এখন প্রশ্ন উঠবে abstraction কি বাস্তব? যার বস্তুসত্তা নেই, বিস্তু শব্দানুপাতী একটা সাধারণ” ধারণা মাত্ৰ আছে তারই নাম দেয়া হয়েছে “বিকল্প”। বৌদ্ধ দার্শনিক প্ৰতিভার প্রকৃষ্ট প্ৰকাশ ধৰ্মকীতি। তিনি শত শত পঠা ধরে শাণিত যুক্তি ও বিস্ময়কর বিশ্লেষণী শক্তির দ্বারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, সামান্য বা universal বিকল্প মাত্র, বাস্তব নয়। অতীত ও ভবিষ্যৎ বাস্তব নয়। কিন্তু মানুষের ভাষার এমনি মহিমা যে বস্তুজগতে যা নেই তাকে ও সামান্যাকারে মানবিক ধারণার মধ্যে বর্তমানরূপে উপস্থিত করে। মানুষের ভাষা নাস্তিকে অস্তিরূপে মানবচেতনায় প্রতিফলিত করে। এ জন্যই সামান্যকে বাস্তব বলা যায় না, অথচ ব্যবহারিক জগতে এর উপযোগিতাও অস্বীকার করা যায় না। এই বলেই সুনিপুণ দার্শনিক সতর্ক হয়ে গেলেন-এ জাতীয় বিকল্প ধারণা যে মানুষের চেতনায় উপস্থিত হয়, সেই উপস্থিতিকে তো অবলুপ্ত করা যায় না। বিকল্পের সত্তা নেই, তার মানে কি এই যে ধারণার উপস্থিতিটাই মিথ্যা? একথা বললে তা স্ব-সংবেদনরূপী স্ব-লক্ষণটিও মিথ্যা হয়ে যাবে। তখন বলতেই হল-বিকল্প স্বরূপগত ভাবে মিথ্যা নয়, কিন্তু তার বস্তু-নির্দেশ-সম্বন্ধ বা referential relationটি মিথ্যা। বিকল্প স্বাতিরিক্ত কোনো বস্তুকে নির্দেশ করে না। অর্থাৎ শব্দার্থের বাচ্য-বাচক সম্বন্ধটা শব্দ ও বিকল্পরূপী সামান্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিকল্পতিরিক্ত কোনো বস্তু শব্দার্থ নয়।
কিন্তু একথা ব’লে বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ দর্শন এক বিপদের সম্মুখীন হতে বাধ্য। বিকল্প বা সামান্য স্বরূপগতভাবে মিথ্যা নয়, একথা স্বীকার করলেই আমাদের বর্তমান আলোচনার দার্শনিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। বিকল্প স্বরূপগত ভাবে সত্য-এর দ্বারা বৌদ্ধ দার্শনিক বোঝাতে চেয়েছেন, আপনার চেতনা ধৃত সাধারণ ধারণাটি আপনারই আয়ত্ত, আমার নয়। এবং আমার চেতনা ধৃত সাধারণ ধারণাটি আমারই আয়ত্ত, আপনার নয়। কিন্তু এতে পারমাথিক প্ৰবক্তার কথা হল, “সাংব্যবহারিকের” কথা নয়। বিজ্ঞানবাদীর পারমাথিক তত্ত্ব আমরা আলোচনা করছি না, ব্যবহারিক তত্ত্বই আলোচনা করছি। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বৌদ্ধমতি গ্রহণ করলে এ কথা ও মানতে হয় যে বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে অর্থবোধের কোনরূপ সমতা নেই। দুজনে একই শব্দ বা বাক্যের দ্বারা একই অর্থ বোঝেন না। মানুষের ভাষা থাকা না থাকা একই কথা। ভাষাটা পেটের ভিতরে appendix-এর মত একটা বৰ্জনীয় বাহুল্যমাত্র। কিন্তু আপনি যদি আমাকে বলেন ‘বইখানা দিন’, আমি বই খানাই দিই, আপনি যা চেয়েছেন তাই পেয়ে খুন্সী হন। তেমনি আমি