ভারতীয় দর্শনের পরিভাষার সাহায্যে এই ভাবে সর্বাধুনিক অস্তিত্ববাদকে বুঝবার প্রচেষ্টা অনেকের কাছে আপত্তিকর হতে পারে। অস্তিত্ববাদের “ আত্ম দর্শন’ অপরোক্ষানুভূতি বা intuition-এর উপর নির্ভরশীল হলেও একে বুঝতে হলে ব্যাখ্যা করতে হলে বিচার বুদ্ধির আলোকপাত ছাড়া উপায় নেই। ভারতীয় দর্শনের পরিভাষাগুলি এত পরিচ্ছন্ন যে এখানে বিভ্রান্তির সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ কোন অর্থে কোন পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা বুঝতে কষ্ট হয় না। অস্তিত্ববাদী দর্শনের অন্যান্য দর্শন থেকে একটা প্ৰধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল এই যে এই দর্শন নৈয়ায়িক বিচার বুদ্ধি ও তর্ক বিতর্কের ধার ধারেনা। ফলে একই শব্দ কোথায় অভিধার্থে, কোথায় লাক্ষণিক অর্থে, কোথায় বা ব্যঞ্জনগত অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, তা বোঝা দুষ্কর। যেখানে ন্যায়শাস্ত্রের বিচার নেই এমন দর্শন সাহিত্যে পরিণত হতে বাধ্য। আর দর্শন সাহিত্যে পরিণত হলে, সাহিত্যের সাহিত্য melodrama-র হাত থেকে নিস্কৃতি পেলেও, তর্কবিহীন দর্শনের সাহিত্য melodramatic হতে বাধ্য। তাই সার্ত্রর Being and Nothingness চিরাচরিত দৰ্শন-রসিকদের নিকট এক খণ্ড বিপুলকায় metaphysical melodirama বলে মনে হবে। নৈয়ায়িকসুলভ-বিশ্লেষণবিহীন অপরূপ বাচনভঙ্গিমায় একই কথার বিভিন্ন আকারে এমন একঘেয়ে পুনরুক্তি মননধর্মী দর্শনপাঠকের দার্শনিক রুচিকে পীড়িত করে। জ্ঞান ও জ্ঞেয় বস্তু এক নয়। অথচ এ দুই-এর মধ্যে একটা দুরপনেয় সম্বন্ধ রয়েছে এই সহজ কথাটি বুঝানো হল এই ভাবে :
জ্ঞান ও জ্ঞেয়ের মধ্যে একটা দুর্লঙ্ঘ্য বিচ্ছেদ রয়েছে। অথচ চেতনা যা সে নয়। সব সময় তারই কাছে উপস্থিত হয়। যা সে নিতান্তই নয়। তাকে এড়িয়ে চেতনার অস্তিত্বই অসম্ভব। এর অর্থ হ’ল য। সে নয়। তাই দিয়েই চৈতন্যের পরিচয়। এই নাস্তিত্ব নিয়েই চেতনার আবির্ভাব। অনন্ত বিচ্ছেদ নিয়ে যার আবির্ভাব অনন্ত বিচ্ছেদই তার পরিচয়। এই বিরহযাতনার কোনোদিন বিরাম নেই। তাই আমার অস্তিত্বের ভিতরে সব সময়ই একটা নাস্তিত্বের আৰ্ত্তিনাদ আছে। অতএব জ্ঞান থেকে জ্ঞেয়ের বিচ্ছেদ আমারই অন্তবিচ্ছেদের নামান্তর, কারণ নাস্তিত্ব আমার অন্তরঙ্গ সত্তারই একটা অঙ্গ। এই বিচ্ছেদ ঘুচোনোই আমার সমস্যা; আমি যা আছি তা আমি হতে চাই না, যা নাই তাই আমি হতে চাই! আমি এখন হোটেলের পরিচারক, কিন্তু এই পরিচারকই আমি নই। ধরুন আমি চাই সাংবাদিক হতে বা মন্ত্রী হতে। এর অর্থ, এই ‘পরিচারক আমি’র নিকট থেকে আমাকে আমি বিচ্ছিন্ন ক’রে নিয়ে, যা আমি নই সেই ভাবী মন্ত্রী