ধারক ও বাহক বলে রবীন্দ্রনাথকে চিহ্নিত করতে ব্যতিব্যস্ত তাদের দুই বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গী। কিন্তু একটা জায়গায় এসে মিলে গেছে-মিলনটি হয়েছে এক নৈর্ব্যক্তিক নির্বিশেষ অনুভূতিসর্বস্ব সাহিত্যতত্ত্বে। জানিনা এ হেগেলীয় দর্শনের Identity of oppcsites-এর একটি উদাহরণ কিনা।
২
সাহিত্যতত্ত্ব সম্পর্কে রবীন্দ্ৰনাথের নিজের কি ধারণা ছিল, সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর তত্ত্বগত মত কি ছিল-এ প্রশ্নে এখন আমরা স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়েছি। সাহিত্যতত্ত্বের আলোচনায় রবীন্দ্ৰনাথ বার বার উপনিষদ আবৃত্তি করেছেন, ঔপনিষদিক তত্ত্বের সঙ্গে সাহিত্যতত্ত্বকে মিলিয়ে দেখার অনেক রকম চেষ্টা করেছেন; সৃষ্টির আনন্দ, প্ৰকাশের আনন্দ, অনির্বচনীয়, আপনাতেই আপনি সার্থক, প্রয়োজন ও উদ্দেশ্যের অতীত-এ জাতীয় শব্দপ্রয়োগ অনেক জায়গায় অনেকবার করেছেন। এর থেকে নৈর্ব্যক্তিক নির্বিশেষ রসাতত্ত্বের সাধনাই সাহিত্যের সাধনা-ইহাই রবীন্দ্রনাথের চুড়ান্ত মত বলে ধরে নেয়ার পিছনে যুক্তি আছে সন্দেহ নেই। রবীন্দ্ৰনাথ বলেছেন‘বলাবাহুল্য, বিশুদ্ধ সাহিত্য অপ্রয়োজনীয়; তার যে রন্স সে অহেতুক। মানুষ সেই দায়মুক্ত বৃহৎ অবকাশের ক্ষেত্রে কল্পনার সোনার কাঠি ছোওয়া সামগ্রীকে জাগ্রত করে জানে আপনারই সত্তায়। তার সেই অনুভবে অর্থাৎ আপনারই বিশেষ উপলব্ধিতে তার আনন্দ। এই আনন্দ দেওয়া ছাড়া সাহিত্যের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে ব’লে জানি নে” (সাহিত্যের পথে—সাহিত্যতত্ত্ব, পৃ ১২৫)। সাহিত্যের ভিতরে আমরা চোখের জলের মধ্যে দিয়েও একটা অনির্বচনীয় আনন্দ পাই, সাহিত্যের এই আনন্দময় উপভোগ্যতাই তার বৈশিষ্ট্য, এমত আমাদের প্রাচীন আলঙ্কারিকরা অনেক সূক্ষ্ম যুক্তি দিয়ে প্ৰতিপন্ন করেছেন। তাই করুণ, ভয়ানক, রৌদ্র, বীভৎস, সবই রস। মূল ভাব যাই থাকুক, সাহিত্যের পদবীতে উত্তীর্ণ হলে তা রসরূপে আনন্দ-স্বরূপে অভিব্যক্ত হয়। এরিষ্ট্যোটেল বলবেন, চোখের জলের ভিতর দিয়ে শুধু আমাদের চোখের ময়লাটাই কাটে না, অন্তরের ময়লাটাও কেটে যায়, অন্তর প্রসন্ন হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল সাহিত্যের সকল তত্ত্ব কি এই রস-স্বরূপেই নিঃশেষিত হয়ে যায়? এই কি রবীন্দ্ৰনাথের মত? সাহিত্যের সৃষ্টি বা উপভোগের আনন্দ নিশ্চয়ই দুমুল্যের বাজারে সস্তায় ভাল মাছ পাওয়ার আনদন, বা ফাটকাবাজারে দাও মারার আনন্দের সমগোত্রীয় নয়। তা হলে এ হ’ল সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যের দিক। কিন্তু বৈশিষ্ট্যটাই একমাত্ৰ তত্ত্ব নয়, তত্ত্বের উপরিভাগ, উপরিতলার অংশ। সমাজবদ্ধ মানুষের ভাবনার মাধ্যমে অন্যান্য শাস্ত্ৰ। যেমন মানুষের সমাজেই জন্মগ্রহণ করে, সাহিত্যেরও তেমনি জন্মভূমি হ’ল মানুষের সমাজ। এই জন্মভূমিটাই হ’ল সাহিত্যের সাধারণ বা অবিশিষ্ট দিক। এই ভিত্তিভূমির সঙ্গে উপরিতলার রসভূমির সম্বন্ধ নিরূপণ করতে না পারলে সাহিত্যতত্ত্বের মূলোচ্ছেদ ঘটার আশঙ্কা আছে। এ সম্পর্কে রবীন্দ্ৰনাথের বক্তব্য কি-তাই আমাদের আলোচ্য।
ঐ সাহিত্যতত্ত্ব প্ৰবন্ধ থেকেই কবির নিজের দেয়! একটি উদাহরণ দেখা যাক। কবির নিজের জীবনেরই ঘটনা। ভৃত্য মোমিন মিঞা অনেক দেরী করে বেলা দশটায় বাড়ী থেকে এল। কবি একটু রূঢ়স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন—কোথায় ছিলি। “সে বললে—‘আমার মেয়েটি মারা গেছে কাল রাতে।’ বলেই ঝাড়ন নিয়ে নিঃশব্দে কাজে লেগে গেল। বুকটা ধাকু করে উঠল। ভৃত্যরূপে যে ছিল প্রয়োজনীয়তার আবরণে ঢাকা তার আবরণ উঠে গেল। মেয়ের বাপ ব’লে তাকে দেখলুম, আমার সঙ্গে তার স্বরূপের মিল হয়ে গেল; সে হল প্ৰত্যক্ষ, সে হল বিশেষ”। “সেদিন করুণ রসের ইঙ্গিতে গ্ৰাম্য মানুষটা আমার মনের মানুষের সঙ্গে মিলল। প্রয়োজনের বেড়া অতিক্রম করে কল্পনার ভূমিকায় মোমিন মিঞা আমার কাছে হল ৰাস্তব” (সাহিত্যতত্ত্ব)। এখানে রবীন্দ্ৰনাথ প্রয়োজনের অতীত বলতে কি বুঝিয়েছেন? প্ৰভু ও ভূত্যের যে ভেদবুদ্ধিটা সৃষ্টি হয়েছিল ব্যক্তিম্বার্থের তাগিদে, তাকে অতিক্রম করে অভেদ বুদ্ধিটাই বড় হয়ে উঠল, ব্যক্তি ছড়িয়ে পড়ল সমাজের মানুষের মধ্যে। সপ্তানশোকাতুয় পিতৃঙ্গেই এক সাধারণ অনুভুতির ভূমিতে প্ৰভু আর ভৃত্যকে মিলিয়ে দিল। সাহিত্যের সবচেয়ে বড় কাজ এই “সাধারণীকৃতি’। ব্যক্তিস্বার্থের গণ্ডীকে ছাপিয়ে যায় বলে এ প্রয়োজনাতীত, কিন্তু মানুষ হিসাবে এর চেয়ে বড় প্ৰয়োজন বোধ হয়। আর কিছুই নেই।