বৌদ্ধ দার্শনিকরা এ সম্বন্ধে খুবই সচেতন। কোন সংকেতই শুদ্ধ ব্যক্তিকে বুঝাতে পারে না। কারণ শব্দ মাত্রই একটি সাধারণ ধারণাকে সংকেতিত করে যার সঙ্গে প্ৰকৃত ব্যক্তিসত্তার কোনো বাস্তব সম্বন্ধ নেই। এই সাধারণ বিমূৰ্ত্ত ধারণার পারিভাষিক নাম ‘সামান্য যা বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে সমান, অথচ যার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এমনকি যে ‘স্বলক্ষণ’ শব্দটি শুদ্ধ ব্যক্তিকে নির্দেশ করে বলে মনে হতে পারে, তাও প্রকৃতপক্ষে শুদ্ধ ব্যক্তিবাচী নয়। কিন্তু সামাল্লিঘাচী। এ শব্দটিও কোনো বিশেষ একটি ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে না। কিন্তু যে-কোনো ব্যক্তিবিশেষ সম্বন্ধে নির্বিশেষে প্ৰযুক্ত হয়ে থাকে। “যে কোনো ব্যক্তিবিশেষ’ বললেই ব্যক্তিসত্তাকে অতিক্রম করে যেতে হয়। ব্যক্তিবিশেষ এবং “যে কোনো ব্যক্তিবিশেষ’ এক কথা নয়। আধুনিক দার্শনিক পরিভাষায় দ্বিতীয় কথাটি একটি variable, constant নয়। বৌদ্ধ দার্শনিক বলবেন, প্ৰতীক বা সংকেত মাত্ৰই variable, constant value সংকেতের দ্বারা নির্দেশ্য ও অপ্রকাশ্য– ইহা “অনভিলপ্য’। ইংরেজী ‘a’ বা ‘any’ শব্দটি variable, কিন্তু “Socrates” হ’ল constant, পাশ্চাত্ত্য ন্যায়শাস্ত্রের এই ভেদরেখা বৌদ্ধ ন্যায়শাস্ত্রে অগ্ৰাহ। আমি আর আপনি এক নই, সুতরাং আমার ও আপনার বোধ ও অভিজ্ঞতাও এক নয়, কাজেই আমার বোধবিধৃত সক্রেটিস থেকে আপনার সক্রেটিস আলাদা। শুধু তাই নয়, আপনার বা আমার দুই ক্ষণের দুইটি অভিজ্ঞতাও এক নয়। এদিকে যাকে এক সক্রেটিস ব্যক্তি বলে মনে করা হয় তিনিও এক ব্যক্তি নন, পূর্বাপরীক্ষণবাহী বহু সদৃশ ক্ষণিক ব্যক্তির সন্তান বা প্ৰবাহকে কল্পনায় ঐক্যবদ্ধ ক’রে সক্রেটিসকে মিথ্যাই এক বলে। চালাবার চেষ্টা করা হয়। ক্ষণে ক্ষণে নিত্য নূতন এই সক্রেটিস বক্তা ও শ্ৰোতার অভিজ্ঞতা অনুসারে জনে জনে “vary’ করছে। তাই ‘Socrates’ও variable মাত্র। তেমনি It, This, That প্ৰভৃতি যে কোনো demonstrative pronouns variable। বৌদ্ধ ন্যায়শাস্ত্র অনুসারে পাশ্চাত্ত্য ন্যায়শাস্ত্রের ‘Logical Proper Name’ মোটেই proper name নয়, সবই general name। বৌদ্ধদের ‘স্বলক্ষণ’ শব্দটিও কোনো বিশেষ বিশুদ্ধ ব্যক্তিসত্তার নাম বা লক্ষণ নয়। শুদ্ধ ক্ষণিক অদ্বৈত সত্তাকে কোনো নামের দ্বারা নির্দেশ করা যায় না, এই নেতিবাচক ধারণাকে ধারণ করার জন্যই স্বলক্ষণ শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সুতরাং বৌদ্ধ মতে ‘সমাজমানস’ ‘বিশ্ব-মানস’, প্রভৃতি শব্দগুলি নিরর্থক নয়, সম্পূর্ণ সার্থক, কিন্তু বস্তুহীন। এইরূপ বস্তুহীন সাধারণ ধারণাই হ’ল শব্দের অর্থ। এর পারিভাষিক নাম হ’ল বিকল্প। বস্তুহীন ধারণার আকারে বিকল্পিত হয় বলেই শব্দার্থকে বিকল্প বলা হয়। শব্দার্থ সম্বন্ধে বৌদ্ধদের প্রসিদ্ধ নীতিবাক্যটি খুবই তাৎপৰ্যপূর্ণ-‘শব্দের উৎস বিকল্প, বিকল্পের উৎস শব্দ, শব্দ ও বিকল্প পরস্পরকে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু এরা কেউই শুদ্ধসত্তাকে স্পর্শ করতে পারে না।” পজিটিভিষ্টদের ভ্ৰান্তি এইখানে যে তারা abstract শব্দকে নিরর্থক বলেছেন এবং শুদ্ধ ব্যক্তিসত্তাকেও সার্থক সাংকেতিক শব্দের দ্বারা নির্দেশযোগ্য বলে মেনে নিয়েছেন। বৌদ্ধরা দেখিয়েছেন যে যত সূক্ষ্মতম সংকেতই তৈরী করি না কেন শব্দ মাত্রেরই অর্থ হ’ল abstraction ; সুতরাং abstract শব্দ নিরর্থক নয়। কারণ abstractionই হ’ল শব্দের সার্থকতা। কিন্তু যা সার্থক তা বস্তুহীন । বস্তু কখনো শব্দার্থ হতে পারে না ।
