অর্থস্য পুরুষো দাসো দাসস্ত্বর্থো ন কস্যচিত্।
ইতি সত্যং মহারাজ বদ্ধোস্ম্যৰ্থেন কৌরবৈঃ ॥
অতস্ত্বাং ক্লীববিদ্বাক্যং ব্ৰবীমি কুরুনন্দন।
ভূতোস্ম্যৰ্থেন কৌরব্য যুদ্ধাদন্যৎ কিমিচ্ছসি।।
এই অর্থ–দাসত্বের কলুষবন্ধনই বোধ হয় ভীষ্মকে কৌরব সভায় অবমানিতা দ্রৌপদীর ব্যাকুল আবেদন কৌশলে উপেক্ষা করতে বাধ্য করেছিল।
যুধিষ্ঠির তারপর একে একে দ্রোণ কৃপ ও শল্যের নিকট উপস্থিত হয়ে একই কথা বললেন, এবং প্রত্যেকে একই উত্তর দিলেন–
কৌরবের অর্থে প্ৰতিপালিত অর্থদাস আমি আজ ক্লীবের মত তোমার কথার উত্তর দিতে বাধ্য হচ্ছি।
যে সমাজ অর্থের প্রভুত্ব মেনে নেয় সে সমাজে মহাবীরও দুর্বল, মহাপুরুষ ও পৌরুষহীন। এই সাবধানবাণী ঘোষণা করার সময় সতদ্ৰষ্টা কবি কি দিব্য চক্ষে বর্তমান ভারতবর্ষকে দেখতে পেয়েছিলেন? ধৰ্মরূপী বিদুর কিন্তু কৌরবের অন্ন ও অর্থ প্ৰত্যাখ্যান করেছিলেন, স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধ পর্ণকুটীরের ক্ষুদকণাকেও অমৃত বলে গ্রহণ করেছিলেন। এই দাসীপুত্র কোনদিন অন্যায় ও অধর্মের কাছে মাথা নোয়াননি। বিদ্যুরের বিবেক নিটোল, নিষ্কলুষ নিশ্চিন্দ্ৰ। মহাভারতকার ঘোষণা করলেন—এই দাসীপুত্ৰই সাক্ষাৎ ধর্ম। মহাভারতের নাটকীয় ঘটনাবর্তে বিদুরের উপস্থিতি প্ৰত্যক্ষ নয়, কিন্তু পরোক্ষ। তিনি নির্ভীক স্পষ্টবাদী, কিন্তু মহাকাব্যের প্রধান ঘটনা স্রোতে স্পষ্টত; অংশ গ্ৰহণ করেননি। তার আত্মা যুধিষ্ঠিরের মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে মহাকাব্যের শ্রেষ্ঠ নায়করূপে প্ৰকাশিত হয়েছে। তাই মহাভারতের উপাখ্যান বলছে–স্বয়ং ধর্ম দাসীপুত্ৰ বিদুবরূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং যুধিষ্ঠির হলেন ধর্মের আত্মজ।
প্ৰত্যেকটি চরিত্রে মহাকবি যে গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন, ঘটনার গতির সঙ্গে চরিত্রগুলির সঞ্চার পদ্ধতিকে যে ভাবে তিনি মেলাতে পেরেছেন, একটা সমগ্র মহাদেশের সমগ্র যুগব্যাপী বিপুল ঘটনা-স্রোতের মধ্যে যে ভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে তিনি অবাধে ঘোরাফেরা করেছেন তাতে শুধু বিস্ময় বোধ করাই যথেষ্ট নয়, বিনম্র শ্রদ্ধায় অভিভূত অন্তরে এই মহাকবিকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্য প্রণেতা বলে প্ৰণাম করতে হয়।
একদিকে ক্ষত্ৰিয় হিসাবে দুৰ্যোধনের অতিসীমিত আপেক্ষিক বিকৃত মূলবোধ, অন্যদিকে যুধিষ্ঠিরের মহত্তম সর্বাত্মক মানবিক মূলবোধ-মহাভারতের ংঘর্ষের মূলভিত্তি এই বিপরীতমুখী মূল্যবোধের বিরোধ। মহাভারতের ভূমিকায় একইে ‘মনুস্ময়ো মহাদ্রুমঃ’ এবং ‘ধর্মময়ো মহাদ্রুমের” বিরোধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভূমিকা থেকে স্বৰ্গারোহণ পর্ব পর্যন্ত এই বিরোধেরই বিস্তার পরিণতি ও উপসংহার। এই ভাবে সমগ্ৰ মহাভারতের একটা একটানা সাধারণ সঙ্গতি আছে, একটা ভাবগত ঐক্য আছে, বক্তব্যের একটা সহজ অক্লিষ্ট সামঞ্জস্য আছে