শত্রুর সঙ্গে শত্রুতা করতে গেলে তার সঙ্গে ভাবের ক্ষেত্রে একটা মিলের প্রয়োজন। শত্রুর কথা ও আচরণের এমন একটা সাধারণ ভাষা আছে যার ভাবাৰ্থ উভয় পক্ষই সমানরূপে উপলব্ধি করতে পারে। উপলব্ধির এই সমানভূমিতে দাড়াতে না পারলে শক্রকেও শত্রু বলে চেনা যায় না। এই সমানভূমি হল মূলতঃ ভাষার ভূমি। মানুষের সম্পর্ক অনুকূলই হোক আর প্রতিকুলই হোক, সবই সামাজিক সম্পর্ক। এইরূপ সকল সামাজিক সম্পর্কের সামগ্রিক বিন্যাসকেই বলা যেতে পারে মানুষের সমাজ। ভাষা ছাড়া এ সমাজ গড়ে উঠত না, বাঁচতে পারত না, চলতে পারত না। এ কথাটা এত সহজ যে বলাটাই বোধ হয়। অপরাধ। কিন্তু ভাষা কি ক’বে সমাজ গড়ে, কি ক’রে মানুষকে সামাজিক করে এ আলোচনাটা বোধহয় অপরাধ নয়। কারণ এ নিয়ে প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল পৰ্যন্ত দার্শনিকদের মধ্যে বিচার-বিতর্ক চলে এসেছে। আমাদের দেশের প্রাচীন আলিঙ্কারিক আচাৰ্য্য দণ্ডী বললেন-ভাষা না থাকলে লোকযাত্ৰা অসম্ভব হত, জগৎসংসার অন্ধকারের অন্ধতায় ডুবে থাকত। ভাষা এক অত্যাশ্চৰ্য ঐন্দ্ৰজালিক আদর্শ। সাধারণ আদর্শ শুধু সম্মুখে উপস্থিত বস্তুকেই প্ৰতিবিন্বিত করতে পারে। কিন্তু এই বাঙাময় আদর্শ যা কিছু অনুপস্থিত তাকেও প্ৰতিবিম্বিত করে।
অনুপস্থিতকে উপস্থিত করতে পারা, অতীত ও ভবিষ্যতকেও বর্তমানের বুকে দাঁড় করাতে পারার এই বিস্ময়কর ক্ষমতার জন্যই ভাষা অতীত থেকে ভবিষ্যৎ পৰ্যন্ত প্রসারিত সমগ্র সমাজকে একটি সাধারণভূমিতে ধারণ করতে পারে। যে আমার সামনে উপস্থিত তাকে আমি একটি নাম দিয়ে সনাক্ত করতে পারি। এই সনাক্তনীকরণ নামের একটি গৌণ ব্যাপার মাত্র। কিন্তু আর একটি বৃহৎ ব্যাপারের উপায় হিসাবে কাজ করে বলেই এই গৌণ ব্যাপারটির অসামান্য গুরুত্ব রয়েছে। উপস্থিতকে নাম ধরে ডাকার জন্যই নামকরণ করা হয়নি। যে অনুপস্থিত তার নাম ধরে যখন অন্যের অভিজ্ঞতা ও বোধের ভিতরে তাকে উপস্থিত করতে পারি তখনই নামকরণের চরম সার্থকতা। শিশু আঙল দিয়ে দুধের বাটি দেখিয়ে দেয়। এই অঙ্গুলিনির্দেশ সে মায়ের কাছ থেকে দেখে শিখেছে। প্ৰথম অবস্থায় এটা একটা অনুকরণ মাত্র। পরে এই অঙ্গুলিসংকেত আর নিছক অনুকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। কারণ অনুকরণটাই সংকেত নয়। অঙ্গলি-সংকেতের দ্বারা শিশু যখন মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তার দুধের পিপাসা মাকে জানায় তখন যান্ত্রিক অনুকরণ সার্থক সংকেতে পরিণত হয়। এই অঙ্গুলি-সংকেতের স্তর অতিক্রম করে শিশু যখন ভাষার সংকেত শিখতে পারে, তখন তার চেতনা ও একটা নূতন স্তরে উন্নীত হয়। নিজের বুদ্ধির ভিতরে দুধকে দুধের বাটি থেকে আলাদা করা বুদ্ধি-বিকাশের প্রথম পৰ্য্যায়েই সম্ভব নয়। আধার থেকে আধেয়কে আলাদা করে বোঝার এই ক্ষমতা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে আয়ত্ত করতে হয়। দুধকে “দুধ’ বলে চিনতে পারা তখনই অর্থপূর্ণ, যখন দুধের অনুপস্থিতিতেও শব্দটি উচ্চারণ করে শিশু মাকে তার জৈবিক প্ৰয়োজন ও মানসিক অভিপ্ৰায় জানাতে পারে। যে পৰ্য্যন্ত ভাষাজ্ঞান বস্তুর উপস্থিতিতে শব্দটি উচ্চারণ করতে পারার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সে