বা সাংবাদিক রূপে আমাকে আমি পুনর্গঠিত করতে চাই। এই ভাবে ভবিষ্যতের সঙ্গে বর্তমান আমিত্বের ব্যবধান ঘুচিয়ে নিত্য নূতন ক’রে আমাকে আমি পুনর্গঠিত করি। আমি এখনো যা হয়ে উঠিনি কি ক’রে তা হয়ে উঠতে পারি। আমার সকল আশা আকাঙ্ক্ষা এই পুনবিন্যাসের নিরন্তর প্রচেষ্টা মাত্র। কিন্তু এই পুনর্বিন্যাস কোনো দিন পূর্ণ হবে না। আমার বিচ্ছেদ চিরন্তন। আমার নাস্তিত্বস্বরূপ দুরতিক্রম্য।
সহজকে সুগম্ভীর করা, obviousকে profound করার এই নিদর্শন মেনে নিয়েও দার্শনিক বিচারে একটা কথা হেঁয়ালি বলেই মনে হয়। আমি গরু নাই সত্য, কিন্তু গরুর নাস্তিত্বটা আমি হলাম কি ক’রে? “আমি গরু নই, এই সরল বাক্যটির এ জাতীয় দুর্বিষহ গম্ভীর অর্থ করলে সার্বজনীন ভাষাবোধের দুরন্ত ব্যভিচার করা হয়। আমি রাজা নেই, রাজা হতে চাই, ভাল কথা। যদি রাজা হতে পারি, সাংখ্য দর্শন বলবে, বর্তমান আমির মধ্যে রাজা হবার সুপ্ত শক্তি ভবিষ্যতে জাগ্রত ও অভিব্যক্ত হবে। এ কথা বুঝতে পারি। কিন্তু যখন আমি রাজা নাই, তখন ভবিষ্যৎ রাজার বর্তমান নাস্তিত্বটাই আমার আমিত্ব, এটা দার্শনিক বিচারের কথা নয়, দর্শনের আকারে বুদ্ধির ওপর হেঁয়ালিপনার দৌরাত্ম্য। মাটি থেকে ঘট তৈরী হবার আগে পর্যন্ত ঘটের যে অভাব রয়েছে নৈয়ায়িক তার নাম দিয়েছেন ‘প্রাগভাব’, অর্থাৎ বস্তু উৎপন্ন হবার পূর্ব পৰ্যন্ত বস্তুর অভাব। ঘটের প্রাগভাব মাটিতে আছে বটে, কিন্তু ঘটের প্রাগভাবটাই মাটি নয়, বা ঘটের প্রাগভাব দিয়ে মাটিটা তৈরী হয়নি। উপনিষদ ‘নেতি নেতি’ বলে আত্মতত্ত্ব বুঝাতে চেয়েছে। কিন্তু নাস্তিত্বটাকেই আত্মস্বরূপ বলেনি। প্রথম দিকে ভারতীয় দর্শনের পরিভাষার মধ্য দিয়ে অস্তিত্ববাদকে আমরা যেভাবে বুঝতে চেয়েছি সে ভাবে হয়ত কিছুটা বুঝতে পারি। কিন্তু অস্তিত্ববাদীর নিজের ভঙ্গীতে যা বলার চেষ্টা করা হল ওটা বোধ হয় অপচেষ্টারই সামিল। সাত্রর Being and Nothingness-as ইংরেজী অনুবাদের ভাষা তার দর্শনের প্ৰতিচ্ছবি বলে মনে হয় (ফরাসী জানিনা বলে বলছি)। অর্থাৎ এই ভাষা ভাষার কাজ করেন, লেখক ও পাঠককে সমান বোধ, সমান চেতনার অংশীদার করে না, বরং অভিধা, লক্ষণা ও ব্যঞ্জন শক্তির সমস্ত নিয়মকানুন লঙ্ঘন করে লেখক ও পাঠকের মধ্যে দুর্লঙ্ঘ্য দুবিষহ ব্যবধান গড়ে তোলে। দর্শন থেকে দার্শনিকের এই বিচ্ছেদ মর্মান্তিক। যে দর্শন জ্ঞান ও জ্ঞেয়ের সম্পর্ককে একটা দুঃসহ দুর্লঙ্ঘ্য বিচ্ছেদ ব’লে ভূমিকা সুরু করেছে এবং একটা নিঃসহায় নাস্তিত্বকে ব্যক্তিপুরুষের স্বরূপ ব’লে ধরে নিয়েছে, সে দর্শনকে অস্তিবাদী বলা বিপরীত লক্ষণার নামান্তর মাত্র, কারণ মুখ্যার্থের বিচারে এর নাম হওয়ার উচিত ছিল নাস্তিত্ববাদী দর্শন।