অস্তিত্ববাদী বা Existentialist দার্শনিকরা পজিটিভিষ্টদের বিপরীত দিক থেকে সুরু ক’রে ব্যক্তিত্ববাদের ওপর জোর দিয়েছেন। এরা উভয়েই ব্যক্তিত্ববাদী, কিন্তু বিপরীত অর্থে। বলা যেতে পারে পজিটিভিষ্টরা ব্যক্তিবাদী, কিন্তু “ব্যক্তিত্ব”বাদী নয়, অপরপক্ষে অস্তিত্ববাদীরা ব্যক্তিত্ববাদী কিন্তু ব্যক্তিবাদী নয়। পজিটিভিষ্ট দর্শন জগতের বস্তুসত্তা থেকে person ও personality-কে নির্বাসন দিয়েছে, যা জমা রইল তা concrete individual নয়, কিন্তু concrete particular—ব্যাকরণের ক্লীবলিঙ্গ প্রথম পুরুষ একবচন। কিন্তু অস্তিত্ববাদী দর্শনে ব্যক্তি মানে concrete individual, person বা personality। তাদের দার্শনিক ব্যাকরণে উত্তম পুরুষ এক বচনের প্রাধান্য। অস্তিত্ববাদের অহং-পুরুষ কস্তুরী মৃগ সম আপন গন্ধে পাগল হয়ে সংসার-অরণ্যে ঘুরে বেড়ায়। আপনা থেকে আপনি বিচ্ছেদে আত্মহারা এই আত্মপুরুষ জগত থেকেও বিচ্ছিন্ন। এই দ্বিগুণ বিচ্ছেদ-জালায় জর্জরিত আত্ম-পুরুষের আত্ম-জিজ্ঞাসার তাই কোনো বিরাম নেই। নিত্য পরিবর্তনশীল জগৎ নিত্য নূতন সমস্যা ও সামঞ্জস্যের দাবী নিয়ে অখণ্ড আত্মাকে দ্বিখণ্ডিত করছে। এই আত্মপুরুষ যেখানে নিঃসঙ্গ একাকী সেখানে তার নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। কিন্তু এই স্বাধীনতা তুৱীয় ভাবে ভোগ করার উপায় নেই, কারণ সমাজ সংসারের কলরব নিরন্তর এসে সেখানে আঘাত করছে। এই আঘাতকে স্বীকার করা যায় না, অস্বীকারও করা যায় না। সুতরাং আত্মাও যেন দ্বিধায় পড়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে । বাইরের সমাজ সংসার আত্মারই নেতিবাচক দিক, শুদ্ধ ব্যক্তিত্ব তার ইতিবাচক দিক। আত্মা নিজে যা এবং যা নয় এই Being ও Nothing নিয়ে হল সত্তা বা Existence. Nothing মানে বস্তুহীন অভাব মাত্র নয়, একে ভারতীয় নৈয়ায়িকদের “অন্যোন্থাভাব” বলা যেতে পারে। গরু মানুষ থেকে আলাদা । মানুষের অভাব রয়েছে। গরুতে । গরু অভাবের আধার, কিন্তু নিজে অবস্তু নয় । বিশুদ্ধ Being বা আত্মপুরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন আত্নেতর বহির্জগতকে এই বিচ্ছেদের আধার হিসাবে Nothing বলা হয়েছে। তেমনি বহির্বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন মানবাত্মাকে ঐ একই বিচ্ছেদের আধার হিসাবে Nothing বলা যেতে পারে। এ অর্থে Being ও Nothing একই সত্তার দ্বৈতচরিত্র মাত্ৰ; Nothing সংজ্ঞাটি এখানে অভিধার্থে ব্যবহার করা হয় নি, হয়েছে লাক্ষণিক অর্থে। আধেয়ের দ্বারা আধারকে লক্ষ্য করা হয়েছে। এই লক্ষণ নিষ্প্রয়োজন নয়। আত্মেতার থেকে আত্মার বিচ্ছেদের উপর গুরুত্ব অৰ্পণ করতে হলে একটি নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করা উচিত। এই বিচ্ছেদের গুরুত্ব প্ৰকাশ করার প্রয়োজনেই লক্ষণার আশ্রয় গ্ৰহণ করা হয়েছে। অদ্বেগ্নতর জগৎ বস্তুহীন নয় বলেই Nothing-এর অভিধার্থ এখানে বাধিত হচ্ছে। মুখ্যাৰ্থ বাধিত হলেই লক্ষণার প্রয়োগ অনিবার্যে। সুতরাং এই লক্ষণার সঙ্গে সঙ্গে Nothing শব্দটি দ্বারা অস্তিত্ববাদী দর্শনে “ আত্ম-বিচ্ছেদের’ গুরুত্ব ধ্বনিত হচ্ছে। আত্মেতার জগৎ বোঝাতে Nothing শব্দটির লক্ষণা, আত্ম-বিচ্ছেদের গুরুত্ব প্ৰকাশ করতে ব্যঞ্জনা, একই শব্দের এই দুইটি শক্তি এখানে অনস্বীকাৰ্য্য।