কোন গ্রন্থের মূল তাৎপৰ্য্য বুঝতে হলে উপক্রম ও উপসংহার মিলিয়ে দেখতে হবে। এ নীতি আমাদের দেশে প্ৰাচীনকাল থেকে স্বীকৃত। মহাভারতের আরম্ভ থেকে শেষ পৰ্য্যন্ত এমন একটা অত্যাশচাৰ্য্য নীতিগত মিল রয়েছে যাকে উপেক্ষা করে শুধু বহিরঙ্গগত অনৈক্যের ওপর জোর দিলে বিচারকর্তার দৃষ্টিদৈন্য প্ৰকাশ পেতে বাধ্য। একটি বলিষ্ঠ বক্তব্য এই মহাকাব্যের ভূমিকা থেকে আরম্ভ করে কুরুক্ষেত্রের ধ্বংসযজ্ঞ পার হয়ে স্বৰ্গারোহণ পর্বে গিয়ে পরিণতি লাভ করেছে। এদিকে লক্ষ্য না রেখে মহাভারতের প্রথম দিকটা প্রক্ষিপ্ত এবং স্ত্রীপর্বের পরবর্তী সমুদয় অংশ প্ৰক্ষিপ্ত–এজাতীয় গবেষণা সাহিত্যের ওপর ঘোরতর অবিচার এবং গবেষণার নামে বুদ্ধির ব্যভিচার।
মহাভারতের প্রারম্ভিক ভূমিকা বা অনুক্রমণীপর্বেই এই বিরাট কাব্যের তাৎপৰ্য্যগত ইঙ্গিত রয়েছে। লক্ষ্য করা দরকার এই ভূমিকাটির প্রায় অর্ধেক জুড়ে আছে বিখ্যাত ধৃতরাষ্ট্ৰবিলাপ– সেই সুপ্ৰসিদ্ধ “তদা নাশংসে বিজয়ায় সঞ্জয়” দিয়ে আরম্ভ করা শ্লোকগুলি। রিক্ত ও নিঃশেষিত অন্ধ রাজার এই আর্তীরোদনের শেষ কথাটি লক্ষ্য করুন। ধৃতরাষ্ট্র বলছেন—এই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ভারতবর্ষের ক্ষত্রির বীরদের মধ্যে বেঁচে রইল মাত্র দশজন; পাণ্ডব পক্ষে সাত জন, কৌরবপক্ষে তিন জন। স্ত্রীপর্বে কুরুক্ষেত্রেযুদ্ধের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে ধৃতরাষ্ট্র ভীমকেও ঠিক এই কথাটাই একবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। অযুত হস্তীর দৈহিক বল নিয়েও এই বৃদ্ধ রাজার চিত্ত শিশুর চেয়েও দুর্বল, কিন্তু শিশুর মত সরল মোটেই নয়। অন্তরে বাইরে অন্ধ এই রাজা অন্যায়কে অন্যায় জেনেও অসহায়ের মত প্রশ্ৰয় দিয়েছেন, সারা ভারতবর্ষের ধ্বংসের পথ প্ৰশস্ত করেছেন, অথচ এতটা অসহায় তিনি ছিলেন না। এত বড় একটা ধ্বংসের নৈতিক দায়িত্ব তাকে বহন করতে হয়েছে, তাই প্ৰলয়-শেষের প্ৰেতাত্মার হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাসের বোঝাও তাকেই বহন করতে হবে। মহাভারতের ভূমিকাতেই গ্রন্থকার কুরুক্ষেত্ৰ-মহাশ্মশানের এই জাগ্ৰত প্রেতিমূতির মুখোমুখী পাঠকদের দাঁড় করিয়েছেন এবং তার একটানা দীর্ঘশ্বাসের মধ্য দিয়ে কুরুক্ষেত্ৰযুদ্ধের যবনিকাপাত পৰ্যন্ত মহাকাব্যের সংক্ষিপ্তসার বিবৃত করেছেন। ভিতরে বাইরে নিঃস্ব এই অন্ধ রাজার নিঃশ্বাসবায়ু যেন সমগ্র মহাভারতের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে এবং মহাপ্ৰস্থানের পথে পাণ্ডবদের পার করিয়ে দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়েছে। মহাকাব্যের মূল সুর সুরুতেই বাধা হয়ে গেছে।