টাকা চাইলে যদি আপনার কাছ থেকে টাকা পাই, আমিও খুন্সী হই। দুজনের সাধারণ ধারণার মধ্যে যদি ঐক্য না থাকে, তাহলে ভাষা ব্যবহারের পর বস্তু সম্পর্কিত ব্যবহারে ও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ঐক্য কি করে সম্ভব হল। বৌদ্ধ বললেন, আপনার আমার ধারণা এক নয়, কিন্তু অনুরূপ। কিন্তু কি করে বুঝব অনুরূপ? আমরা দুটি ব্যক্তি নিঃসঙ্গ নিলিপ্ত-স্বতন্ত্র পরস্পরবিচ্ছিন্ন দুটি “সাধারণ ধারণা” নিয়ে নিজ নিজ গুহার মধ্যে আত্মারাম হয়ে বসে আছি। তবু একথা বুঝতে পারছি যে আমাদের দুজনের ধারণা এক না হলেও অনুরূপ বটে। এই আনুরূপ্যের বোধটা কোথা থেকে আমদানী হল? দুটি ধারণাকে অনুরূপ বলে বুঝতে হলে এমন একটি অতিক্ৰান্তিশীল ধারণ-রূপ দরকার, যার ভিতরে আনুরূপ্যাটা প্ৰত্যক্ষ প্ৰতিভাত হয়। আবার সেখানেও যদি আনুরূপ্যের প্রশ্ন ওঠে, অববস্থায় দোষ বা Infinite regress অপরিহাৰ্য্য। সুতরাং যখনই বলি স্বরূপগত-ভাবে বিকল্প সত্য, তখনই স্বীকার করতে হয় বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে বিধৃত সাধারণ ধারণাটি দুটা বিকল্প নয়, কিন্তু এক ও অখণ্ড। এর অর্থ, abbtraction মিথ্যা নয়, ঘোরতর সত্য। চেতনা বহির্ভূত ধারণা অসম্ভব। তাই ধারণার ঐক্য মানে চেতনার ঐক্য। এই ঐক্যকে অস্বীকার করা আর মানুষের ব্যক্তি-সত্তাকে দ্বীপান্তরে নির্বাসন দেয়া একই কথা। এই জন্যই মানুষের ভাষার ভিত্তিতে যে সমাজমানস গঠিত হয়, তা মিথ্যা abstraction নয়। সে abstraction-এর এমন এক বাস্তব সত্তা রয়েছে, যাকে শুধু বিমূর্ত metaphysical non-sense বলে উড়িয়ে দিলে মানুষের বনিয়াদকেই উড়িয়ে দিতে হয়। একে Idealism-ই বলুন আর Materialism-ই বলুন, নিজের সমস্ত ব্যবহারিক কাৰ্য্যকলাপকে অস্বীকার না করে একে অস্বীকার করার উপায় নেই।
বেশ কিছুদিন থেকে আমরা এমন একটা অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে এসেছি যে ‘concrete’ বললেই যেন একটু প্রশংসার স্পর্শ পাই আর ‘abstract’ অনেক সময়ই অনিচ্ছাকৃত ব্যভিচার ঘটিয়ে থাকি। concrete মানেই বস্তু-গৌরবে মহীয়ান এক উজ্জ্বল সত্য নয়। আর abstract মানেই বস্তুহীন অগৌরবের ধূম্রমায়া নয়। বরং দার্শনিক বিচারে এ কথাই সত্য যে concrete-কে যে পৰ্য্যন্ত abstract-এ পরিণত করিতে না পারি। সে পৰ্য্যন্ত কোন কিছুই জানা সম্ভব নয়; ভাষার মাধ্যমে concrete যদি abstract হয়ে না। উঠাত, মানুষে মানুষে মুখ দেখাদেখি হত না। এমন কি মার্কস যখন আহ্বান জানালেন ‘দুনিয়ার শ্রমিক এক হও’, তখনো এই আহ্বানের দার্শনিক ভিত্তি ছিল abstract labour-এর ধারণা। মানুষের শ্রমকে শুধু concrete হিসাবে দেখলে শ্রমিক ঐক্যের কোনো সাধারণ ভিত্তি থাকে না। abstract মানে মিথ্যা হলে শ্রমিক ঐক্যও মায়া।