এখানে ঘনগম্ভীর আড়ম্বর ক’রে যা বলা হ’ল তা কিন্তু সামান্যই। চেতন মানুষের সম্পর্কটা যে unique বা স্বতন্ত্র অন্য বস্তুজাগতিক সম্পর্কের মত নয়, সে কথাটাই ঘটা ক’রে বলা হ’ল। চেতন মানুষই অচেতন বস্তুকে জানে, অচেতন চেতনকে জানে না। কিন্তু দুজন মানুষ একে অন্যকে জানে। পৰ্য্যায়ক্রমে প্ৰত্যেকেই জ্ঞাতা, প্ৰত্যেকেই জ্ঞেয়। এই সহজ সত্যটিকে ‘Transcendence is transcended’ এ জাতীয় প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের জমকালো ভাষার চাপরাস চাপিয়ে আচ্ছাদিত করা হ’ল কেন? সম্পর্ককে প্রথুম থেকেই মিলন-প্ৰধান সম্বন্ধ না ব’লে, বিচ্ছেদ-প্ৰধান সম্বন্ধ ব’লে কল্পনা করাটাই এই আড়ম্বরের কারণ। বিচ্ছেদের অন্ত নেই বলেই
মিলন প্ৰচেষ্টার শেষ নেই। কিন্তু যারা জ্ঞাতা সেই মানুষই যখন পরস্পর জ্ঞতৃ-জ্ঞেয় সম্বন্ধে সম্বন্ধ হয়, তখন সম্বন্ধটা বিচ্চেদভিত্তিক ব’লে ধারণা করা খুবই কষ্ট কল্পনা। স্পষ্টতই মানবিক সম্বন্ধগুলি বিভিন্ন ব্যক্তির চেতনার সাদৃশ্য বা মিলনকে ভিত্তি ক’রেই অনুভূত হয়। কিন্তু অস্তিত্ববাদী ‘স্বসিদ্ধান্তহানির’ ভয়ে একথা বলতে পারেন না । সুতরাং বিভিন্নতাকে বিচ্ছিন্নতার পৰ্য্যায়ভুক্ত ক’রে নিয়ে মানবিক সম্বন্ধের মধ্যেও বিচ্ছেদমূলক নাস্তিত্বপ্রাধান্য আমদানী করতে হয়েছে । এর ফলেই অস্তিত্ববাদী দর্শনের পাতায় পাতায় separation, alienation, discontinuity, transcendence, double transcendence প্রভৃতি negative terminology একঘেয়ে মিছিল চলছে।
যাই হোক, অস্তিত্ববাদী দর্শন solipsism-এর হাত থেকে ব্যক্তি-মানুষকে কি ক’রে রক্ষা করতে পারে এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। মানুষে মানুষে দুস্তর ব্যবধানটাও একটা সম্বন্ধ, এ কথা ব’লে solipsism দূর করা যায় না। অথবা “আমি অন্যকে জানি এবং অন্যে আমাকে জানে এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ’-একথা একটা বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়ের ঘোষণা হতে পারে, কিন্তু বিঘোষিত বিশ্বাসটাই যুক্তি নয়। অথবা “বস্তুতে বস্তুতে যে সম্বন্ধ এবং চেতনের সহিত অচেতন বস্তুর যে জ্ঞাতৃ-জ্ঞেয় সম্বন্ধ তা থেকে মানুষে মানুষে জ্ঞাতৃ-জ্ঞেয় সম্পর্কটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র’ -এই স্বাতন্ত্র্যের ঘোষণাটাও অকাট্য প্রমাণ নয়, বিশেষ ক’রে যেখানে মূল দার্শনিক প্রত্যয়টা বিচ্ছেন্দমুখীন। সাত্রের গভীর সংবেদনশীল মানবদরদী হৃদয় এবং দার্শনিক মননশীল মানস-এ দুইয়ের ভিতরে একটা বৈপরীত্য রয়েছে। বিশ্লেষণী যুক্তির কাছে মানুষ ও বস্তুজগৎ এবং মানুষ ও মানুষের মধ্যে “বিশ্লেষ’টাই বড় হ’য়ে দেখা দেয়। শোষণভিত্তিক পুজিবাদী সমাজব্যবস্থার ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এই ‘বিশ্লেষ’ মর্মান্তিক ভাবে হৃদয়কে আঘাত করে । হৃদয়ের দাবী,-মিলতে হবে। নিজের মধ্যে অপরের নাস্তিত্বরূপটাকেই মানুষের শেষ কথা বলে হৃদয় মেনে নিতে পারে না । মেলবার ও মেলাবার প্রচেষ্টা হৃদয়ের স্বাভাবিক প্ৰবৃত্তি । মনন ও সংবেদনের এই বৈপরীত্যের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করতে গিয়ে মানবদরদী অস্তিত্ববাদী দর্শন একটা চমকপ্ৰদ সিদ্ধান্তে পৌছেছে-‘অন্তহীন বিচ্ছেদের মধ্যে বিরামহীন মিলন প্ৰচেষ্টা-এই মানুষের ভাগ্য। বিচ্ছেদের শেষ নেই, তাই মিলনের পূর্ণতা Cat-Man is condemned to be free’–“Liberty is lack of being in relation to given being and not the emergence of a positive being’.
