সাহিত্যেরও যদি কোন তত্ত্ব থাকে, তবে তার স্বভাবের ভিতরেও এই দুইটি দিক থাকাই স্বাভাবিক; যেখানে সে সাধারণ এবং যেখানে অসাধারণ। সমাজবদ্ধ মানুষের মনন ও ভাবনা সঞ্জাত অন্যান্য শাস্ত্রের সঙ্গে যেখানে তার সাধর্ম্য, এবং যেখানে তার ইতার-বিশিষ্ট বৈধর্ম্য, এই দুইটি দিকের সমন্বিত স্বরূপকেই বলা উচিত সাহিত্যের ‘তত্ত্ব’! কিন্তু সাহিত্যের তত্ত্বালোচনায় সাধারণতঃ সাহিত্যের অসাধারণ ধর্মটির উপরেই সমস্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে, যার ফলে বক্রোক্তি, অলঙ্কার, রস, ধ্বনি, চমৎকারিত্ব, এই বিষয়গুলিই তত্ত্ববিচারের প্রধান উপজীব্য হিসাবে উপস্থিত করা হয়। সাধারণ কথাকে অসাধারণ ক’রে বলার ভিতরে বাচনভঙ্গীর যে একটু চমৎকারিত্ব আছে। ঐটুকুই সাহিত্যের সার, অথবা কথার কারুকর্মের ভিতর নিয়ে ব্যঞ্জনাশক্তির মহিমায় যে একটি অনির্বচনীয় আনন্দঘন রসানুভূতির আস্বাদ পাওয়া যায় ঐটুকুই সাহিত্যের প্রাণ-এই দুইটি প্রধান মতবাদের যে কোনটিই গ্ৰহণ করিনা কেন, সমস্ত আলোচনা শেষ পৰ্যন্ত এমন একটি চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বাধ্য যাতে আমাদের ইতয়জনের জিজ্ঞাসা পরিতৃপ্ত হয় না। কারণ, কথাটা শেষ পর্য্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়—সাহিত্য একটা অনুভুতির জিনিষ। সাহিত্যের স্রষ্টা ও উপভোক্তা উভয়েই অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন মহাজন, এই অন্তদৃষ্টির প্রসাদে আবিভূতি হয় এক বিচিত্র অপরোক্ষ অনুভূতি, এক আস্বাদন সর্বস্ব অভিজ্ঞতা-কি সুন্দর, কি চমৎকার! এই সৌন্দৰ্য্য ও চমৎকারিত্বের আর কোন নাম নেই, কারণ এ কেবল অনুভববেদনীয়, সুতরাং অনির্বচনীয়।
সাহিত্য অনুভূতির জিনিষ নয় এমন কথা কেউ বলবে না। কিন্তু অনুভূতিকে অনুভূতিসর্বস্বতা পৰ্যন্ত টেনে নিয়ে গেলে বিভ্ৰান্তি সৃষ্টি করার বিপদ অাছে। প্ৰচলিত দর্শনশাস্ত্রে ও মোক্ষশাস্ত্ৰে এ বিপদ বার বার মহামারীর আকারে দেখা দিয়েছে। একটা উদাহরণই দেয়া যাক। প্ৰত্যক্ষ জ্ঞানের স্বরূপ কি এ সমস্যা নিয়ে দর্শনশাস্ত্রে তর্কের ঝড় বয়ে গেছে, এখনও থামেনি, আধুনিক পাশ্চাত্ত্য দর্শনে এই ঝড়ের গতি বেশ বেগবতী। প্ৰত্যক্ষ জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে যদি বা কোনও রকমে একটা ঐকমত্যে উপস্থিত হওয়া গেল, কিন্তু প্ৰত্যক্ষ অনুভূতিটা যে স্বয়ং কি পদার্থ, কি তার উপকরণ, কি তার পরিধি এ সমস্যার আর সমাধান হয় না। কারণ, প্ৰত্যেক পণ্ডিতের ধারণা তার অনুভূতিটাই ঠিক। শুধুমাত্র অন্তমুখী বিশ্লেষণের দ্বারা যদি অনুভূতিকে চিনতে হয় তাহলে উপায়ও তো আর নেই। আমাদের দেশের প্রাচীন দর্শনের একজন দিকৃপাল নৈয়ায়িক জয়ন্ত ভট্ট খুব রসিক লোক ছিলেন। তিনি এই নিৰ্বাক অনুভূতির সবাক কোলাহল উপভোগ করে মন্তব্য করলেন-দেখুন, প্ৰত্যক্ষ জ্ঞানটা আমাদের শেষ আপীল-আদালত। কোন অপ্ৰত্যক্ষ বিষয়ে যখন মামলা ওঠে, তখন ঘটনাটা সম্ভব কি অসম্ভব বিচার করার জন্যে আমরা প্রত্যক্ষ জ্ঞানের আদালতে আপীল করি, এখন দেখছি প্ৰত্যক্ষ জ্ঞানটা যে কি তাই নিয়েই মামলা উঠেছে, প্রত্যক্ষ জ্ঞানে আমাদের কাছে কি যে প্রতিভাত হয় তাই জানি না। তাহলে প্রত্যেকে বুকে হাত দিয়ে শপথ করে বলুন, কার প্রত্যক্ষ কিরূপ? কিন্তু এ দ্বারা ত মীমাংসা হবে না। তাই হৃদয়ের শপথের পথ ত্যাগ করে আমাদের অন্য পথ ধরতে হবে। অবশ্য জয়ন্ত ভট্ট কি পথ ধরলেন তা আমাদের বিচাৰ্য্য বিষয় নয়। লোকোত্তর মোক্ষশাস্ত্রের রাজ্যে তি আরও ব্যাপক বিস্ত্ৰান্তি। মুক্তির স্বরূপ যে কি–তাই নিয়ে এক এক মহাত্মার এক এক রকমের অনুভূতি, আমাদের ইতরজনের জন্য বিধান, যে কোন মহাজনের পথ ধরে সন্ধান কর। কিন্তু আমাদের মুস্কিল, কোন মহাজন যে সত্যই মহান তা তো আর নিছক অনুভূতি দিয়ে যাচাই করতে পারি কিনা।
সাহিত্যকেও যখন লোকোভীর্ণ অনুভূতির রাজ্যে সন্ন্যাস নিয়ে রসোত্তীর্ণ করার দাবী তোলা হয়, তখন আমাদের মুস্কিল বাধে আরও বেশী। প্রথম কারণ সাহিত্যিকরা সকলেই আমাদের কাছে মহাত্মা বা মহাপুরুষ বলে প্ৰতিভাত হন না, যারা কলাকৈবল্যবাদী তাদের ও কৈবল্যের প্রতি অনুরাগ কতখানি আন্তরিক সে সম্পর্কে সন্দেহ জাগে, অনুরাগটা কথার তোড়ে ভাসমান বুদ্ধ,দ মাত্র কিনা এ প্রশ্ন মনে জাগে। দ্বিতীয়ত: আমরা সাধারণ মানুষ থাকি সংসারের সুখ দুঃখে জড়িয়ে, দিনযাপনের প্রাণধারণের গ্লানি আমাদের সর্বাঙ্গে মাখা : ঠাসাঠাসি দিনমুসাফিরের মালগাড়ীতে ওষ্ঠাগত। প্ৰাণটাকে অনেক সময় বইয়ের পাতা দিয়ে আটকে রাখি, তা সে পরীক্ষা পড়ুয়ার গণিত, ইতিহাস, ক্লাসের নোট বইই হ’ক, অথবা জানা অজানা সাহিত্যিকের বইই হ’ক। তখন কোথায় লোকোত্তর অনুভূতি, কোথায় কৈবল্যদায়িনী কলা, তার চেয়ে সিঙ্গাপুরী কদলীর ডাকে যে অনুভূতি জাগে তা কলাশাস্ত্রের লোকোত্তর সুড়সুড়ির চেয়ে অনেক বেশী রসোত্তীৰ্ণ। কিন্তু এহি বাহ, অন্তরঙ্গ কথা বলতে হবে। বাড়ী ফিরে একটু অবসর করে তদগত চিত্তে সাহিত্যের বই পড়ি, নানান দেশের নানান মানুষের বিচিত্র ভিড়, সে ভিড়ের ভিতরে নিজের মুখ, স্ত্রীর মুখ, ছেলেমেয়ে বন্ধুবান্ধবের মুখ দেখি, শত্রুর মুখ ও দেখি। চিনিনা এরকম লোক ও বিস্তর, তারাও চেনা হয়ে যায়। এই চেনা, অচেনা, নতুন চেনা মানুষের মিছিলটািই চোখের সামনে বড় হয়ে ভাসতে থাকে। এত ভিড় ঠেলে, পায়ের নীচে অনেক আবর্জনা ঠেলে, সামনের অনেক বাধা ঠেলে মানুষগুলি কিন্তু এগিয়ে চলেছে। মনে আশা জাগে, উৎসাহ জাগে। যে মানুষ মানুষের মূল্যকে পদদলিত করেছে সে রক্ষা পায়নি, অভিশাপ। মাথায় নিয়ে মাঝপথে কবরের কোলে থেমে গেছে। যে মানুষ মানুষকে ভালবেসেছে, মানুষের অপমান সইতে পারেনি, কিন্তু সবল সংগ্ৰামী বাহুর দ্বারা মনুষ্যত্বের মূল্যকে রক্ষা করার চেষ্টাও করতে পারেনি সেও তার সকল ব্যর্থতার অন্তর্জালা নিৰ্বাণ করেছে কবরের শান্তিতে; কিন্তু তার শেষ পরাভব হয়নি, মিছিলের পিছের মানুষগুলি সামনে এগিয়ে এসেছে, তাকে শ্ৰদ্ধা জানিয়েছে, দুঃখকরেছে, কিন্তু তার ব্যৰ্থতার গ্লানি গ্রহণ করেনি, সংগ্রামী মানবতার বাণী বহন করে পথ কেটে এগিয়ে চলেছে। যুগ থেকে যুগান্তরে সমস্ত যুগান্তকারী সাহিত্য এই মরণজয়ী মানুষের জয়যাত্রার উজ্জল ছায়াপথ। সব কোলাহল ছাপিয়ে এই জয়যাত্রার জয়ধ্বনি বেজে উঠল কবিকণ্ঠে–