আমরা অনেক সময় ‘সমাজমানস’ কথাটি ব্যবহার করি। ভাষা ছাড়া সমাজমানস গড়ে উঠতে পারে না একথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু অনেক ব্যক্তিবাদী আধুনিক দার্শনিক এই জাতীয় কথাগুলিকে অর্থশূন্য বিমূৰ্ত্ত কল্পনা মাত্র বলে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেন। সমাজের কোন দুই ব্যক্তিই যখন এক নয়, তখন সকলের মনকে একত্র করে একটি পিণ্ডাকার ‘সমাজমানস’ কি করে তৈরী করা সম্ভব ? কতকগুলি সোনার টুকরো গলিয়ে মিলিয়ে নিয়ে একতাল সোনা তৈরী করা সম্ভব। কিন্তু কতকগুলি মন গলিয়ে মিলিয়ে একতাল মন কি তৈরী করা যায় ? তাহলে ‘সমাজমানস’, ‘বিশ্বমানস” এগুলি ফ্যাক কথা, কারণ এদের কোনো অভিধাশক্তি নেই। অভিধাশক্তি শুধু সেই জাতীয় শব্দেরই সম্ভব যে গুলি সাক্ষাৎ উপস্থিত তত্ত্বটিকে মাত্র নির্দেশ করতে পারে। যেমন এক পোচ লাল রং দেখে বললাম, ‘(এই) লাল’। এই মুহূর্তে পেটে ব্যথা অনুভব করে বললাম, ‘(এই) পেট ব্যথা’। এমনি সোজাসুজি ইন্দ্ৰিয়া হৃত প্ৰাথমিক অৰ্থকে নির্দেশ করাই শবেদব অভিধাশক্তি । এখানে তীর যেন একেবারে সোজা গিয়ে লক্ষ্যভেদ করছে। কিন্তু এজাতীয় শব্দ নিয়েও গোল বেধে যায়। তাই প্ৰত্যেক ব্যক্তির প্রত্যেক ক্ষণের এক একটি অখণ্ডিত অভিজ্ঞতার বুকে যদি এক, দুই, তিনি ক’রে নম্বর এটে দেয়া যেত, তাহলে বোধহয় শব্দের অভিধাশক্তির নির্ভেজাল নিদর্শন মিলত। তবে মুস্কিল হত এই যে কারুর কথাই কেউ বুঝত না। ধরুন আপনার ‘রক্তিম’ অভিজ্ঞতার নাম ১ নম্বর এবং আমার ‘রক্তিম’ অভিজ্ঞতার নাম ২ নম্বর। আপনার অভিজ্ঞতা আপনার, আমার অভিজ্ঞতা আমার, এই দুই-এর মধ্যে মুখ দেখাদেখির কোন প্রশ্নই ওঠেন। আপনি ২ নম্বরের মানে জানেন না । আমিও ১ নম্বরের মানে জানিনা । অথচ “এক দুই’ এই সংখ্যাগুলির অর্থগ্রহণ পরস্পর আপেক্ষিক। তাই নম্বরের কথা বাদ দিন। মনে করুন পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের অসংখ্য কোটি বিন্দু বিন্দু অভিজ্ঞতার জন্য অসংখ্য কোটি সংকেত তৈরী করলাম। তাহলেও আপনার সঙ্গে আমার কথা বলা বন্ধ করতে হবে । কারণ আপনার আমার সংকেতগুলি পরস্পরের কাছে দুর্বোধ্য। তখন একান্তই কথা বলতে হলে নিজের কাছে নিজের কথা বলতে হবে। পৃথিবীর সব মানুষ শুধু আপন মনে বিড় বিড় ক’রে চলবে। নিরঙ্কুশ ব্যক্তিবাদী দার্শনিক তাহলে পৃথিবীকে একটা পাগলা গারদে পরিণত করবে, যেখানে ডাক্তার ও চৌকিদার সবাই পাগল । অথবা মনে করুন, বিধাতা এমন একটি নাটক লিখেছেন যার প্ৰত্যেকটি চরিত্রের প্রত্যেকটি কথাই স্বগতোক্তি এবং যার একটি উক্তির সঙ্গে আর একটি উক্তির কোনো সম্পর্ক নেই।
