কুরুক্ষেত্রের ধ্বংসের দিকে একটি মহাদেশকে এগিয়ে দেবার পিছনে রাজ্যলোভের সঙ্গে সঙ্গে দুৰ্যোধনের অহঙ্কারও একটা মস্ত।বড় ভূমিকা গ্ৰহণ করেছিল। আত্মবিস্তারকে তিনি আত্মার অঙ্গীকার বলে মনে করেছেন। এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার। “বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্ৰ মেদিনীও পাণ্ডবদের দেবনা’ এই নির্মম নিশ্চয়েব পিছনে দুৰ্যোধনের আহত অহঙ্কার অনেকখানি কাজ করেছে। ভীমসেন দুৰ্যোধনের অহঙ্কারে আঘাত না করার জন্য কৃষ্ণকে বার বার সতর্ক করেছিলেন-কৃষ্ণ, তুমি মৃত্যু ব্যবহার করবে। কিন্তু কৌরব সভায় শ্ৰীকৃষ্ণের ভক্ত পরিষদ বৃন্দ ঠিক এর বিপরীত কাজটাই করেছেন। বার বার বক্তার পর বক্তা উঠে দুৰ্যোধনকে শুধু ধিক্কারই দেননি, বলেছেন-স্বয়ং ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের আশ্রয়পুষ্ট পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধে তোমার ধ্বংস অনুবার্য্য। দুর্যোধনের মর্য্যাদায় তাঁরা আঘাত করেছেন। দুৰ্যোধন তার উত্তরে বলেছেন, কৰ্ণ দ্ৰোণ ভীষ্মকে যুদ্ধে পরাজিত করতে পারে পৃথিবীতে এমন কে আছে? তা হলে একবার লড়েই দেখা যাক। বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্ৰ ভূমিও আমি দেবনা। এ আমার শেষ কথা।
ভীমের পদাঘাতে উরুভগ্ন দুৰ্যোধনকে কৃষ্ণ যখন তীব্র তিরস্কার করছেন তখন নিষ্পিষ্টপুচ্ছ সৰ্প যেমন অর্ধেক শরীর নিয়ে ফণা তুলে দাঁড়ায় দুৰ্যোধনও তেমনি হাতের উপর ভর রেখে অর্ধেক শরীর টান করে তুলে ধরলেন। কৃষ্ণের দিকে জলন্ত দুটি চোখের দৃষ্টি স্থির রেখে বললেন–কংসের দাসের জ্ঞাতি তুমি, তোমার লজ্জা নেই, ঘৃণা নেই। কৌরবপক্ষের অন্ততঃ একটি বীরের নাম কর পাণ্ডবরা তোমার কুটিল অপকৌশল ছাড়া যাকে যুদ্ধে জয় করতে পেরেছে। কৃষ্ণ এর উত্তরে দুৰ্যোধনের পাপকাৰ্য্যের একটার পর একটা ফিরিস্তি দিয়ে চললেন। দুৰ্যোধন প্ৰত্যুত্তর দিলেন–আমি পৃথিবী শাসন করেছি, ভোগ করেছি। আমি যা কিছু করেছি তা রাজধর্মে অনুমোদিত। আমি শত্রুর শীর্ষে আরোহণ করেছি। বীরের মত এবার আমি আমার জীবনপ্রান্তে পৌঁছেছি। আমি স্বর্গের গৌরব অর্জন করব। তোমরা কিন্তু এই পৃথিবীর নরককুণ্ডে জীবন্ত শব রূপে বেঁচে থাকবে। দুৰ্যোধনের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হল, সুগন্ধে বাতাস ভরে গেল। সিদ্ধগণের সাধুবাদ ও গন্ধৰ্ব্বগণের গীতিমাধুর্যে দিগন্ত মুখরিত হল। জ্যোতিমালায় আকাশ উদ্ভাসিত হল। বাসুদেব ও পাণ্ডবগণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
কিন্তু অসাধারণ বীরত্ব সত্ত্বেও দুৰ্যোধনের চরিত্রে এমন একটা ক্রুরতা ছিল যে মহাকবি তাঁকে মহত্ত্বের শিখরে উত্তীর্ণ করতে পারেননি। কৃষ্ণকে শেষ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই যদি দুৰ্যোধন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতেন তবে হয়ত বীরত্বের সঙ্গে খানিকটা মহত্ত্বের দাবীও তিনি করতে পারতেন। কিন্তু তাঁর দুৰ্ভাগ্য তিনি ভগ্ন উরু নিয়ে আরো কিছু সময় বেঁচে রইলেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে অশ্বথামাকে দিয়ে নিদ্রিত পাণ্ডব শিবিরে রাত্রির অন্ধকারে এক নিদারুণ নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটালেন। আর এই হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে পরম শান্তি ও তৃপ্তিভারে বিন্দুমাত্র অনুতাপ না করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। দুৰ্যোধন জীবনে কোনদিন বিবেকের দংশন অনুভবও করেননি, কোন কাজের জন্য অনুতাপ করেননি। তার চরিত্রে অন্তদ্বন্দ্বের এমন একটা সৰ্বাত্মক অভাব রয়েছে, আগাগোড়া এমন একটা ক্রুর, নৃশংস ও উদ্ধত সামঞ্জস্য রয়েছে মহাভারতের ট্রাজিডির হিরোর মহিমা তিনি কোনদিন পেতে পারেন না।