কিন্তু এই মূল সুরটিই মহাভারতের মূল বক্তব্য নয়। একটি শোকবিদীর্ণ পিতৃহৃদয়ের উন্মুক্ত ক্ষত হতে যেন কুরুক্ষেত্রের সকল কলুষরাক্ত ঝরে পড়ছে, মহাকাব্যকার অনুক্রমণীপৰ্বই এই রক্তক্ষর হৃদয়টি পাঠকের সামনে মেলে ধরেছেন। এর ফলে পাঠকবর্গ প্রারম্ভেই মহাকাব্যের অন্তনিহিত আত্মিক পরিমণ্ডল বা Inner spiritual climate-এর সঙ্গে পরিচিতি লাভ করেন। এই প্রারম্ভিক পরিচিতি মূল বক্তব্য অনুধাবন করতে সাহায্য করে।
এখন ধৃতরাষ্ট্রের পাশাপাশি আর একটি চরিত্রকে আমরা দাঁড় করিয়ে দেখতে পারি। ইনি হলেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। এই মানুষটি রাজা হতে চাননি, কিন্তু রাজা তাকে হতে হয়েছে। যুদ্ধ করতে চাননি, কিন্তু অনিচ্ছুক হাতে তঁাকে অস্ত্ৰধারণ করতে হয়েছে। অভিশাপগ্ৰস্ত সিংহাসনের পক্ষে তার অনিচ্ছুক পাদুখানিকে চালিয়ে নিতে হয়েছে। কুরুক্ষেত্রের রক্তপ্লাবনে তার কোন অপরাধ নেই। কিন্তু মহত্তম মানবিক বিবেকের কাছে বার বার তিনি নিজেকে অপরাধী মনে করেছেন। তিনি ভারতের অধীশ্বর হলেন। কিন্তু সাম্রাজ্য র্তার কাছে এক সান্তনাহীন নিঃসীম মরুপ্রান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্ধ বৃদ্ধ রাজার হিমশীতল নিঃশ্বাস, কুরুক্ষেত্রের শবরাশির উপর বিলুষ্ঠিত সর্বহােরা বিধবাদের বুকফাটা কান্না বার বার তার বুকে বেজেছে। জয়লাভের শূন্যতাবােধ কোন বিজেতার হৃদয়কে এমন করে আর ক্ষতবিক্ষত করেনি। এই মানুষটি দিনের আলোয় যুদ্ধ করেছেন। রাত্রির অন্ধকারে নিহত মানুষদের জন্য কেঁদেছেন। কুরুক্ষেত্ৰকাব্যের ট্রাজিডি যারা মারা গেল তাদের নয়। এ ট্রজিডি তাদের যারা যুদ্ধশেষের ভস্মরাশির তলে প্রধূমিত বেদনাবহি চাপা দিয়ে নির্মম প্ৰায়শ্চিত্ত করার জন্য বেঁচে রইল।
উরুভঙ্গের পর ভূপতিত দুৰ্যোধনের মস্তকে ভীম বামপদের আঘাত হানলেন। তখন ভীমের প্রতি যুধিষ্ঠিরের সুকঠোর তিরস্কারের মধ্যে পাশবিক প্রতিশোধস্পৃহার বিরুদ্ধে মানবিক বিবেকের সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে। যন্ত্রণাক্লিষ্ট দুৰ্যোধনের মুখের উপর ব্যথাহত দৃষ্টি স্থাপন করে যুধিষ্ঠির বললেন –হে নিষ্পাপ বীর, তুমি দুঃখ করোনা, মৃত্যু তোমার গৌরবে বরণীয়, তোমার আত্মা শোচনীয় নয়। আমরাই এখন শোচনীয়, যারা প্রত্যেক মুহূর্তে নরকযন্ত্রণা ভোগ করে বেঁচে থাকব, শোকবিহ্বল বিধবাদের ধিক্কার ও অভিশাপ কুড়িয়ে বেঁচে থাকব।
মহাভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বিয়োগান্ত নায়ক বা ট্রাজিক হিরো এই যুধিষ্ঠির, মহত্তম মানবিক মূল্যবোধের প্রতিভূ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, উদ্ধত বিজয়গৌরব যাঁর বিবেককে মুহুর্তের জন্যও ম্লান করতে পারেনি। কুরুক্ষেত্রের মহাশ্মশানে নিঃসঙ্গ পদসঞ্চারী ধৃতরাষ্ট্রের বিপরীতমুতি এই মহাকাব্যের নিঃসঙ্গ মহানায়ক। যুধিষ্ঠির কুরুক্ষেত্রের ভস্মশেষে জাগ্ৰত মানবাত্মা। বিজয়লাভের বেদনায় অবনত, মানবিকতার মহিমায় সমুন্নত বিক্ষত হৃদয় এই মানুষটিকেই মহাভারতের গ্ৰন্থকার ভারতবাসীর হৃদয়ে ধর্মরাজের আসনে প্ৰতিষ্ঠিত করেছেন। একথাটি না বুঝলে মহাভারত বোঝা হয়না।