সার্ত্র যে ভাবে মানবচেতনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা থেকে চেতনাকে স্বপ্ৰকাশ বা পরপ্ৰকাশ কোনটাই বলা যায় না। সাত্ৰ বলেন জ্ঞেয় থেকে বিচ্ছিন্ন ব’লেই জ্ঞান জ্ঞেয় বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। বিচ্ছেদকে যখন জ্ঞানের স্বরূপ বলে ধরা হয়েছে তখন যার থেকে বিচ্ছেদ তাকে বাদ দিয়ে বিচ্ছেদ সম্ভব নয়, তাই জ্ঞেয় বিষয়কে বাদ দিয়ে জ্ঞানের স্বরূপ লাভও সম্ভব নয়। এই অর্থেই জ্ঞান জ্ঞেয় বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। এখন জ্ঞানের আবির্ভাব স্বরূপলাভ বা প্ৰকাশ একই কথা। তাই নিরন্তর পরনির্ভরশীলতার জন্য জ্ঞান স্বপ্ৰকাশ হতে পারে না। এ জাতীয় “বিচ্ছেদ-যাতনা’- মুখর ভাষা ব্যবহারের বিপদ হল এই যে কেউ অনুরূপ যুক্তি প্রয়োগ করে বলতে পারেন-গরু গণ্ডার থেকে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছেদ গরুর আত্মস্বরূপ। সুতরাং গো-স্বরূপ গণ্ডারের ওপর নির্ভরশীল। অস্তিত্ববাদী এর উত্তরে বলবেন-আমি যে বিচ্ছেদের কথা বলেছি তা শুধু চেতনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, চেতনা-বহির্ভূত বস্তু সম্পর্কে প্রয়োজ্য নয়। কিন্তু এ যুক্তির কথা নয়, অনুশাসনের কথা।
জ্ঞান পর-প্ৰকাশ ও নয়। জ্ঞেয় জগৎ থেকে জ্ঞানের অনুমান করা যায় না। কিন্তু জ্ঞান থেকেই জ্ঞেয় জগতের অনুমান করা সম্ভব। এর অর্থ জ্ঞানের দ্বারাই বিষয় প্ৰকাশিত হয়, প্ৰকাশিত হয় বলেই তার অস্তিত্বকে স্বীকার করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে সাত্ৰ পাঠকদের সতর্ক ক’রে দিলেন-এর মানে এই নয় যে জ্ঞান জ্ঞেয় অপেক্ষা স্বাধীন বা প্ৰাচীন। কিন্তু জ্ঞান বিষয়বস্তুকে অতিক্রম করে চলে যায়, (transcends the world), জ্ঞান নিজেই একটি প্রকাশযোগ্য বিষয় নয় (not itself a phenomenon) জ্ঞান পরবর্তী কোনো জ্ঞান অর্থাৎ অনুব্যবসায় বা introspection দ্বারাও প্ৰকাশ্য নয়। ভারতীয় নৈয়ায়িক বলেন-জ্ঞান পরবর্তী অনুব্যবসায় দ্বারা প্ৰকাশিত হয়। আমার বর্তমান কালীন ঘাট-জ্ঞান পরীক্ষণে “আমি ঘট জানি’ এইরূপ দ্বিতীয় জ্ঞানেীয় বিষয় রূপে প্ৰকাশিত হয়। এর উত্তরে স্বপ্ৰকাশবাদী বলেন—তাহলে অনবস্থা দোষ বা infinite regress অপরিহার্য। এই দ্বিতীয় জ্ঞান আত্মপ্রকাশের জন্য তৃতীয় জ্ঞানের উপর নির্ভর করবে, তৃতীয় জ্ঞান চতুর্থ জ্ঞানের অপেক্ষা রাখবে। সুতরাং কোনো জ্ঞানই কোনো দিন প্রকাশিত হবেনা। সাত্র পর-প্রকাশবাদীদের বিরুদ্ধে এই একই যুক্তি প্ৰদৰ্শন করেছেন।
জ্ঞান স্বপ্রকাশ ও নয়, পর-প্রকাশ ও নয়, কিন্তু প্রতিক্ষণে নিজকে নূতন করে পুনর্বিন্যস্ত করছে।-এর দ্বারা জ্ঞানতত্ত্ব যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে গেল। এই নাস্তিরূপী অস্তিবাদের রহস্য আরও ঘনীভূত হয় যখন ভাষার সঙ্গে চেতনার মিল লোপ পায়। অস্তিত্ববাদীর মতে আমি যখন গরু দেখছি তখন দর্শন-জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গেই ‘আমি গরু নই’ এই নাস্তিত্বও আমার ‘আত্মস্থ’ হয়ে গেল। এর অর্থ দাঁড়ায় আমার গরু দেখা আর ‘আমি গরু নাই’ একই কথা। কারণ চেতনামাত্ৰই নাস্তিরূপে জগতে আবিভূতি হয়। তা হলে ‘আমি গরু দেখছি’ এবং “আমি গরু নাই’-এই দুটি বাক্য সমার্থক। যদি বলা হ’ত দ্বিতীয় বাক্যার্থটি প্রথম বাক্যার্থ দ্বারা ব্যঞ্জন শক্তির মাধ্যমে ধ্বনিত হচ্ছে তা হ’লে হয়ত বিশেষ আপত্তিকর কিছু ছিল না। কিন্তু