এই একই সাহিত্যতত্ত্ব আবার অন্য এক বিপরীত দিক থেকে বিপদ ঘটাতে পারে। ভরতনাট্যশাস্ত্রের সবচেয়ে সেরা ব্যাখ্যাকার অভিনবগুপ্তের বিরাট প্ৰতিভার প্রসাদে ভারতের নাট্যরসতত্ত্ব প্ৰায় উপনিষদের ব্ৰহ্মতত্ত্বের পদবীতে উভীর্ণ হল। কাশ্মীরী শৈবাদ্বৈতের তান্ত্রিক সাধক ও দার্শনিক অভিনব গুপ্ত সাহিত্যরসকে এক অলৌকিক রহস্যানুভূতির পৰ্য্যায়ে উন্নীত করলেন। সমাধিমগ্ন যোগীর নির্বিকল্প আনন্দানুভূতি থেকে কাব্যর সানুভূতির পার্থক্যের একটি সূক্ষ্ম ভেদরেখা। তিনি টানলেন বটে, কিন্তু সে রেখাটি এত সূক্ষ্ম যে পরবর্তীকালে মন্মটভট্ট সাহিত্যরসাস্বাদকে প্ৰায় ব্ৰহ্মাম্বাদেরই মতো বলে তুলনা করলেন। বিশ্বনাথ কবিরাজ বললেন “ব্ৰহ্মাম্বাদ সহোদরঃ”। সাহিত্যের উৎপত্তি লৌকিক জগৎ থেকে, কিন্তু তার রাসানুভূতি অলৌকিক জগতে। এই সাহিত্যতত্ত্বের বিপদ হ’ল-সাহিত্যের মাতৃভূমিকে বিস্মৃত হওয়া এবং এই বিস্মরণকেই একক নিঃসঙ্গ অনুভূতির গৌরবরূপে প্ৰতিষ্ঠা করা’। আকাশচারী রসবোধ আর নীচের মাটির দিকে তাকাবার প্রয়োজন বোধ করে না। কারণ রস তখন স্বপ্রকাশ, লৌকিক সমাজের মৃত্তিকাই যে তাঁর জন্মভূমি এই উপলব্ধি তখন বিলুপ্ত। এর ফলে সাহিত্যের অর্থবোধে বাধা ও বিভ্ৰান্তি অবশ্যম্ভাবী। কারণ, অর্থবোধ ও রসবোধ অবিচ্ছেদ্য। উৰ্দ্ধবায়ুর প্রকোপে তখন রস ও অর্থ উভয়েই উৰ্দ্ধগামী। কোন সাহিত্যস্রষ্টার সৃষ্টি-কর্মের অর্থ বিচার করার সময় কোন সময়ে, কোন সমাজে, কোন পারিপাশ্বিকে সৃষ্টিকর্তাকে কাজ করতে হয়েছে, সমানকালীন গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ঘটনাবলীর প্রতি তার মনোভাব কিরূপে প্ৰকাশ পেয়েছিল, এই জাতীয় ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গী বিচারকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, বিচারের চেয়ে প্রাথমিক অনুভূতিটাই প্রখর হয়ে ওঠে। ফলতঃ, প্রাচীন আলঙ্কারিকেরা যে অপূর্ব ধ্বনিতত্ত্ব আবিষ্কারের গৌরব অর্জন করেছিলেন, সেই তত্ত্ব শুধু প্ৰাচীন ভাবনার ভিতরেই সংকুচিত হয়ে থাকে, তাকে অতিক্রম করে বর্তমান ও ভবিষ্যতের ধ্যান-ধারণায় প্রসার লাভ করতে পারে না। ধ্বনি বা ব্যঞ্জনাকে কাব্য বা নাটকের দু-একটি পংক্তির ভিতরেই ছোট্ট একটু ঠাই করে থাকতে হবে, একটি সমগ্র কাব্য বা নাটকের সামগ্রিকভাবে কোন একটি ব্যাপক ব্যঞ্জনাময় অর্থ থাকতে পারে না, এমন কোন রাজকীয় শাসন মান চলে না। ঠিক সেজন্যই কোনো মহাকবির সমগ্রজীবন, তার সাহিত্য জীবন ও সমাজজীবন, যখন আমাদের কাছে প্ৰতিভাত হওয়ার সুযোগ পায়, তখন আমরা দাবী করি, এই মহাকবির