মানুষ যেদিন কথা বলতে শিখেছে সেদিন থেকেই মানবিক চেতনার ঐক্যের ভিত্তি রচিত হয়েছে। সমাজের ভিতরে বিরোধ, সংঘাত, শ্রেণী-দ্বন্দ্ব, সব কিছু নিয়েও এই ঐক্য আরও পরিব্যাপ্ত হয়েছে। ভাষার সমৃদ্ধি ও গভীরতা এবং এই ঐক্যের পরিব্যাপ্তি দোসররূপে এগিয়ে চলেছে। সভ্যতার অগ্রগতিতে ভাষার এই সাধারণীকৃতির অসাধারণ গুরুত্ব অনস্বীকাৰ্য্য। সাহিত্যে আমরা যে সাধারণীকৃতির কথা আলোচনা ক’রে থাকি তা এই সাধারণ মানুষের সাধারণ ভাষার মৌলিক সাধারণীকৃতিরই এক উন্নততর, গভীরতর রূপ। ভিত্তি ছাড়া ইমারত হয় না। বহু আধুনিক কাব্যসাহিত্য যে রসোত্তীর্ণ হয় না, তার কারণ মানবিক ভাষা-ভিত্তিই সেখানে স্খলিত ও বিপৰ্য্যস্ত। শূন্যোদ্যান হয়ত বেবিলনে ছিল, কাব্যে সাহিত্যে কোনদিন ছিল না।
মহাভারতের তাৎপর্য
রামকৃষ্ণদেবের একটি চমৎকার গল্প হয়ত অনেকেরই জানা আছে। দুই ভাইয়ের সংসার। বড় ভাই অসার সংসারমায়া ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হল। ছোট ভাই গৃহস্থ ধর্ম নিয়ে ঘরে পড়ে রইল। সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে বড় ভাই বার বছর পরে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এল। ছোট ভাই জিজ্ঞাসা করল—দাদা, ঘরসংসার ছেড়ে বার বছর তপস্যা করে কি পেলে তুমি? বড় ভাই ছোট ভাইকে নদীর ধারে টেনে নিয়ে গেল, জলের ওপর দিয়ে গট গট করে হেঁটে নদী পার হয়ে গেল। আবার হেঁটে ফিরে এল, বলল–দেখলি তো কি শিখেছি? ছোট ভাই বলল–দুপয়সা দিলে খেয়া নৌকো করেই তো নদী পার হওয়া যায়। তাহলে বার বছর ধরে সংসার ছেড়ে কঠোর সাধনা করে তুমি শেষ পৰ্যন্ত দুপয়সার বিদ্যা আয়ত্ত করেছ?
আজ বিংশ শতকের বানপ্ৰস্থদশায় বিজ্ঞানের রকেটচারিণী জয়যাত্রার কথা মনে রেখেও রামকৃষ্ণদেবের গল্পটির তাৎপৰ্য্য বোধহয় একবার নূতন করে ভাববার প্রয়োজন আছে। বিজ্ঞানের মারফত মানুষ প্ৰকৃতিকে জয় করেছে; আপন প্রয়োজনে প্ৰকৃতির পরিবর্তন ঘটিয়েছে। কিন্তু প্ৰকৃতির উপর মানুষের এই আধিপত্য তার মানসিক জগতে কতখানি প্ৰতিফলিত হয়েছে, মানুষ নিজেকে কতখানি জয় করেছে, বিজ্ঞান মানুষকে কতখানি মানুষে করেছে—এ প্রশ্নের উত্তর আজ মানুষকেই দিতে হবে। Man is a tool-making animal-মানুষ যন্ত্রনির্মাতা প্রাণিবিশেষ, এই কি মানুষের সর্বশেষ লক্ষণ? পশু থেকে মানুষের সেখানে চূড়ান্ত প্ৰভেদ তা হল মানবিক মূল্যবোধ। যন্ত্রবিজ্ঞানের অগ্ৰগতিই যদি মনুষ্যসভ্যতার মাপকাঠি হয়, তবে বলতেই হবে এখন পৰ্য্যন্ত মনুষ্যত্বের চরম গৌরবময় বিকাশ ঘটেছে মার্কিন মুলুকে। ভিয়েটনামে এই মার্কিনী মনুষ্যত্বের মহিমা দেখে আমাদের শ্রদ্ধায় অভিভূত হওয়া উচিত ছিল।
মানুষ বেঁচে থাকবে, জন্তুর মত বাঁচবে না, শিক্ষা দীক্ষা জ্ঞান বিজ্ঞান, সাহিত্য দর্শন ও শিল্পকলায় সমৃদ্ধ সুস্থ সবল সভ্যতার সক্রিয় অংশীদার হয়ে বেঁচে থাকবে। এর জন্য জৈব জীবনের ভিত্তিটা তার সুনিশ্চিত হওয়া চাই, না হলে বাঁচাই অসম্ভব। সেই ভিত্তির ওপর মানবিক নীতিবোধে সমুন্নত সভ্যতা গড়ে উঠবে। একের বেঁচে থাকার সুযোগ কেড়ে নিয়ে অন্যের জীবন প্ৰতিষ্ঠার প্রচেষ্টা পশু প্ৰকৃতির বিকারমাত্ৰ। এই মানবতাবিরোধী পাপাচারকে মানুষের সমাজ থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। এই নীতিবোধই হল মানবিক মূল্যবোধের মূলভিত্তি। বর্তমান সমাজ-বিজ্ঞানের ইতিহাসে পুজিবাদী সভ্যতা ধিক্কত, কারণ এ সভ্যতা আদিম শ্বাপদ বৃত্তির পরিণত প্ৰকাশ, এ সভ্যতা ব্যক্তিস্বাধীনতার নকল নামাবলীর অন্তরালে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির স্বার্থে সমাজের সম্পদ কেড়ে খাওয়ার হিংস্র পশুতন্ত্রকে গায়ের জোরে কায়েম রাখতে চায়। এর হিংস্রতায় বৈজ্ঞানিক নৈপুণ্যের চমক আছে, এর শোষণব্যবস্থায় ধর্ম ও স্বাধীনতার মুখোশ আছে। কৌটিল্যাতন্ত্রের কুটিলারঙ্গে এ সভ্যতা মানুষের মুখকে মুখোশে পরিণত করেছে, মানবিক মূল্যবোধকে শ্বাসরুদ্ধ করেছে। আর একটি বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কার মূলেও রয়েছে মনুষ্যত্বের এই চরম অবমাননা, নীতির ওপর লালসার এই আধিপত্য। এ অপমানের নির্মম প্ৰায়শ্চিত্ত না করে মানুষের নিস্কৃতি নেই।
সুদূর অতীতে সারা ভারতবর্ষের মানুষকে এমনি এক নিষ্করুণ প্ৰায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল। একটি রাজপরিবারের উদ্ধত দম্ভ ও লালসা সেদিন সমস্ত দেশে ধ্বংস ডেকে এনেছিল। মানুষের মৌলিক মূল্যবোধ কলুষিত ও বিপৰ্য্যন্ত হলে মহাকাল ক্ষমা করে না—এই গভীর তাৎপৰ্য্যই সেদিন উদঘাটিত হয়েছিল। ভারতের মহাকাব্য মহাভারত।
পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতরা মহাভারতকে দেখেছেন বহিরঙ্গ দৃষ্টিকোণ থেকে। মহাভারতের কোন অংশ সুপ্রাচীন এবং কোন অংশ অপেক্ষাকৃত প্রাচীন এ নিয়ে, তারা পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা করেছেন এবং সিদ্ধান্ত করেছেন যে খ্ৰীষ্টপূর্ব চারশ সাল থেকে চারশত খ্ৰীষ্টাব্দ পৰ্যন্ত প্ৰায় এই আটশত বছর ধরে মহাভারত বর্তমানের এই বিপুল কলেবর লাভ করেছে। মহাভারত এক ব্যক্তির লেখা নয়। মূল লেখকের লেখার সঙ্গে পরবর্তী বহু অখ্যাত অজ্ঞাত লেখকের লেখা সংযোজিত হয়েছে। ফলে মহাভারতের আকার হয়েছে বিপুলকায় প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মত ( literary monster ), যার বিসদৃশ উদ্বত্ত অঙ্গ প্ৰত্যঙ্গগুলি শিল্পদূষ্টিতে বড় বিকট ও বেমানান ঠেকছে। এ জাতীয় গবেষণার প্রয়োজন আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু শুধু এই আকারগত দৃষ্টি দিয়ে মহাভারতকে দেখলে এই মহাকাব্যের অন্তনিহিত তত্ত্ব গবেষকের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে বাধ্য। একটা কথা মনে রাখা দরকার, যে যুগে মহাভারত প্ৰথম লেখা হয়েছিল সে যুগে চিন্তাবিদদের চিন্তাধারায় সাহিত্য, দর্শন ও ধর্ম পৃথক পৃথক শিল্পসত্তার লক্ষণ নিয়ে আবিভূতি হয়নি। ঔপনিষদিক যুগ থেকে মহাভারতীয় যুগের কালগত ব্যবধানটা বিরাট নয়। বেদ ও উপনিষদে যেমন সাহিত্য, দর্শন ও ধর্ম একাধিকার হয়ে মিশে গেছে, মহাভারত ও তার ব্যক্তিক্রম নয়, যদিও মহাভারতে সাহিত্যদৃষ্টি বেদ ও উপনিষদের যুগ থেকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। পরবর্তী কালের অলঙ্কার-শাস্ত্রীদের নিয়ম কানুন দিয়ে রামায়ণমহাভারতকে বাধা যায় না, বিশেষ করে মহাভারতকে। তাই ভারতীয় ঐতিহ্যিক দৃষ্টিতে মহাভারত সাহিত্য মাত্র নয়, সাহিত্যের অনেক ঊর্ধ্বে। মহাভারতের ভূমিকায় একে বলা হয়েছে উপনিষদ। এর কারণ বোধ হয় এই সে মহাভারতের মূল ঘটনাত্ৰোত ও চরিত্রবিন্যাসের মধ্য দিয়ে এমন একটি কালাতীত বক্তব্য উপস্থিত করা হয়েছে যা নিজস্ব সাহিত্য গণ্ডী প্যার হয়ে সর্ব যুগের সর্ব মানুষের সামাজিক অন্তরাত্মার গভীরতম মানবিক মূল্যবোধকে উচ্চতম দার্শনিক পৰ্য্যায়ে উন্নীত করেছে, সামাজিক ঘটনাবলীর সংঘাতে মানুষের চরিত্রের অন্তস্থল অবারিত হয়েছে, এবং এই বহু মানুষের বিচিত্র মিছিলের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে এসেছে মানবিক সত্তার দার্শনিক মূল্য যাকে শুধু আর সাহিত্যের মধ্যে ধরে রাখা যায় না।