তাহলে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনগুলি অতিশয়োক্তি হলেও নিতান্ত নিষ্প্রমাণ ও নিরর্থক নয়। মালিকের পণ্য বিক্রয়ের সহায়ক বলে-“বোর্ণ ভিটা কিন্নুন’ এই আসল বিধিবাক্যটির সঙ্গে একাৰ্থতা বা একবাক্যতা লাভ করে অর্থবাদরূপী বিজ্ঞাপনটি বাহুল্যও সার্থকতা লাভ করেছে। পূর্বমীমাংসা-প্ৰদৰ্শিত বৈদিক অর্থবাদ-বাক্যই কি বর্তমান যুগে ব্যবসায়ীদের বিজ্ঞাপন রূপে অবতীর্ণ হয়েছে?
আমাদের দেশের ব্যঞ্জনাবাদী আলিঙ্কারিকরা মীমাংসকদের কাব্যরসানভিজ্ঞ বেরসিক বলে তিরস্কার করেছেন। এতটা তিরস্কার হয়ত এদের প্রাপ্য নয়। কারণ অর্থবাদের প্রামাণ্য মেনে নিয়ে মীমাংসকরা কাব্য-সাহিত্যের প্রকাশভঙ্গির মূল মাহাত্ম্যটি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন। কাব্য-সাহিত্যের রস-অলঙ্কার-ধ্বনি এ সবই কিন্তু এক অর্থে অর্থবাদের খেলা। রাস্তায় নিরন্ন ভিখারীর কান্নাকে বিদগ্ধজন করুণরসের অভিব্যক্তি বলবেন না। ভিখারীর কান্না সাহিত্যের পাতায় কথার সাজে সাজলে তবেই রসিক সুজন রসাস্বাদ করবেন। রসিকের আবদার বড় বেশী। পরের দুঃখকেও তিনি আনন্দরূপে উপভোগ করতে চান। অর্থাৎ বস্তুসত্য স্বরূপে উপস্থিত হলে রসিকের রস – ভঙ্গ হবে। সত্যকে অভিনয়ের সাজ পরতে হবে, কথার বিনুনি বুনতে হবে, শোককে শ্লোকের ঘটা দিয়ে ঢাকতে হবে, তবেই শোক রসারূপে প্ৰকাশ পাবে। রাসবাদী আলিঙ্কারিকের মতে অলঙ্কার মূলতঃ রসকেই অলঙ্কত করে, কারণ পরোক্ষভাবে রস-প্রকাশে সাহায্য করাই অলঙ্কারের কাজ। সুবৰ্ণালঙ্কার আসলে শরীরকে সাজাবার জন্যই ব্যবহৃত হয় না, সুন্দরী গরবিণীর হৃদয়ের গৌরববোধ চরিতার্থ করার জন্য, তার হৃদয়কে সাজাবার জন্যই ব্যবহৃত হয়। আলঙ্কারিক অবশ্য গম্ভীরভাবে বলেন-লৌকিক অনুভূতির আস্বাদনযোগ্য অলৌকিক অনুভূতিরূপে যে প্ৰকাশ তারই নাম সাহিত্যািরস। এতো সহজকে গম্ভীর করার চিরাচরিত পণ্ডিতী কৌশলমাত্র। মানুষের হাসিকায়াকে ঘর-সংসারের গণ্ডী থেকে রঙ্গমঞ্চের আলোকসজ্জায় টেনে আনা হল, ভাষার জৌলুস ঘিরে কবিতার পাতায় ঠাই দেয়া হল। এত সেই বোর্ণভিটার বিজ্ঞাপন। মানুষ হাসে কাঁদে-এই সহজ বস্তুসত্যটিকে ফ্যাশনের পোষাকে পল্লবিত করে প্রকাশ করা হল। সাহিত্য তাহলে অনাড়ম্বর সত্যের সাড়ম্বর বিজ্ঞাপন-পূর্বমীমাংসার অর্থবাদের প্রকারান্তর। ধ্বনিবাদী আলঙ্কারিক মনে করেন সাহিত্যে ব্যঞ্জনাবৃত্তির মাধ্যমে অনুক্ত বহু অর্থকে। স্বল্পোক্তিতে প্ৰকাশ করা সম্ভব। সুতরাং ধ্বনি অতিশয়োক্তির প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক। ভরতনাট্যমের মুদ্রার মত শুধু ইঙ্গিতে, স্বল্পভঙ্গীতে ভাবরাশিকে রস-সমুদ্রে পরিণত করে। ধ্বনির চূড়ান্ত পরিণতি প্রতীকী প্রকাশে এবং প্রতীকী প্ৰকাশের শেষ কথা গাণিতিক ভাষা-যেখানে ভাষার আর দরকার নেই, শুধু প্ৰতীক দিয়েই সব কিছু প্ৰকাশ করা চলে। হে অঙ্ক, কথা কও! ধ্বনিবাদকে প্রতীকবাদে রূপান্তর করলে, প্ৰথম ধরুন, বিশ্বশান্তির জয়যাত্রা বোঝাবার জন্য