সমগ্র জীবনের গতি ও লক্ষ্য নিরূপণ করা, তার উপক্রম ও উপসংহার লক্ষ্য কর, তার সঞ্চারণপথের ঋজু ও কুটিল রেখাগুলি অনুসরণ করা, খুঁজে দেখি তার সমগ্র জীবনটারই একটা গভীর ব্যাপক অর্থ আছে কিনা, যে অর্থে তিনি তাঁর ব্যক্তি জীবন, সমাজজীবন ও সাহিত্যজীবনের মিলিত সার্থকতা অনুভব করেছেন। এ দাবীটা খুবই বড়, পূরণ করা পরিশ্রমসাধ্য, কিন্তু অযৌক্তিক নয়। সাহিত্যতত্ত্বের বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সবচেয়ে বড় কথা ধ্বনি বা ব্যঞ্জনা। কার ধ্বনি, কার বাঞ্জন? আলিঙ্কারিক বললেন রসের ধ্বনি বা রসের ব্যঞ্জনাটাই বড় কথা। এখানেও আপত্তির কিছুই নেই। কিন্তু আপত্তি ওঠে তখনই যখন বস্তুধ্বনি থেকে রসাধ্বনিকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়। প্ৰবন্ধের প্রারম্ভে আমরা একথা বলেছি, যে কোন তত্ত্বের মতই সাহিত্যতত্ত্বেরও দুইটি দিক আছে, একটি সাধারণ, আর একটি অসাধারণ; একটি অবশিষ্ট, আর একটি বিশিষ্ট। বস্তুধ্বনি থেকে রসধবনিকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করলে, সাধারণ থেকে অসাধারণের, অবিশিষ্ট থেকে বিশিষ্ট্রেয় বিচ্ছেদ ঘটে। সাধারণ ভূমি থেকেই যে অসাধারণ জন্ম, বস্তুভাবনা থেকেই যে রসচর্বণার অভিব্যক্তি এই সাধারণ সত্যটি তখন দৃষ্টিছাড়া হয়, আর রসবোধটিও হয়ে ওঠে সৃষ্টিছাড়া। কবি-মানসের পিছনে কবির যে ক্রিয়াশীল সমাজ-মানসটি কাজ করে যাচ্ছে, কোন সমানকালীন সামাজিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সেই সমাজ-মানসটি কিরূপে আত্মপ্ৰকাশ করেছে, সে দিকে দৃষ্টি না দিয়েই যদি কোনো কবিকর্মের তাৎপৰ্য্য নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হয় তাহলে বস্তুদৃষ্টিহীন রসবোধ সত্যভ্ৰষ্ট হতে বাধ্য।
আমরা যে মহাকবিজীবনের কথা বলেছি তার বোধ হয়। সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন রবীন্দ্রনাথ। কাজেই রবীন্দ্ৰনাথের সৃষ্টিকর্ম থেকেই উদাহরণ টেনে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট করে তোলার চেষ্টা করব। ‘নিরুদ্দেশ যাত্রার” সর্বাধুনিক ব্যাখ্যাবিভ্রাটে একবার আমাদের বক্তব্য যাচাই করার সুযোগ পেয়েছি। ‘রক্ত করবী’র ব্যাখ্যাবিভ্রাটে এ সুযোগ হয়তো আরও বেশী করে পাওয়া যাবে। কারণ, রক্তকরবীর ব্যাখ্যায় বিভ্ৰাট সৃষ্টি করার দায়িত্ব রবীন্দ্ৰনাথকেও গ্ৰহণ করতে হবে। রবীন্দ্ৰ সাহিত্যের বিচারশীল পাঠক মাত্ৰই জানেন রবীন্দ্ৰনাথ নিজে তার নাটকের কি ব্যাখ্যা দিলেন। র্তার প্রাথমিক ব্যাখ্যায় রক্তকরবীর তাৎপৰ্য্য হল—আধুনিক বৈজ্ঞানিক