বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধদৰ্শন ‘স্ব-সংবেদন’কেই একমাত্ৰ প্ৰামাণিক সত্তা বলে স্বীকার করেছে। তাহলে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগটা কি করে সম্ভব হচ্ছে। বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ তার যুক্তির প্রতি একনিষ্ঠ নিষ্ঠ রেখে উত্তর করলেন-এই যোগাযোগটা পারমার্থিক সত্য নয়, ব্যবহারিক সত্য মাত্র, বৌদ্ধ পরিভাষায় ‘সাংবৃত সত্য”। তাহ’লে অহিংসা, প্ৰেম, মৈত্রী, করুণা, সৌভ্রাত্র, কার জন্য? সংঘের শরণ নিয়েই বা লাভ কি? এ জাতীয় প্রশ্নের জন্য বৌদ্ধ দার্শনিক প্রস্তুত ছিলেন। উত্তর করলেন, ব্যবহারিক সত্যু পারমার্থিক সত্যের সোপান হিসাবে কাজ করে। সবাই মিলে সবাইকে ভালবাসব এইজন্য, যাতে সবাই মিলে উপলব্ধি করতে পারি যে পারমার্থিক সত্যের ভূমিতে আত্মার সঙ্গে আত্মার মিল নেই, এক-ক্ষণের আত্মার সঙ্গে পরীক্ষণের আত্মারও কোনো মিল নেই, এক স্থির আত্মা বলে কিছু নেই, আছে স্তম্বু পরস্পর-বিচ্ছিন্ন নিরন্তর প্রবাহ বাহিত এক একটি নিঃসঙ্গ নিলিপ্ত ক্ষণিক বিজ্ঞান। এ নৈরাত্ম্য-ভাবনাই নির্বাণের সাধনা। হিংসা-দ্বেষ-বৈরিতা এই অদ্বৈত নৈরাত্ম্য-সাধনায় বিম্বসূষ্টি করে। মানুষকে আত্মিক বন্ধন থেকে মুক্ত করতে হবে। তাই নিরাসক্তভাবে প্ৰেম মৈত্রী করুণা ও সংঘের উপাসনা প্রয়োজন। সাধনাটা ব্যবহারিক সত্য, নৈরাত্ম্য পারমার্থিক সত্য। উপনিষদ ও বলেছে-‘অবিদ্যায়। মৃত্যুং তীত্ব বিদ্যয়ামৃতমশ্লাতে’, ভর্তৃহরি বলেছেন-‘অসত্যে বস্তুনি স্থিত্বা তত: সত্যং সমীহতে”।
বলা বাহুল্য, অস্তিত্ববাদী দার্শনিক এ জাতীয় চরম মতবাদ চূড়ান্তভাবে অগ্ৰাহ করেন। কিন্তু কেন করেন। তার কোন ন্যায়শাস্ত্রসম্মত দার্শনিক যুক্তি দেখাতে পারেন না। ফলে এই দার্শনিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সদর দরজা দিয়ে না হলেও খিড়কি দুয়ার দিয়ে solipsism অনুপ্ৰবেশ করে। এখানে বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ দর্শন এবং শব্দাদ্বৈতবাদী ভর্তৃহরি-দর্শনের একটা বলিষ্ঠ বক্তব্য আছে। আমরা পারমার্থিক চিন্তাটা স্থগিত রাখলাম। ব্যবহারিক সত্যকেই যদি সত্য ব’লে মেনে চলি তা হ’লে solipsism-এর হাত থেকে যা আমাদের শত হস্ত দূর রাখে সে হ’ল মানুষের ভাষা। মানুষের ভাষাই হল solipsism-এর সবচেয়ে বলিষ্ঠ প্রমাণ ও প্রতিবাদ। ভাষা ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে অক্ষুন্ন রেখেও ব্যক্তিসত্তাকে অতিক্রম করে, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তিকে মিলিত করে। সুতরাং ভাষার ক্ষমতাই মানুষের transcendenceএর ক্ষমতা। যেখানেই ভাষার ব্যবহার সেখানেই ব্যক্তির নির্ব্যক্তীকরণ বা de-personalisation অবশ্যম্ভাবী। না হ’লে পরস্পর বিভিন্ন দুইটি বি-ষম মানুষ সমাৰ্থবোধের অংশীদার হ’তে পারত না। মানুষ বিভিন্ন হলেও বিচ্ছিন্ন নয়, তার প্রধান প্ৰমাণ-মানুষ বাত্ময়। মনের সঙ্গে মনের মিলনের প্রথম নিদর্শন বক্তা ও শ্রোতার মিলন। আপনি গাছ বললে আমি