“আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহামৰ্য্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্ৰতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি।”
একথাগুলি উচ্ছ্বাস না কোন গভীর অনুভূতির বাহন? এ সমস্যা তো কেবল অনুভূতি দিয়ে বিচার করা যাবে না। কোন কলাকৈবল্যবাদী যদি বলে বসেন-এত সাহিত্যিক অনুভূতি নয়, এ একটা সামাজিক অনুভুতি, যার ভিতরে একটা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে ধরা পড়েছে। সত্যিকারের সাহিত্যিক অনুভূতি নিরুদেশ নি-লক্ষ্য। কোন ইন্দ্ৰিয়বিকারলদ্ধ অভিজ্ঞতার একটি মুহুর্তকেও যদি উপযুক্ত ভাষার সাজে সাজাতে পারি, তবে রসবেত্তার কাছে ঐ একটি মুহুর্তই অনন্তকালে পরিণত হবে, গোস্পদও সাগরে পরিণত হবে, তিনি বারবার ঐ রত্নাকরে ডুব দেবেন; রত্ন তোলার প্রয়োজন নেই, শুধু অবগাহনেই আনন্দ। “বন্দীর বন্দনা”র বিকারপ্ৰমত্ত প্ৰলাপের ঘোরে যে বাচাল কবি রবীন্দ্ৰপ্ৰভাবমুক্তির কল্লোল তুলেছিলেন, এবং শেষ পৰ্য্যন্ত মার্কিন ডলার পুষ্ট “এশীয় সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার” আন্ডাখানায় কৈবল্যধর্মের সন্ধান পেয়েছেন, তার ও তা একটা অনুভুতি আছে। সে অনুভুতির কি দাম নেই? দাম আছে কিনা জানি না। তবে সরস্বতী স্বৈরিণী হ’লেও স্বৈরাচারের একটা হলাদিনী অনুভূতি আছে, সে যে নির্ভেজাল আধ্যাত্মিক, তাই অমূল্য। সঙ্গে সঙ্গে বক্ৰ অঙ্গুলির ডগায় যদি ব্যবহারিকমূল্যের ঘূত কিছুটা উঠেই আসে। তবে সেটা নিতান্ত আনুষঙ্গিক, পার্থিব বলেই ধর্তব্য নয়।
কথাটা এই জন্যেই উঠেছে যে কেবল উপলব্ধি দিয়ে সাহিত্যের মূল্য যাচাই করা যায় না, অর্থও বোধ হয় বোঝা যায় না। যেমন ধরুন ফরাসীপ্ৰেমিক বাঙ্গালী কবি সাহিত্যের ফরাসি বিছিয়েছেন, সেই ফরাসে বসে তিনি অনুভব করলেন, বিশ্বকবির “নিরুদ্দেশ যাত্রা” কোন ফরাসী কাব্যসুন্দরীর ছায়া নেমে এসেছে। এই সঞ্চারিণী ছায়ামূর্তিকে সর্বপ্রথম উপলব্ধি করার কৃতিত্ব তারই যিনি ব্যাখ্যা করে বুঝাতে লাগলেন-পশ্চিমী সভ্যতার সুন্দরী ভাবনা বিশ্বকবিকে ইসারা করেছে, এই ‘বিদেশিনী’। সুন্দরীর নিগুঢ় সংকেতে এক অনাম্বাদিত মিলনের আশায় বিশ্বকবি অকুল সাগরে পাড়ি জমিয়েছেন। যে মাজেছে সেই জানে-কি মনোহারিণী ব্যাখ্যা। কিন্তু উপলব্ধির প্রসাদবঞ্চিত যে ইতরজন ব্যাখ্যার পিছনেও যুক্তি খোজে। তার মন হরণ করা দুঃসাধ্য। সে কবিতার ব্যাখ্যা বুঝতেও নীরস তথ্যের সন্ধান করে। “নিরুদ্দেশ যাত্রা” কবিতাটির নীচে সন তারিখ দেওয়া আছে—২৭ অগ্রহায়ণ ১৩০০ সাল। এই সময়টাতে যার দুনিবার উপস্থিতি কবিচিত্ত উদ্বেলিত করেছিল তার নাম দেশাত্মবোধ। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতবাবুই এখানে কথা বলুন,-“বঙ্কিমচন্দ্রের মতো সরকারী পেনশনভোগী রায়বাহাদুর পর্য্যন্ত লিখলেন, “যতদিন দেশী বিদেশীতে বিজেতৃ-জেতৃসম্বন্ধ থাকিবে, ততদিন আমরা নিকৃষ্ট হইলেও পূর্ব গৌরব মনে করিব, ততদিন জাতিবৈর-শমতার সম্ভাবনা নাই এবং আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, যে যতদিন ইংরেজের সমতুল্য না হই ততদিন যেন আমাদিগের মধ্যে জাতিবৈরিতার প্রভাব এমনি প্ৰবল থাকে,”-দেশের মনোভাব এইরূপ, রবীন্দ্ৰনাথ নীরব থাকতে পারলেন না। তিনি ‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’’ নামে প্ৰবন্ধ লিখলেন; … সভা হ’ল বিডন স্ট্রীটের চৈতন্য লাইব্রেরীতে, সভাপতি বঙ্কিমচন্দ্ৰ। কয়েকদিন পরেই বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যু হয়। ‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’ ছাড়া এ সময়ে আরও কতকগুলি প্ৰবন্ধ তিনি লেখেন, যেমন, ইংরেজের আতঙ্ক, সুবিচারের অধিকার, রাজা ও প্ৰজা, রাজনীতির দ্বিধা প্ৰভৃতি। এই সব প্ৰবন্ধের মধ্যে রবীন্দ্ৰনাথের তীব্ৰ দেশাত্মবোধ প্ৰকাশ পেয়েছে প্ৰতি রচনাৱ প্ৰতি ছত্ৰে। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, “য়ুরোপের নীতি কেবল নজরুলাপের জন্য, ভারতবর্ষীয়রা এতই স্বতন্ত্র জাতি যে সভ্যনীতি তাহদের পক্ষে উপযোগী নহে’’ (রবীন্দ্র-জীবনকথা পৃঃ ৫৮-৫৯)। ঐ একই সময় একদিন কটকে বিহারীলাল গুপ্তের বাড়ীতে এক ভোজসভায় রাভেনস কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষের মুখ থেকে ভারতীয়দের সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য শুনতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। এই ঘটনার উল্লেখ করে তিনি লিখছেন, “একজন বাঙালির নিমন্ত্রণে এসে বাঙালির মধ্যে ব’সে যারা এরকম করে বলতে কুণ্ঠিত হয় না, তারা আমাদের কী চক্ষে দেখে!” (রবীন্দ্র-জীবনকথা, পৃ ৫৬)। সত্য পশ্চিমের বর্বর শাসনের বিরুদ্ধে যখন শিক্ষিত ভারতবাসীর মন বিষিয়ে উঠেছে, যখন রবীন্দ্ৰনাথ “অপমানের প্রতীকার” খুঁজে ফিরছেন, যখন বিদেশী ভাষার বদলে মাতৃভাষায় শিক্ষাপ্ৰচলনের অপরিহাৰ্য্য প্রয়োজন অকাট্য যুক্তিতে প্ৰতিপন্ন করে “শিক্ষার হেরফের” ঘটাবার চেষ্টা করছেন, ঠিক সেই সময়টির মাঝখানে কোন অলৌকিক স্বপ্নাবেশে পশ্চিমী সভ্যতার নিরুদেশ প্ৰেমাভিসারে বিমুগ্ধ প্রেমিকের মত কবি অকুলে তরী ভাসাতে পারেন, এমন অলৌকিক চিন্তা আমাদের মাথায় আসে না। “নিরুদেশ যাত্ৰা”র ব্যাখ্যায়। যদি নবীন বোধিসত্ত্বের বোধি আমাদের গ্ৰহণ করতে হয়, তবে বলতে হয় রবীন্দ্রনাথ এমন একটি Split-personality ছিলেন যাকে Jekyll and Hidye-এর এক সংস্কৃত সংস্করণ বলা চলে। কবি ভারতী যাতে “দুর্ব্যাখ্যা-বিষমূর্চ্ছিতা” না হয় সেদিকে দৃষ্টি দেবার প্রয়োজন পড়েছে, সেজন্য হয়তো দুর্বাসার বচনও দরকার হতে পারে। এই দুর্ব্যাখ্যার উৎস হল এমন একটি সাহিত্যতত্ত্ব যা নিজেই নিরুদেশের যাত্রী, যা সমাজ নিরপেক্ষ, যুগনিরপেক্ষ, বস্তুনিরপেক্ষ, মানুষের শুভাশুভ-নিরপেক্ষ, কেবলমাত্র রহস্য দীক্ষিতের উপলব্ধি-সাপেক্ষ।