কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ গলিত বিকৃত শবরাশির মধ্যে গান্ধারী এসে দাঁড়িয়েছেন মাতৃজাতির প্রদীপ্ত বিবেকের প্রতিমূতিরূপে। নিহত পুত্রদের পাপস্থালনের জন্য গান্ধারীর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। পাণ্ডব বা কৌরব উভয় পক্ষের নিহত যোদ্ধাদের জন্য তিনি আকুল ক্ৰন্দনে মাঝে মাঝে ভেঙ্গে পড়ছেন। আবার উঠে চলছেন, কৃষ্ণকে ডেকে ডেকে তঁর ধ্বংসলীলার পরিণতি দেখাচ্ছেন আর বার বার প্রশ্ন করছেন-হে মাধব, এ কাজ তুমি কেন করলে? তারপর এক সময় শোকদগ্ধ মাতৃহৃদয় ধৈর্ঘ্যের বাঁধ হারিয়ে ফেলল। গান্ধারী উঠে দাঁড়ালেন, চোখের জলে আগুনের শিখা জলে উঠল, কৃষ্ণকে দারুণ অভিশাপ দিলেন গান্ধারী–তোমার যাদব বংশও এমনি ধ্বংস হবে। তুমি থাকবে নিঃসঙ্গ, একাকী। বনে বনে উদভ্ৰান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবে। তারপর একদিন অখ্যাত, অজ্ঞাত, অলক্ষিত তুমি কুৎসিত মৃত্যু বরণ করবে। ভরতবংশের নারীদের মত যাদববংশের পুত্ৰহীন পতিহীন জ্ঞাতিবান্ধবহীন নিঃসহায় নারীকুলও এমনি হাহাকার করবে।
কৃষ্ণ কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না, ধীর গভীর প্রশান্তস্বরে গান্ধারীকে বললেন–গান্ধারি, তুমি আমার কাজটাই এগিয়ে নিয়ে গেলে। এ আমি আগে থেকেই জানি। বৃষ্ণিবংশের ধ্বংস তোমার অভিশাপের আগেই নির্ধারিত হয়েছে। “জানেহমেতদপ্যেবং চীৰ্ণং চারসি ক্ষত্ৰিয়ে।”
গান্ধারী নির্বিকার নির্মম মহাকালের ফাঁদেই পা বাড়ালেন। শোকে ক্ৰোধে প্ৰতিশোধস্পৃহায় উদভ্ৰান্ত মাতৃহৃদয়ের বিবেক কিন্তু কলুষিত হল। মহাকবি একথাই বুঝাতে চাইলেন, ধ্বংসের পাপচক্ৰ সম্পূর্ণ না ঘুরে থামতে জানে না। ধ্বংস ধ্বংসকে ডেকে আনে। কুরুক্ষেপ্রের রক্তলীলায় ধ্বংসের প্ৰথম পর্ব শেষ হয়েছে, দ্বিতীয় পর্ব শেষ হবে বৃষ্ণিবংশের নিধনযজ্ঞে। বৃষ্ণিবংশ নিঃশেষিত হল। নির্জন বনান্তে নিঃসঙ্গাচারী শ্ৰীকৃষ্ণ ব্যাধবাণবিদ্ধ হয়ে প্ৰাণত্যাগ করলেন। কালপুরুষের কাজ শেষ হ’ল। পাণ্ডবরা বলে উঠলেন, ‘কালঃ, কালঃ’। কালপুরুষ তার মাসুল সুদে আসলে আদায় করে নিয়েছে। আর নয়। এবার যাবার পালা। যে রাজ্য নিয়ে পাণ্ডবরা একদিন ও সুখের মুখ দেখেনি, বিবেকের ভারস্বরূপ সেই রাজ্যভার পরীক্ষিতের হস্তে সমর্পণ করে পাণ্ডবেরা মহাপ্ৰস্থানের পথ ধরলেন। স্বর্গে গিয়ে কৌরব পাণ্ডবের মিলন হল। সেখানে শক্ৰতার অবসান ঘটল এই মিলনে। এই শত্রুতার অবসান পৃথিবীতে ঘটলে মানুষের মঙ্গল হত, তবু তা ঘটল না। কেন ঘটল না? পৃথিবীতে মানুষ কি শান্তিতে থাকতে পারবেন?–এই অনুচ্চারিত প্রশ্ন মহাভারতের মহাকবি চিরকালের মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন, প্রশ্নের সমাধানের ইঙ্গিতও তিনি দিয়ে গেছেন।
মহাভারতের ভূমিকাতেই দুটি শ্লোক আছে যাকে টীকাকার নীলকণ্ঠ মহাভারতের তাৎপৰ্য্যগ্ৰাহক শ্লোক বলে উল্লেখ করেছেন। প্ৰথম শ্লোকটিতে দুৰ্যোধনকে বলা হয়েছে “মন্যুময়ো মহাদ্রুমঃ”, দ্বিতীয়টিতে যুধিষ্ঠিরকে বলা হয়েছে “ধর্মময়ো মহাদ্রুমঃ”। ভারতীয় ঐতিহ্যে এ শ্লোকদুটি সুপ্ৰসিদ্ধ। এ ঐতিহ্য শুধু প্রাচীন ভাবনার বিলাস মাত্র নয়। “মন্যু” শব্দের অর্থ এখানে ক্ৰোধ। টীকাকার নীলকণ্ঠ বললেন এখানে ’মন্যু’ শব্দটির দ্বারা দ্বেষ, ঈৰ্য্যা, অসূয়া প্রভৃতি দোষকেও বুঝতে হবে। এই “প্রভৃতির” মধ্যে লোভও আছে।