গাছ বুঝি, আমি – পাৰ্থ ব বললে আপনি পাথর বোঝেন। আমাদের কথাগুলো গাছ পাথর কাঁধে নিয়ে ব’য়ে বেড়ায় না, আপনার আমার মগজের মধ্যেও গাছ পাথর গজায় না। তাঁবুতো আমরা পরস্পরকে বুঝি। তা হ’লে গাছ পাথর সম্পর্কে এমন একটি সাধারণ ধারণা বা concept আছে যেখানে আমি আপনি তফাৎ নই। অর্থবোধক শব্দ এই concept-এর বাহন। বাহন বললেও ঠিক বলা হল না। বাহন থেকে আরোহীকে আলাদা করা যায়। কিন্তু শব্দ থেকে concept আলাদা করা যায় না। একেই বলে শব্দার্থের তদাত্ম্য সম্বন্ধ। শব্দ যখন অসাধারণ ব্যক্তিকে সাধারণ করে তখন সে নিজকেই নিজে সাধারণ করে। আমি যখন ভাষার অর্থ বুঝি তখন ভাষাকেও আর বায়ু-তরঙ্গের অভিঘাতসমষ্টি হিসাবে গ্রহণ করিনা, গ্ৰহণ করি সাধারণ অর্থবোধের অন্তরঙ্গ অঙ্গ হিসাবে। সুতরাং ভাষার সাধারণীকৃতি ত্ৰিমুখী। প্রথমত:—ভাষা আমাদের চেতনাগ্রাহ্য বস্তু ব্যক্তিকে একটি সাধারণ ধারণা concept, universal বা ‘সামান্তে’র আকারে রূপায়িত করে। এই সমানীকৃত সামান্যই চেতনাকে রূপ দান করে, অর্থজ্ঞানকে আকার দান করে। দ্বিতীয়ত:–এই সামান্য বা universal-এর সমান ভূমিতে বক্তা ও শ্রোতার ব্যক্তিচেতনা পরস্পর মিলিত হয়। এই অর্থে বক্তা ও শ্রোতার ব্যক্তিসত্তারও সাধারণীকরণ সম্পাদিত হয়। তৃতীয়ত:–শব্দও তার বায়ুতরঙ্গরূপ বস্তুব্যক্তিত্ব অতিক্রম ক’রে সাধারণ অর্থের মধ্যে সাধারণ্য প্ৰাপ্ত হয়। এই তিন ধরণের সাধারণীকরণ তিনটি পৃথক ব্যাপার নয়। একই সাধারণীকরণের তিনটি দিঙনিৰ্দেশ মাত্র। প্ৰকৃত পক্ষে শব্দ, অর্থ ও জ্ঞান একই সাধারণীকরণের ভিতরে একাত্মতা লাভ করে।
এই একাত্মতা প্রতিষ্ঠা দার্শনিক ভর্তৃহরিকে সৰ্বকালের এক অলোকসামান্য চিন্তানায়ক রূপে প্ৰতিষ্ঠিত করেছে। এ বিষয়ে বৌদ্ধ বিজ্ঞানবাদের সঙ্গে ভর্তৃিহরির শব্দাদ্বৈতবাদের অনেকাংশে গুরুতর প্রভেদ রয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধ দার্শনিক যখন বললেন, বিশুদ্ধ ব্যক্তি বা ‘স্ব-লক্ষণ” শব্দাতীত, তখন প্ৰকারান্তরে একথাই মেনে নেয়া হল যে মানুষের ব্যবহারিক জগতে solipsism বা ‘স্ব-সংবেদনবাদ’ অগ্রাহ। মানুষের চেতনায় শব্দ কখনে। অর্থকে বিশুদ্ধ ব্যক্তিরূপে উপস্থিত করতে পারেনা, উপস্থিত করে বিভিন্ন মানুষ কর্তৃক সমানভাবে গ্রাহ ‘সামান্য’ রূপে। অসামান্যকে সামান্যে পরিণত করার শক্তিই শব্দশক্তি। কিন্তু অর্থের সামান্যীকরণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষেরও ‘সমানীভবন” মেনে নিতে হয়। বৌদ্ধ দার্শনিক এই “সামান্তের’ বাস্তব সত্তা স্বীকার কনেন না, কিন্তু “সংবৃতি সত্তা’ স্বীকার করেন। ‘সংবৃতি-সত্তা।” শেষ পৰ্য্যন্ত ব্যবহারিক সত্তারই নামান্তর হয়ে দাড়ায়। “সামান্য’ বিকল্প বা abstraction হলেও, এরই মাধ্যমে মানুষে মানুযে ব্যবহারিক যোগাযোগ সাধিত হয়। যে মুক্তর্তে শব্দার্থ বস্তু-ব্যক্তিকে অতিক্রম করে সেই একই মুহূর্তে মানুষ-ব্যক্তি ও তার ‘দ্বীপধর্মিতা’ বা insularity অতিক্রম করে। ব্যক্তি মানসের ঊর্ধ্বে সমাজ-মানসের অস্তিত্বও এই জন্যই স্বীকার করতে হয়।