কোন দৃষ্টিশীল সমালোচক যাকে উপেক্ষা করতে পারেন না। লোভের গ্রাস থেকে মানুষকে বাচাতে হবে, বিদ্বেষের বিষবাস্প থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হবে, মানুষ ও পৃথিবীকে মৃত্যুর কবল থেকে মুক্ত করতে হবে-এই হল মহত্তম মনুষ্যত্ব। কিন্তু তবু যদি ধ্বংস নেমে আসে, প্রস্তুত হও, মহামানবের মহাকাল-রূপ দেখে ভয় পেওনা। তখন যেন শ্মশান-বৈরাগ্য না আসে। অর্জুন বিশ্বরূপকে দেখেছিলেন লোকক্ষয়কারী কালরূপে। অৰ্জুন কুরুক্ষেত্ৰযুদ্ধে নেমে বললেন, আমি ধ্বংস চাইনা, যুদ্ধ করতে পারব না। এ বৈরাগ্য নয়, বিহ্বলতা। মুহূর্তমাত্র পূর্বে হতাশাহাদয় ধৰ্মরাজকে প্ৰবোধ দিয়ে বীরদৰ্পে অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে রথ ছুটিয়ে এসেছেন। এখন কি তিনি নূতন করে আবিষ্কার করলেন যে যুদ্ধে ধ্বংস হবে ? ধ্বংস জেনেও যুদ্ধ করতে হবে। অন্যায়ের কাছে মাথা নুইয়ে মানুষ বিবাগী হতে পারে না।
কিন্তু মনে রাখতে হবে এ যুদ্ধে বিজেতা শান্তি পাবেনা। ভয়ঙ্কর বিনাশের মধ্য দিয়ে জয়লাভ করলে তার বেদন যেন বিজেতার বিবেককে আঘাত করে। না হলে মানুষ পশুতে পরিণত হবে। এই বিবেকের মহত্তম ঐশ্বৰ্য্য ছিল যুধিষ্ঠিরের। তাই তিনি ধৰ্মরাজ, অসুখী ধৰ্মরাজ, বিজয় গৌরবে উদ্ধত শক্তিমদমত্ত রাজা নন। তিনি। তিনি বিজয়ের বেদনায় অবনত, মানবিক মহিমায় সমুন্নত ধৰ্মরাজ। এই বিবেক বেঁচে থাকলে বর্তমান ধ্বংসের মধ্যেও ভবিষ্যৎ মনুষ্যত্বের বাঁচার আশা আছে। ভবিষ্যতের মানুষ তখন দ্বিগুণ উৎসাহে সৰ্বাত্মক ধ্বংসকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে। কুরুক্ষেত্রের রক্তমেধ পার হয়ে পৃথিবীতে শান্তি আসেনি। তবু এ রক্তমেধ সেদিন বন্ধ করা যায়নি। কুরুক্ষেত্রের নির্মম হানাহানির পর মানবাত্মার মিলন হ’ল পরপারে। সম্পদলোভীর লোভকে সংযত করে, শক্তিমান দীপিতের দৰ্প খর্বিত করে এ পৃথিবীতেই কি বিদ্বেষ-বিষমুক্ত মানুষের মিলন ঘটানো সম্ভব হবে না? মহামানবকে আর কতবার মহাকালের রূপ ধারণ করতে হবে? —মহাভারতের মহাকবি এই অনুচ্চারিত জিজ্ঞাসা সুদূর অতীত থেকে বর্তমানের মানুষের কাছে উপস্থিত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য দৃষ্টি
‘তত্ত্ব’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ বস্তুর স্বরূপ বা স্বত্ব বা স্ব-ভাব। তত্ত্বের দুইটি দিক, একটি বিশিষ্ট, আর একটি অবিশিষ্ট। স্কুল কলেজের ছাত্ররা ন্যায়শাস্ত্রের প্রথম পাঠ গ্রহণের সময় জানতে পারে, মানুষের তত্ত্ব হ’ল মনুষ্যত্ব; যেখানে মানুষের অন্যান্য জীবের সঙ্গে মিল রয়েছে সেই অবিশিষ্ট জীবধর্ম, এবং যেখানে তার অন্যান্য জীব থেকে পার্থক্য রয়েছে সেই বিশিষ্ট বুদ্ধি বা মননধর্ম, এই বিশিষ্টতা ও অবিশিষ্টতা, এই স্বাতন্ত্র্য ও অস্বাতন্ত্র্য, সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্য, এই নিয়ে ‘মনুষ্যত্ব’, যাকে তত্ত্বজ্ঞানোচিত গাম্ভীৰ্য্য নিয়ে বলা যেতে পারে মানুষের ‘তত্ত্ব’।