কুরুক্ষেত্ৰযুদ্ধের উদ্যোগপর্বে চতুর ধৃতরাষ্ট্র কৌশলে যুধিষ্ঠিরের মহত্ত্বের সুযোগ নেবার চেষ্টা করেছেন। তিনি সঞ্জয়কে পাঠিয়ে দিলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে একটি অদ্ভুত কুটিল প্ৰস্তাব দিয়ে। সঞ্জয় যুধিষ্ঠিরের কাছে যে বাণী বহন কবে আনলেন তার সারমর্ম এই–আপনি ধর্মরাজ, ধর্ম আপনার কাছে রাজ্য ও রাজনীতির অনেক উর্ধে। আপনি জানেন এই যুদ্ধে জয় পরাজয় সমান। যেখানে জয়লাভের কোন সার্থকতা নেই। সেখানে একটা অনর্থক ধ্বংসের পথে ধাৰ্মিক হয়ে আপনি দেশকে ঠেলে দিতে পারেন না। ধরে নিন। পাপমতি দীপিত দুৰ্যোধন আপনাকে ন্যায্য রাজ্যাধিকার দেবে না। তাই বলে আপনি দেশ জ্ঞাতি ও কুলের ধ্বংস ডেকে আনতে পারেন না। দুৰ্যোধন রাজ্য দিতে রাজী না হলে ধর্মের জন্য আপনাদের বরং ভিক্ষা করেও বেঁচে থাকা ভাল। কিন্তু যুদ্ধ করা কখনও উচিত নয়। এই নির্লজ্জ প্ৰস্তাবের চাতুৰ্যময় অভিসন্ধি বুঝতে যুধিষ্টিরের বিন্দুমাত্ৰ দেরী হল না। তবু তিনি দ্বিধায় পড়লেন। শেষ পৰ্য্যন্ত রাজ্যের দাবী ছেড়ে দিলেন। সঞ্জয়কে বললেন-আপনি গিয়ে বৃদ্ধরাজাকে বলুন আমরা রাজ্য চাই না, কিন্তু তিনি যেন শুধুমাত্র পাঁচখানা গ্রাম আমাদের ছেড়ে দেবার জন্য নিজপুত্রকে রাজী করান। যুদ্ধ হবে না। সঞ্জয়কে পাঠিয়ে দিয়েই যুধিষ্ঠির নিশ্চিন্ত হলেন না। এই অবিশ্বাস্য সর্বনিম্ন সর্তে ধৃতরাষ্ট্র ও দুৰ্যোধনকে রাজী করাবার জন্য, আপোষ্যমীমাংসার শেষ প্রচেষ্টার জন্য তিনি কৌরব সভায় কৃষ্ণকে পাঠালেন। এ সময়ে ভীমসেনের আশাতীত ব্যবহারে আমরা বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হই। কৃষ্ণকে ভীম বলছেন-আমি তোমার কাছে জানু পেতে ভিক্ষা চাইছি। তুমি অকপট ও নিরলস ভাবে এ যুদ্ধ বন্ধ করার চেষ্টা কর। মনে রেখো আমরা কেউ এই কুলক্ষয়ী যুদ্ধ চাইনা। আরো মনে রেখো, দুৰ্যোধন বড় অহঙ্কারী। তার অহঙ্কারে আঘাত দিয়ে কোনো কথা বলে না। পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করলে কৌরবরা ধ্বংস হবে এমন ভয়-দেখানে কথা বলোনা। আমাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলোনা। নিরপেক্ষের মত কথা বলবে, দুৰ্যোধনের অহঙ্কার আহত হলে বিপরীত ফল ফলবে। এ যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য তোমার সর্বশক্তি নিয়োগ কর। এই অকপট মহতী শুভেচ্ছা যখন অবজ্ঞাত ও প্রতিহত হল, যুদ্ধ যখন আনিবাৰ্য্য হয়ে উঠল তখন কিন্তু ভীমসেন মহাকালরূপী কৃষ্ণের বিশ্বন্ত সহযোগী। তার কোমল সরল হৃদয় তখন কুলিশকঠোর, সেখানে শত্রুর জন্য আর একবিন্দু ক্ষমাও অবশিষ্ট নেই।
কৃষ্ণ হস্তিনাপুরে পৌঁছে বিদুরের অতিথি হলেন। বিদুর বললেন–আপনি ফিরে যান, আপনার কথা কৌরবরা শুনবেনা। আপনার অপমান হবে। অস্থানে আপনার প্রচেষ্টা বিফল হতে বাধ্য। কৃষ্ণ বিদুরকে যে উত্তর দিয়েছিলেন, তার মধ্যে শুধু কৃষ্ণচরিত্র নয়, মহাভারতের মূল বক্তব্যের নির্দেশও সেখানে রয়েছে–বিদুর, তুমি ঠিকই বলেছি, ধৃতরাষ্ট্র-পুত্ৰগণ দুরাত্মা সন্দেহ নেই। কিন্তু একথাও মনে রাখবে–
পৰ্য্যস্তাং পৃথিবীং সৰ্বাং সাশ্বাং সরথকুঞ্জরাম।
যো মোচায়েন মৃত্যুপাশাত প্ৰাপ্লুয়াদ ধর্মমুত্তমম্।
–এই পৃথিবীকে মৃত্যুপাশ থেকে যে মুক্ত করতে পারবে সেই লাভ করবে পরম ধর্ম। কৃষ্ণ বলে চললেন–ধর্মপ্ৰচেষ্টা বিফল হলেও ধর্ম নষ্ট হয় না। আমি অকপট ভাবে (অমায়য়া) মীমাংসার চেষ্টা করব। আমি পাণ্ডব কৌরব সকলেরই হিতকামনা করি। পৃথিবীর হিতকামনা করি। ধামিকরা যেন মনে করতে না পারেন, মূঢ় শত্রুরা যেন অপবাদ দিতে না পারে, কৃষ্ণ যুদ্ধ বন্ধ করতে পারত, কিন্তু বন্ধ করার চেষ্টা করেনি।