কাব্যনাটক-উপন্যাস সভা-সমিতি-বক্তৃতা, ইত্যাদি সব কিছু বাদ দেয়া যেতে পারে-মাটিতে লুটিয়ে পড়া একটা হায়েনা বা বাঘের মাথায় একটি ডানামেলা পায়রা বসিয়ে দিন। তবু রং তুলি ইত্যাদির আতিশয্য বাদ দিতে হবে। তাই এখন গণিতের শরণ লউন। পায়রা বোঝাবার জন্য p ব্যবহার করুন, হায়েনা বোঝাবার জন্য h, এখন p/h মানে সভ্যতার কাছে হিংস্রতার পরাজয়। আমি অঙ্ক একেবারে জানিনা বলে এমন কাঁচাভাবে কথাটা বললাম। বার্ট্রাণ্ড রাসেলের সভাপতিত্বে mathematical logician-দের একটা কমিটি তৈরী করে তাদের উপর ভার দিন-মানুষের স্কুল ভাষা বাদ দিয়ে অশরীরী গাণিতিক প্রতীকে কিভাবে সূক্ষ্ম সাহিত্যিক রস থেকে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের সব কিছু প্ৰকাশ করা সম্ভব। সে কায়দা তারা বাতলে দেবেন। এডিংটন বলেছেন, বিশ্বের মূল সত্তা এক অসীম অনন্ত গণিত-মানস বা mathematical mind, যা বিশ্বকারে বিবর্তিত হচ্ছে; সুতরাং গণিতের ফরমুলা ও সমীকরণ দিয়ে এই জগৎপ্ৰপঞ্চ প্ৰকাশ করা অন্তত: theoretically সম্ভব। একাজ করতে পারলে আনন্দবৰ্দ্ধানের আত্মা পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ করবে, কারণ র্তার ধ্বনিবাদের এই চরম বিস্ময়কর সার্থকতা তিনি কোনদিন কল্পনা করতে পারেন নি।
কিন্তু একাজ যে পৰ্যন্ত আমরা করতে না পারি। সে পৰ্য্যন্ত ধ্বনি-কাব্যেও আতিশয়োক্তি থাকতে বাধ্য। কারণ মানুষের ভাষাটাই হল অতিশয়োক্তি। আমাদের দেশের বৌদ্ধ দার্শনিকরা এ কথাটা খুব ভালভাবে বুঝেছিলেন। উৎসববিশেষে ইংলণ্ডের রাণীর গাউনের পিছনে প্ৰায় আধ ফার্লং লম্বা একটি পুচ্ছ থাকে, রাজকীয় কুটুর্ঘটনারীগণ এই পুচ্ছের ভার বহন করে রাণীর পিছনে বহুযুগস্থায়ী মঠ ও বিহার তৈরী করেছেন। প্ৰাচীন নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্ট খুব রসিক লোক ছিলেন, বৌদ্ধদের স্ববিরোধী ব্যবহার উল্লেখ করে তিনি চমৎকার একটি শ্লোক লিখলেন–
‘নাস্ত্যাত্মা ফলভোগমাত্রমথ চ স্বৰ্গায় চৈত্যাৰ্চনং
সংস্কারাঃ ক্ষণিকা যুগস্থিতিভূতশ্চৈতে বিহারাঃ কৃতাঃ।
সৰ্বং শূন্যমিদং বসূনি গুরবে দেহীতি চাদিশ্যতে
বৌদ্ধানাং চরিতং কিমন্যদিয়াতী দম্ভস্য ভূমিঃ পরা॥’
–ক্ষণিক বিজ্ঞানধারার অতিরিক্ত আত্মা বলে কিছু নাই, অথচ পরলোকে স্বৰ্গফল ভোগ করার জন্য চৈত্যমূলে পূজাৰ্চনা করা হয়। সব কিছুই ক্ষণিক সংস্কারমাত্র, অথচ বহুযুগস্থায়ী বিহার নির্মাণ করা হয়েছে। সব কিছুই শূন্য, কিন্তু গুরুকে ধনদৌলত দান কর, এ আদেশটি শিষ্যকে ঠিকই দেয়া হয়ে থাকে। এই চূড়ান্ত ভণ্ডামি ছাড়া বৌদ্ধদের চরিত্র আর কি হতে পারে। জয়ন্তভট্ট শেষের দিকে একটু কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছেন। আমরা তা করব না। শুধু এটুকু বলব–ভাষার মাধ্যমে সত্যাৰ্থ প্ৰকাশ করা যায় না, এই পরম সত্যটি প্রকাশ করার জন্য কয়েক শ’ বই না লিখে একেবারে শূন্যসিদ্ধিতে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকাই বৌদ্ধদের উচিত ছিল।