সুতরাং যারা রবীন্দ্ৰনাথ পশ্চিমী সভ্যতার প্রেমে পড়েননি বলে স্বস্তি পেয়েছেন, তারা আরও নিশ্চিন্ত হলেন। পশ্চিমী সভ্যতা মানে জড় বিজ্ঞানের, যন্ত্রবিজ্ঞানের সভ্যতা। রবীন্দ্ৰনাথের রক্তকরবীতে এই সভ্যতার পরাজয় ঘটেছে, কৃষিনির্ভর তপোবনের শান্তির বাণী আবার ভারতবর্ষে ফিরে এসেছে কবিঋষির কণ্ঠে। এই তো রবীন্দ্ৰনাথ, উপনিষদের রবীন্দ্ৰনাথ যার সাহিত্যতত্ত্বের ছত্ৰে ছত্ৰে উপনিষদের তত্ত্ব প্ৰতিফলিত। কিন্তু বাদ সাধলেন। স্বয়ং রবীন্দ্ৰনাথ। কাব্য ও নাটকে কবি নিজে থাকেন। অন্তরালে, কিন্তু প্ৰবন্ধের ভিতরে তিনি প্ৰত্যক্ষ আত্মপ্রকাশের সুযোগ পান সকলের প্রসারিত দৃষ্টির সম্মুখে। রক্তকরবী প্ৰথম প্ৰকাশিত হয় ১৩৩১ সালে আশ্বিনের প্রবাসীতে। এক বছর পরে যখন কবি, তার ইংরেজী ভাষ্য রচনা করলেন, ঐ একই সময় তিনি লিখলেন তার বিখ্যাত “চরকা” প্ৰবন্ধ। সে প্ৰবন্ধে কবির বক্তব্য শোনা যাক-“য়ুরোপীয় সভ্যতায় বিজ্ঞান চর্চার সামনে যদি কোনো বড়ো নৈতিক সাধনা থাকে। সে হচ্ছে বাহু-প্ৰকৃতির হাতেীয় সব রকম মায় থেকে মানুষকে মাচানো, আয় হচ্ছে মানুষেরই মনটাকে যন্ত্রে না বেঁধে প্ৰাকৃতিক, শক্তিকেই যন্ত্রে বেঁধে সমাজের কাজ আদায় করা। এ কথা নিশ্চিত যে বিজ্ঞানকে একপাশে ঠেলে রেখে কেবল হাত চালিয়ে দেশের বিপুল দারিদ্র্য কিছুতে দূর হতে পারে না। মানুষের জানা এগিয়ে চলবে না, কেবল তার করাই চলতে থাকবে, মানুষের পক্ষে এত বড় কুলিগিরির সাধনা আর কিছুই নেই।–বিজ্ঞান মর্ত্যলোকে এই বিষ্ণুচক্রের অধিকার বাড়াচ্ছে একথা যদি ভুলি, তাহলে পৃথিবীতে অন্য যে সব মানুষ চক্রীর সম্মান রেখেছে তাদের চক্রান্তে আমাদের মরতে হবে।” আধুনিক যন্ত্রবিজ্ঞানের সাধনায় দেশের মানুষকে যে কবি এমন করে আহ্বান জানালেন ঐ একই মুহুর্তে তিনি আবার নাটকে ও ভাষ্যে যন্ত্রবিজ্ঞানকেই ধিক্কার দিলেন কেমন করে? তাই রক্তকরবীর মর্ম নিহিত রয়েছে ঐ প্রবন্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ কথার ভিতরে-“মানুষেরই মনটাকে যন্ত্রে না বেঁধে, প্ৰাকৃতিক শক্তিকেই যন্ত্রে বেঁধে সমাজের কাজ আদায় করা”। পশ্চিমী সভ্যতার দোষটা তা হলে বিজ্ঞান ও যন্ত্রের নয়, দোষটা হল সংগঠিত ধনিক সভ্যতার দুরন্ত লোভের, যার ফলে বিষ্ণুচক্রের আশীৰ্বাদ মানুষের অভিশাপে পরিণত হয়েছে, মানুষের মনটাকেই যন্ত্রে বাধা হয়েছে। মুক্তি চাই যন্ত্রবিজ্ঞানের হাত থেকে নয়, ঐ দুরন্ত লোভের হাত থেকে। এ ছাড়া কোন সংগত অর্থ আর রক্তকরবীর হতে পারে না।