মহাভারতের যুদ্ধের মূলে রয়েছে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্ন। এখানে সম্পত্তি হ’ল একটা বিপুল রাজ্য। এই রাজ্যলালসাকে কেন্দ্র করেই হিংসা দ্বেষ ও অহঙ্কার প্রতিপক্ষের হৃদয়ে প্রবল হয়ে উঠেছে। এই রাজ্যাধিকার কি এতই পবিত্র, যার জন্য একটা সমগ্ৰ মহাদেশের মানুষের জীবন ছারখার করে দেয়া চলে? পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার পবিত্র ও মৌলিক মানবিক অধিকার। কোন রাজার রাজ্যের লোভ, কোন ধনীর সম্পত্তির লোভ মানুষকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেন। দুৰ্যোধন মানুষের জীবনের মূল্যের চেয়ে তার অহঙ্কৃত রাজ্যলালসাকে অগ্ৰাধিকার দিয়েছেন। তার ফলেই সমগ্র দেশের জীবনে ঘোর দুর্দিন নেমে এসেছে। পাণ্ডবরা রাজ্যের দাবী ত্যাগ করেছিলন। মানবিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে কৌরবদের অপেক্ষা পাণ্ডবরা অধিক সমুন্নত। কিন্তু মহাভারতকার নিরঙ্কুশ শান্তিবাদ বা pacifismকে প্রশ্রয় দিতে রাজী নন। একটা মহাযুদ্ধ বন্ধ করার জন্য আপ্ৰাণ চেষ্টা করার পরও যদি দেখা যায় অত্যাচারীর নিষ্ঠুর লোভের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমৰ্পণ করে বৈরাগ্য-অবলম্বন করা ছাড়া শান্তির আর পথ নেই, সেখানে আত্মসমর্পণ করা চলেনা। কারণ, তাতে শান্তি আসেনা। দর্পিতের দম্ভ, লোভীর লোভ আরও নিষ্ঠুর ভাবে আত্মপ্ৰকাশের সুযোগ পায় মাত্র। তখন সকল পরিণতির কথা ভেবেও সর্বাত্মক প্ৰতিরোধের জন্য প্ৰস্তুত হতে হবে।
দুৰ্যোধনের চরিত্রে ব্যক্তিগত অনেক গুণ আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার দর্প ও রাজ্যলোলুপতার কাছে মানুষের জীবনের মূল্য তুচ্ছ। এখানেই মানুষ হিসাবে দুৰ্যোধনের গ্লানিময় নৈতিক পরাজয়। কিন্তু মহাকবির গভীর অন্তদৃষ্টি দুৰ্যোধনের প্রতি অবিচার করেনি। দুৰ্যোধনের দৃঢ় বিশ্বাস রাজ্য তঁরই প্ৰাপ্য। শ্ৰীকৃষ্ণের শান্তি-প্ৰস্তাবের সময় দুৰ্যোধন এ বিশ্বাস অকপটে ব্যক্তি করেছেন-যে পৰ্য্যন্ত আমি বেঁচে থাকব। সে পৰ্য্যন্ত পাণ্ডবরা রাজ্য পাবেন। আমরা যখন বালক ছিলাম। তখন আমাদের অন্ধ পিতা অন্যের কুমন্ত্রণায় আমাদেরই ন্যায়াধিকারভুক্ত রাজ্য অন্যায়ভাবে পাণ্ডবদের দান করেছেন। বিনাযুদ্ধে আমি সূচ্যগ্র মেদিনীও দান করবনা। দুৰ্যোধন যে প্রতিদ্বন্দ্বী পাণ্ডবদের সমুলে ধ্বংস কামনা করেছিলেন, এবং বহু কুটিল উপায়ে সে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তাতে কোন ও সন্দেহ নেই। কিন্তু তার ধারণা ছিল এ ক্ষত্ৰিয়ের ধর্ম। রাজসূয় আর অশ্বমেধ যজ্ঞের নামে যদি অন্যের রাজ্য গায়ের জোরে দখল করে নিজের রাজ্য বিস্তার করা রাজধর্মে অন্যায় বলে বিবেচিত না হয়, তবে নিজের রাজ্য নিষ্কণ্টক করার জন্য প্ৰতিদ্বন্দ্বী জ্ঞাতিশক্ৰকে নির্মূল করাই বা অন্যায় হবে কেন?