নিরঙ্কুশ ব্যক্তিত্ববাদী দর্শন হিসাবে বৌদ্ধ দর্শনের জুড়ি মেলা ভার। নিরাকাজক্ষ, নির্লিপ্ত, আত্ম-সম্পূর্ণ নিরন্তর স্রোতোবাহী ক্ষণিক ব্যক্তিসমষ্টি এই জগৎ । বৌদ্ধ দর্শনের পরিভাষায় শুদ্ধ ক্ষণিক ব্যক্তিকে বলা হয় স্বলক্ষণ । স্বলক্ষণ মানে যা নিজেই নিজের লক্ষণ। অর্থাৎ স্বলক্ষণ মানে অলক্ষণ, কোন শব্দের দ্বারা যার লক্ষণ নির্ণয় করা যায় না । সুতরাং বৌদ্ধ দর্শনের মতে যা সত্য তা শব্দের দ্বারা “অনভিলপ্য’-অনির্দেশ্য ও অপ্ৰকাশ্য, কারণ শুদ্ধ ক্ষণিক ব্যক্তিবিশেষই একমাত্র সত্য। একথা মানতেই হবে যে আধুনিক ব্যক্তিত্ববাদী দর্শনের তুলনায় বৌদ্ধ দর্শনের নৈয়ায়িক দৃষ্টি অনেক বেশী পরিচ্ছন্ন। আধুনিক যখাস্থিতিবাদ বা Positivism এবং অস্তিত্ববাদ বা Existentialism পরস্পরের মধ্যে আকাশ পাতাল প্ৰভেদ সত্ত্বেও ব্যক্তিপ্ৰাধান্যের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব অৰ্পণ করে। যথাস্থিতিবাদের মতে ব্যক্তির মধ্যে আমি তুমি বা উত্তম পুরুষ ও মধ্যম পুরুষের স্থান নেই। ব্যক্তি বলতে “আমি”, “তুমি’ এমন কি আঁমরা যাকে ‘সে’ বলে নির্দেশ করি তারও-কোনো স্থান নেই। বিশুদ্ধ ব্যক্তি বলতে বুঝি “ইহা” বা “তাহা’-It বা ‘This ও That। “আমিত্বহীন’, ‘তুমিত্বহীন” এই শুদ্ধ ‘ইহা-ময়’ ব্যক্তিসমষ্টিই জগৎ। আমার আমিত্ব বা তোমার তুমিত্ব মুছে ফেললে এবং গাছ, পাহাড়, নদী, সাগর, মানুষ, পশু সব কিছু থেকে বৃক্ষত্ব মনুষ্যত্ব প্রভৃতি সাধারণ ধর্মগুলিকে বিমূর্ত কল্পনা বা abstraction বলে ছাটাই করে দিলে যা বাকী থাকে, তাই হ’ল শুদ্ধব্যক্তি,-নিছক ‘ইহামাত্র”। এই হ’ল মূর্ত ব্যক্তি বা Concrete Particular। এখানে বৌদ্ধ দর্শনের সঙ্গে যথাস্থিতিবাদের চমৎকার মিল রয়েছে। কিন্তু এই মতবাদ থেকে বৌদ্ধ দার্শনিকরা যে স্বাভাবিক ন্যায়ানুগ সিদ্ধান্ত টেনেছেন যথাস্থিতিবাদীরা তা পারেন নি। বৌদ্ধ দার্শনিক ঠিকই বুঝেছিলেন যে বিশুদ্ধ ব্যক্তি সম্পূর্ণ ভাষাতীত। এদিকে পজিটিভিষ্ট দার্শনিক বলছেন– নিছক ব্যক্তিসত্তা মানুষের সাধারণ ব্যবহারিক ভাষার অতীত সন্দেহ নেই, কিন্তু সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে না। এমন কোন ও নূতন ধরণের নৈয়ায়িক বা গাণিতিক সংকেত সৃষ্টি করা সম্ভব, যা দ্বারা বিশুদ্ধ ব্যক্তিকেও নির্দেশ করা যেতে পারে। এ ধরণের সংকেত সৃষ্টির বিপদ আমরা একটু আগেই দেখিয়েছি। তা হলে প্রত্যেক মানুষের প্রত্যেকটি ক্ষণিক অভিজ্ঞতার জন্য এক একটি আলাদা সংকেত সৃষ্টি করতে হবে, যা সম্পূর্ণ অসম্ভব। আর যদি বা সম্ভব বলে ধরে নেয়া যায়, তাহ’লেও মানুষে মানুষে, এমন কি এই বিশুদ্ধ দর্শনে দীক্ষিত পণ্ডিতদেৱ মধ্যেও পরস্পর বাক্যালাপ বন্ধ করতে হবে। যে যার নিজ নিজ সংকেতের মধ্যে ডুবে থাকবে। একের অভিজ্ঞতাকে অন্যের অভিজ্ঞতায় পৌঁছে দেয়া যাবে না।