সভ্যতার দুরন্ত যান্ত্রিক বর্বরতার বিরুদ্ধে শান্ত স্নিগ্ধ কৃষিসভ্যতার মুক্তিস্নাত জয়গান। নন্দিনী এই মুক্তিস্নানের আনন্দ-উচ্ছল প্ৰাণমূতি যে যন্ত্রের বাঁধ ভেঙেছে, আপন হাতে সৃষ্টি করা বিকৃতির জালে আপনি আবদ্ধ মানুষের আত্মাকে মুক্তি দিয়েছে। এ হ’ল ১৩৩১ সালের কথা। কিন্তু মাত্র এক বছর পরে, রক্তকরবীর ইংরেজি অনুবাদ প্রচারিত হওয়ার পরে, রবীন্দ্ৰনাথ ইংরেজি ভাষায় তার নাটকের একটি ভাষ্য তৈরী করলেন, পশ্চিমী মনের কাছে তার আবেদন পৌঁছে দেয়ার জন্য। এই ব্যাখ্যায় তিনি একটি নতুন জিনিষ উপস্থিত করলেন-যা হয়ত পূর্ব ব্যাখ্যায় উহ্য ছিল-সে হ’ল প্ৰাচ্য দেশগুলির উপর পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের লোলুপ আক্রমণ। রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদ কথাটি উচ্চারণ করেন নি, কিন্তু বলতেও বাকী রাখেননি। “The Giant who is not a gigantic man, but a multitude of men turned into a giagantic system……It is an organised passion of greed that is stalking Europe in the name of European civilisation…… The hungry purpose, having science for its steed, running about unchecked, trampling our life’s harvest, is not an intellectual generalisation unfit for imaginative literature.’ avic “organised passion of greed”—“একটি সংগঠিত লোভাতুর কামনা।” এই কথাটি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। আরও লক্ষণীয়, “The hungry purpose. having science for its steed…”, একটি ক্ষুধার্ত উদ্দেশ্য বিজ্ঞানের ঘোড়ায় চেপে পৃথিবীতে দৌরাত্ম্য আরম্ভ করেছে। প্রশ্ন ওঠে রবীন্দ্ৰনাথ এখানে কাকে দোষী করছেন, বিজ্ঞানকেই দোষী করছেন, না। যারা অপরিমেয় শোষণলালসা চরিতার্থ করার জন্য বিজ্ঞানের আশীৰ্বাদকে মানুষের অভিশাপে পরিণত করেছে তাদের দোষী করছেন; যন্ত্রকেই দোষী করছেন, না যারা যন্ত্রের মালিক হয়ে দেশের দশের ও বিদেশের মালিক হয়েছে তাদের দোষী করছেন, যন্ত্রসভ্যতাকে দোষী করছেন, না ‘যান্ত্রিক’ সভ্যতাকে দোষী করছেন। রক্তকরবীর ইংরেজি ভাষ্য থেকে ঠিক এই প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব পাওয়া যায় না। কারণ, এই ব্যাখ্যায় এমন পংক্তিও খুঁজে পাওয়া যাবে যার দ্বারা মনে হতে পারে রবীন্দ্রনাথ দুর্বল মানুষের দুৰ্গতির জন্য যন্ত্রকেই দায়ী করছেন -“I have a stronger faith in the simple personality of man than in the prolific brood of machinery that wants to crowd it out.’