মানুষ ও পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা মানুষের পরম ধর্মকুরুক্ষেত্রযুদ্ধের উদ্যোগপর্বে কৃষ্ণের মুখে মহাকাব্যকার সর্বকালের সর্বদেশের মানুষকে এই চিরায়ত মানবধর্মের বাণী শুনিয়েছেন। কিন্তু দপিতের উদ্ধত দৰ্প, লোভীর উদগ্র লালসা যদি সকল শান্তিপ্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়, যদি যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলতে চায়, তবে কি নির্বিরোধী শান্তিবাদী মানুষ অত্যাচারীর লালসাসিক্ত অহঙ্কারের কাছে আত্মসমৰ্পণ করে বৈরাগ্যের পঞ্চ বেছে নেবে ? উদ্যোগপর্বে শান্তি প্ৰচেষ্টার ব্যর্থতার পর মহাভারতের সমগ্ৰ ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে মহাকবি এর উত্তর দিয়েছেন। আত্মসমর্পণ নয়। লোভীর নিষ্ঠুর লোভ যদি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় যুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু ভবিষ্যতের দৃষ্টি স্বচ্ছ ও উন্মুক্ত রেখে বিবেককে কলুষিত না করে যুদ্ধ করতে হবে; নিতান্ত অকপট শান্তি প্ৰচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর কৃষ্ণের ভূমিকা আকস্মিকভাবে পরিবতিত হল। যুদ্ধ যখন অনিবাৰ্য্য ভাবে উপস্থিত হয়েছে তখন সৰ্বাত্মক প্ৰস্তুতি ছাড়া উপায় নেই। নিরলস শান্তির দূত দেখা দিলেন নির্মম ধ্বংসের হোতা হিসাবে।
মহাভারতের কৃষ্ণচরিত্র বুঝতে হলে একথাটি মূলতঃ বুঝতে হবে,–কৃষ্ণ মহাভারতের অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে ‘একটি চরিত্ৰমাত্ৰ’ নয়! কৃষ্ণ চরিত্রাতীত চরিত্র, অর্থাৎ কৃষ্ণই মহাভারত। মহাভারতের সাহিত্যিক, দার্শনিক ও মানবিক মূল্য যে গভীরতম তাৎপৰ্য্যের মধ্যে একাকার হয়ে মিশে গেছে— কৃষ্ণ মহাভারতের সেই সমগ্র আত্মস্বরূপ। মানুষ ও পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা পরম মানবধর্ম | কিন্তু স্বার্থান্ধ লালসা যদি এই ধৰ্মবোধকে কলুষিত করে, অবমানিত করে, ধ্বংসের পথ থেকে প্রতিনিবৃত্ত না হয় তা হলে মহামানব নেমে আসে মহাকালরূপে। তখন দয়া নেই, ক্ষমা নেই। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ মিলেই তখন মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। মানবসভ্যতার এই মূলনীতি। এই নীতিরই মূৰ্তিমান বিগ্ৰহ শ্ৰীকৃষ্ণ। কৃষ্ণের বহু কৰ্ম আমাদের আপেক্ষিক নীতিবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তার কারণ মূল নীতিকে অন্য কোন নীতি দিয়ে বিচার করা যায় না। তাহলে অনবস্থা দোষ বা infinite regress এসে পড়ে। যেমন ধরুন, ঈশ্বর-বিশ্বাসী ভক্তের ঈশ্বর কিন্তু স্বয়ং নিরশ্বর, কারণ তাঁর উপর অন্য ঈশ্বর মানা হলে তিনি নিজে ঈশ্বর হতে পারেন না। তেমনি মানবের উচ্চতম নৈতিক আদর্শকে অন্য কোনো আদর্শ দিয়ে মাপা যায় না–God of the theists must Himself be an atheist just as the most fundamental moral law must itself be un moral. মানবাত্মার গৌরব পদ দলিত হলে মানবরূপ মহাকালরূপে আবির্ভূত হয়—মহাভারতের এই বাণীরূপই হল শ্ৰীকৃষ্ণ। তাই শান্তির দূত ধ্বংসের হোতারূপে আত্মপ্রকাশ করলেন। এই অর্থেই শ্ৰীকৃষ্ণ চরিত্রাতীত চরিত্র। কৃষ্ণই স্বয়ং মহাভারত।