ট্রাজিক হিরোর উদাত্ত চারিত্রিক ঐশ্বৰ্য্য রয়েছে কর্ণের। কিন্তু কর্ণেরও একটা বিশিষ্ট সীমা রয়েছে যাকে অতিক্রম করে তার মানবিকতা মহত্তম পৰ্য্যায়ে পৌঁছুতে পারেনি। এই উদার-হৃদয় মহাবীরের জন্মলগ্নের অভিশাপ তাকে মৃত্যু পৰ্য্যন্ত অনুসরণ করেছে। সমাজের উচ্চকোটিতে সদা অবজ্ঞাত এই বীর হৃদয় সামাজিক অন্যায় ও অবিচারে প্রতিক্রিয়া হিসাবে দুৰ্যোধনকৃত সমস্ত পাপাচারের বিশ্বস্ত সহযোগী হতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ একমাত্ৰ দুৰ্যোধনই তাকে প্ৰাপ্য সম্মান দিতে কার্পণ্য করেননি। মাত কুন্তীর কাছে আত্মপরিচয় পাবার পর বিক্ষুব্ধ লাঞ্ছিত হতাশাক্লিষ্ট এই বীরপুরুষ সজ্ঞানে সুনিশ্চিত মৃত্যুর পথে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছেন। সমাজের অবজ্ঞা ও লাঞ্ছনা। এই স্বর্ণহৃদয় বীরপুরুষকে এক নিদারুণ অভিমানের মধ্যে উদাসীন আত্মকেন্দ্ৰিক ও নিঃসঙ্গ করে নির্বাসন দিয়েছে, যার ফলে যুধিষ্ঠিরের মত মানবজীবনের মহত্তম ভাবনার কাছে পৌঁছুবার সুযোগ তার ঘটেনি। সমাজের বিড়ম্বনায় একটা বিরাট সম্ভাবনার অপমৃত্যু এই কৰ্ণচরিত্র। যিনি ঘোষণা করেছিলেন—“দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম মদায়ত্তং তু পৌরুষম্’–তিনি যেন শেষ পৰ্য্যন্ত নিবিড় ঔদাসীন্যে দৈবের কাছেই নিজেকে সঁপে দিলেন।
মহাভারতের বিরাট কলেবরে তৎকালীন সমাজের অনেক বিরাট পুরুষের সমাবেশ ঘটেছে। কিন্তু মহাকবির সূক্ষ্ম সামাজিক সংবেদনা। এই বিরাট চরিত্রগুলির দুর্বল রন্ধগুলিকে অবারিত করতে দ্বিধাগ্ৰস্ত হয়নি। ভীষ্ম দ্ৰোণ বিরাট পুরুষ, ভারতীয় ঐতিহে অশেষ শ্ৰদ্ধাভাজন। তবু এদের বিরাটত্ব নীরন্ধ নয়। কবির বাস্তব সমাজদৃষ্টির কাছে এদের দুর্বলতা অনাবিষ্কৃত থাকেনি। এই দুর্বলতার সামাজিক ভিত্তি কোথায় তাও এদের মুখ দিয়েই প্ৰকাশিত হয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার ঠিক পূর্বক্ষণে যুধিষ্ঠির ভীষ্ম দ্ৰোণ কৃপ ও শিল্যের কাছে একে একে আশীৰ্বাদ প্রার্থনার জন্য উপস্থিত হলেন। ধর্মীরাজের ধর্মবোধের তুলনা নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে দুপক্ষের সৈন্যবাহিনী সজ্জিত হয়ে সেনাপতির আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। যুধিষ্ঠির অস্ত্র ও কবচ পরিত্যাগ করে কুরুসৈন্যের ভিতরে প্রবেশ করলেন। কৌরবপক্ষীয় যোদ্ধগণ উপহাসমুখর হয়ে উঠল—‘পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির বোধহয় ভয় পেয়েছে, ভীষ্মের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করতে চলেছে। যুধিষ্ঠির ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হয়ে এই অপ্রত্যাশিত আগমনের অভিপ্ৰায় ব্যক্ত করলেনআপনি শ্ৰদ্ধেয় গুরুজন। আপনার বিরুদ্ধে আজ আমরা অস্ত্র প্রয়োগ করতে বাধ্য হব। আপনি কৌরবের পক্ষে যুদ্ধ করুন। কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আমাদের অনুমতি দিন, আর আমাদের আশীৰ্বাদ করুন। যুধিষ্ঠিরের এই অত্যাশ্চৰ্য্য আচরণ বীরশ্ৰেষ্ঠ বৃদ্ধ পিতামহের লজ্জাহত বিবেককে আত্মপ্রকাশের পথ করে দিল একটি অকপট স্বীকারোক্তিরূপে। ভীষ্ম বললেন-আমি আজি ক্লীবের মত তোমার কথার উত্তর দিচ্ছি। কৌরবের অর্থে পরিপুষ্ট আমি অর্থদাস। পুরুষ অর্থের দাস, অর্থ পুরুষের দাস নয়। তাই তোমার প্রতিপক্ষীরূপে যুদ্ধ করতে বাধ্য হচ্ছি।