মুক্তধারা সম্পর্কে ও ঐ একই কথা খাটে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ধিক্কারটা যন্ত্রের উপরেই বাৰ্ষিত হয়েছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখতে হয় মুক্তধারা থেকে রক্তকরবী পৰ্যন্ত সময়টাতে পাশাপাশি একটি স্বচ্ছ দ্ব্যর্থহীন প্ৰবন্ধের ধারাও চলেছে-‘শিক্ষার মিলন’ থেকে “স্বরাজ। সাধন” পৰ্য্যন্ত। বিশেষ করে ‘শিক্ষার মিলনের’ ভিতরে রবীন্দ্রনাথ পূর্ব-পশ্চিমের যে মিলনের আদর্শ তুলে ধরলেন তা দৃষ্টির প্রসন্নতা ও বুদ্ধির প্রখরতায় অতুলনীয়। উপনিষদীয় নির্লোভ আত্মিক সাধনার সঙ্গে পাশ্চাত্য বস্তুবিজ্ঞানের সাধনাকে মিলাতে হবে, না হলে মানুষ সম্পূর্ণ হবে না। পাশ্চাত্য সভ্যতার বিজ্ঞান সাধনাকে তিনি মুক্ত হৃদয়ে আশীৰ্বাদ জানালেন, ধিক্কার দিলেন তার শক্তিমত্ত লালসাকে, যাকে আধুনিক ভাষায় বলে পুজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। -“মানুষের বুদ্ধিকে ভূতের উপদ্রব এবং অদ্ভুতের শাসন থেকে মুক্তি দেবার ভার যে পেয়েছে, তার বসিাটা পূর্বেই হোক আর পশ্চিমেই হোক তাকে ওস্তাদ বলে কবুল করতে হবে।–সেই আধিভৌতিক রাজ্যের প্রধান বিদ্যাটা আজ শুক্রাচাৰ্য্যের হাতে। ” সেই বিদ্যাটার নাম সঞ্জীবনী বিদ্যা। সেই বিদ্যার জোরে সম্যকরূপে জীবন রক্ষা হয়, জীবন পোষণ হয়, জীবনের সকল প্রকার দুৰ্গতি দূর হয়ে থাকে; অন্নের অভাব, বস্ত্রের অভাব, স্বাস্থ্যের অভাব মোচন হয়; জড়ের অত্যাচার, জন্তুর অত্যাচার থেকে এই বিদ্যাই রক্ষা করে। এই বিদ্যা যথাযথ বিধির বিদ্যা, এ যখন আমাদের বুদ্ধির সঙ্গে মিলবে, তখনই স্বাতন্ত্র্যলাভের গোড়াপত্তন হবে-অন্য উপায় নেই।” “অমৃত লোকের ছাত্র কচকেও এই বিদ্যা শেখাবার জন্যে দৈত্যপাঠশালার খাতায় নাম লেখাতে হয়েছিল।” কিন্তু “পশ্চিমী সভ্যতার অন্তরাসনে লোভ, রাজা হয়ে বসেছে।” “ফললাভের লোভে ব্যবসায়িকতাই যদি মানুষের মধ্যে প্ৰবল হয়ে ওঠে। তবে মানব সমাজ প্ৰকাণ্ড প্ল্যান হয়ে উঠতে থাকে,… …তখন ধন হয় সমাজের রথ, ধনী হয় রখী, আর শক্ত বাধনে বাধা মানুষগুলো হয় রথের বাহন।” এর কিছুদিন পরের প্রবন্ধ “সত্যের আহ্বানে’ও রবীন্দ্ৰনাথ একই কথা অন্য প্রসঙ্গে বললেন- “স্বরাজ গড়ে তোলার তত্ত্ব বহুবিস্তৃত…যাঁরা অর্থশাস্ত্ৰবিৎ তাদের ভাবতে হবে, যারা যন্ত্রতত্ত্ববিৎ তাদের খাটতে হবে, শিক্ষাতত্ত্ববিৎ রাষ্ট্রতত্ত্ববিৎ সকলকেই ধ্যানে ও কর্মে লাগতে হবে।” “বড়ো কলের দ্বারাও মানুষকে ছোট করা যায়, ছোট কলের দ্বারাও করা যায়। এঞ্জিনের দ্বারা ও করা যায়, চরকা দ্বারাও। …মানবমনের বৈচিত্র্যবশতই চরকা যেখানে স্বাভাবিক নয়, সেখানে চরকায় সুতা কাটার চেয়ে মন কাটা যায় অনেকখানি। মন জিনিষটা সুতার চেয়ে কম মূল্যবান নয়।” রবীন্দ্রনাথ দেখালেন আসল রোগ কলটা নয়, আসল রোগ লোভ ও স্বার্থ।