মানুষের স্বাধীনতার এই অদ্ভুত ধরণের negative definition বিশেষভাবে লক্ষণীয়। উপস্থিত বর্তমানকে মানুষ চায়না, এই না চাওয়ার ক্ষমতাটাই মানুষের স্বাধীনতা । এখানেই তার দায়িত্ববোধ ও কাৰ্যকলাপের উৎস। অনীপ্তিসত বর্তমানকে অতিক্রম করে ঈপিসত ভবিষ্যতের মধ্যে মানবসত্তার যে পুনর্বিন্যাস সেই অস্তিবাচক দিকটা বাস্তব নয়, সম্ভাবনা মাত্র । কিন্তু অনী পিসত বর্তমান থেকে মানবাত্মার যে বিচ্ছেদ-বাসনা সেই নাস্তিবাচক চরিত্রটাই হ’ল স্বাধীনতার বাস্তব সত্তা ( facticity ) ।
মানুষের স্বাধীনতার দার্শনিক লক্ষণ নির্ণয়ে negative চরিত্রটাকে যদি প্রধান ব’লে ধরে নিতে হয়, তবে মানুষের ব্যক্তিসত্তার গভীরতা খুঁজতে হয় একটা নিঃসঙ্গ একাকিত্বের মধ্যে । অনীপ্সিতকে না চাইতে পারাটাই স্বাধীনতা, সেই emergence of a positive being, ঈপ্সিতের অস্তিধর্মী আবির্ভাব স্বাধীনতার অন্তরঙ্গ সত্তা নয়, এর ন্যায়সংগত অর্থ দাড়ায়-একটা নিঃসীম শূন্যতার নিরাবরণ হাহাকারই হ’ল আত্মিক স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। যদি বলা যায়, যা নাই তাইতো আমি চাই, সুতরাং এই শূন্যতা-বোধটাই ○| মুক্তির মূলমন্ত্র, তাহলে একটা মারাত্মক দার্শনিক ভ্রান্তিকে প্রশ্ৰয় দেয়া হয়। কি আমি চাই তার positive ধারণা না থাকলে কি আমার নাই তার বোধ হতে পারে না। তাই নৈয়ায়িক বলেছেন-যা positive সেই ‘প্ৰতিযোগী’র বোধ ছাড়া megation-এর বোধ থাকতে পারে না। সুতরাং শুদ্ধ negation কোন সত্তার স্বরূপ লক্ষণ হতে পারে না। নিস্কৃতিই মুক্তি নয়, positive-এর প্রাপ্তিই মুক্তি। নিস্কৃতি মাত্রকে মুক্তি বললে যার হাত থেকে নিস্কৃতি সেই অপাদান কার্যকটির মধ্যেই সমস্ত positive content সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, নূতনের সঙ্গে যোগটাও দৃষ্টিসীমার মধ্যে পড়ে না। সুতরাং কর্তৃকারকরূপী মানুষটির উভয় প্ৰান্তেই বিচ্ছেদ জমে ওঠে। এর অবশ্যম্ভাবী। ফল এক নিরালম্ব নিরাধার নিঃসঙ্গ ‘স্বাধীন’ ব্যক্তিসত্তা-যার অপর নাম solipsism অস্তিত্ববাদী দার্শনিক solipsism মানেন না । অথচ তাঁর সমস্ত সংজ্ঞা ও পরিভাষা-শাস্ত্রে নাস্তিত্ববাচক শব্দসম্পদের প্রাধাণ্য, নাস্তিধর্মী চরিত্রের উপর অর্পিত অকাতর গুরুত্ব এই solipsism বা ‘স্ব-সংবেদনবাদের’ দিকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে ঠেলে নিয়ে যায়। এজন্যই অস্তিত্ববাদী দর্শনের আশাবাদের ভিতরেও মাঝে মাঝে অবসন্ন নিঃসঙ্গতার দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়।