তাহলে অস্তিত্ববাদ মূলেই নিমূল হয়ে যেত। অস্তিত্ববাদের গোড়ায় কথাই হ’ল-নাস্তিরূপ ছাড়া চেতনার প্রকাশ বা আবির্ভাবই সম্ভব নয়। সুতরাং “আমি গরু দেখছি’। আর ‘আমি গরু নাই’ এ দুটো একই জ্ঞান। অতএব বলতেই হবে ‘আমি গরু দেখছি’ এবং “আমি গরু নাই’ এই বাক্য দুটি মুখ্যার্থের দিক থেকেও সমার্থক। যদি অস্তিত্ববাদী বলেন-“এই আমার তর্কাতীত অনুভূতি’, এর উত্তরে পাঠক শুধু বলতে পারেন—“আমার অনুভূতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আমার আপনার মধ্যে কোনো সাধারণবোধ্য ভাষার মাধ্যম নেই। আপনি যদি বলেন যে আপনি মুরগী খাচ্ছেন, আমি কখনো মনে করতে পারব না যে আপনি আমাকে বুঝাতে চাইছেন যে আপনি নিজে একটা মুরগী নন। আর যদি প্রত্যেকের নিজস্ব অনুভূতি ভাষাতীত হয় তাহলে হতচ্ছাড়া মানব সমাজ একদিন ও টিকত না। সমাজ সংসার সবই মিছে হত। সকল ভাষার কলরব একদিনে মুছে যেত।
সাত্রর সাহিত্য ধারা বুঝতে পারেন তারা যদি তার গুরু গম্ভীর দার্শনিক গ্রন্থ বুঝতে না পারেন, তবে সমস্ত দোষটা পাঠকের বোধ-দৈন্যের উপর চাপিয়ে দেয়াটা সঙ্গত হবে না। সাহিত্যের মত দর্শনশাস্ত্র ও অনুভূতি মাত্ৰই নয়, কিন্তু ভাষার সাধারণ মাধ্যমে অনুভূতির সার্থক প্ৰকাশ। সাত্রের দর্শনে এই প্ৰকাশ কেন ব্যাহত হচ্ছে অন্যদিক থেকে তা আলোচনা করা যাক। আমার কাছে আমি ব্যাকরণের উত্তম পুরুষ, কিন্তু আপনি মধ্যম পুরুষ। আবার আপনার কাছে আপনি উত্তম পুরুষ, কিন্তু আমি মধ্যম পুরুষ। এক ব্যক্তিপুরুষ যখন অন্য কোন ব্যক্তি-পুরুষের চেতনার বিষয়ৰূপে প্ৰতিভাত হয়, তখনই উত্তমপুরুষ মধ্যমপুরুষের চরিত্র অর্জন করে। অর্থাৎ একই জ্ঞাতৃপুরুষ একাধারে বিষয় (object) ও বিষয়ী (subject)। কিন্তু অস্তিত্ববাদের মূল সূত্র অনুসারে আমার বহির্জগতে আপনি রয়েছেন এবং আপনার বহির্জগতে আমি রয়েছি, এবং চেতনা ও চেতনার বহির্ভূত বিষয় জগতের মধ্যে রয়েছে এক দুস্তর ব্যবধান। সুতরাং আপনার ও আমার মধ্যেও দুনিবার বিচ্ছেদ স্বীকার ক’রে নিতে হবে। তা’হলে মানুষে মানুষে যোগাযোগটা কি ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? Solipsism বা স্ব-বিজ্ঞানবাদের হাত থেকে নিস্কৃতির উপায় কি? মানবদরদী অস্তিত্ববাদী দার্শনিক মানবিক সম্পর্ক অস্বীকার করতে পারেন না, তাই Solipsism স্বীকার করতে পারেন। না। তঁাকে ঘোষণা ক’রে বলতে হয়- আমি নিজেই যে অন্যের চেতনার বিষয় এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ, অথচ আবার বলতে হয়- আমি যখন অন্য এক চেতন ব্যক্তিকে জানি, বুঝি, ভালবাসি বা ঘৃণা করি, তখন আমি তার শুদ্ধ বিষয়ী স্বরূপটিকে (subjectivity) জানি না, তার বিষয়-স্বরূপটিকেই (objectivity) জানি। কিন্তু চেতনের সঙ্গে চেতনের সম্পর্ক চেতন ও অচেতনের সম্পর্ক থেকে স্বতন্ত্র। এটা ঠিক বস্তুজগতের সম্পর্ক নয়। ব্যক্তিচেতনা অচেতন বস্তুর উপর নির্ভরশীল হয়ে ও বিষয়বস্তুকে অতিক্রম করে, কারণ এই নির্ভরশীলতা এক মৌলিক বিচ্ছেদের আকারে আকারিত হয়। এই অর্থে আমার ব্যক্তিত্ব transcendental বা অতিক্রান্তিশীল। এখন আমি নিজেই যদি অন্য এক চেতনার বিষয় হয়ে পড়ি, তা হ’লে সেই অপর বিষয়ী চৈতন্য আমার অতিক্রান্তিশীল সত্তাকেও অতিক্রম করে যাবে, কারণ বিষয়কে অতিক্রম করাই বিষয়ীর স্বভাব। সুতরাং চেতনের সঙ্গে চেতনের সম্পর্ক (inter-subjective relation) হল অতিক্রান্তিকে অতিক্রম করার সম্পর্ক, double transcendence বা double negation.