পৰ্য্যন্ত শব্দটি একটি সনাক্তীকরণের চিহ্নমাত্ৰ, কোন বস্তুর উপস্থিতির দ্বারা উদ্দীপিত একটু উচ্চস্তরের জৈবিক প্রক্রিয়া মাত্র। কিন্তু শিশু যেদিন তার ক্ষুধা তৃষ্ণ শান্ত করার জন্য সামনে দুধ না দেখেও মাকে দেখে “দুধ’ বলে কান্না জুড়ে দিতে পারে, সেদিন তার শব্দজ্ঞান চিহ্ন থেকে সংকেতে উন্নীত হয়েছে, তার চেতনায় তখন এক বৈপ্লবিক পরিবতন এসেছে। শিশু সেদিন নিজের চেতনাকে মায়ের চেতনায় সঞ্চারিত করার উপায় খুঁজে পেয়েছে। অন্যের ভিতরে নিজের আশানুরূপ প্ৰতিক্রিয়া সৃষ্টির জন্য শব্দের দ্বারা নিজের অভিপ্রেত অর্থকে অন্যের চেতনায় উপস্থিত করার এই বিস্ময়কর ক্ষমতাই শব্দ-জগতকে মানুষের চেতনার এক সাধারণ ভূমিতে পরিণত করে। স্বর্তন্ত্র ব্যক্তিসত্তার একই সমান চেতনায় এই মিলন সম্ভব করে মানুষের ভাষা। সমাজ মানেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে অভিজ্ঞতার, চেতনার সঙ্গে চেতনার এই সমকেন্দ্রিক মিলন। মানুষের চেতনার এই সাধারণীকরণকেই বলা যেতে পারে মানুষের সমাজীকরণ।
আমাদের গৌড়ীয় বৈষ্ণবদর্শনে নামের মহিমা কীর্তনের জন্য নাম ও নামীর অভেদতত্ত্ব উপস্থিত করা হয়েছে। এই তত্ত্বের আধ্যাত্মিক রহস্য আমাদের অজ্ঞাত। আমরা এ আলৌকিক রহস্তে দীক্ষিত নই। তবু এই তত্ত্বের একটা লৌকিক দার্শনিক দিক্ রয়েছে যা আমাদের বিচারবুদ্ধির একান্ত অগোচর নয়। যার নাম দেবদত্ত, তার কোন নাম না থাকলেও অনামা হয়ে সে বেঁচে থাকতে পারত। কিন্তু মানুষটি কাছে না থাকলেও তার সম্পর্কে অন্যকে কিছু বুঝাতে হলে তার একটা শব্দাত্মক নাম, অগত্যা একটা বৰ্ণনাত্মক নামের প্রয়োজন আছে। নামের অর্থ যদি নিছক ব্যক্তিটিই হত। তবে অন্যের কাছে দেবদত্তকে বুঝাবার জন্য সব সময়ই দেবদত্তকে ধরে এনে হাজির করার প্রয়োজন পড়ত। নামের অর্থ আর নামী ব্যক্তিটি এক হলে ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে শুধু নামের দ্বারাই অর্থের বোধ জন্মানো যেত না। অর্থটি বক্তা ও শ্রোতার কাছে সাধারণ, কিন্তু ব্যক্তিটি অসাধারণ। বক্তা ও শ্রোতার চেতনায় সমানভাবে বিধৃত এই অর্থটিকে কিন্তু নাম থেকে আলাদা করা যায় না। নামের সঙ্গে অচ্ছেদ্য সম্বন্ধে বিজড়িত না হয়ে কোন অর্থই জ্ঞানের ভিতরে ধরা পড়ে না। অর্থের সঙ্গে নামের এই একাত্মতাকেই নাম-চিহ্নিত ব্যক্তির সঙ্গে একাত্মতা বলে একটা ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দেয়া হয়। এই ভ্ৰান্তির মূল কারণ হল শব্দনির্দিষ্ট ব্যক্তি ও শব্দার্থকে এক বলে মনে করা। বক্তা ও শ্রোতা, লেখক ও পাঠকের সমান চেতনাবিধৃত একটি সাধারণ অর্থের সঙ্গে শব্দের এই একাত্মতাকেও প্ৰকারান্তরে নাম ও নামীর অভেদ বলা যেতে পারে। শব্দ যে সাধারণ অর্থটিকে শ্রোতার কাছে উপস্থিত করে, সেই প্ৰকাশযোগ্য অর্থসামান্যকেই সাক্ষাৎ সম্বন্ধে নামী বলা উচিত। কারণ নাম সাক্ষাৎভাবে তাকেই প্ৰকাশ করে। এই অর্থেই নাম ও নামী অভিন্ন, কারণ নাম ও অর্থ একাত্মক। যে ভক্তি-দর্শনের মতে ঈশ্বর এক অলৌকিক বিরাট ব্যক্তিবিশেষ তার পক্ষে ‘ঈশ্বর’ এই নামের সঙ্গে নামী ঈশ্বরের অভেদ কল্পনা করা এলৗকিক বুদ্ধির অগম্য। কিন্তু ঈশ্বর বলতে যদি এক নৈর্ব্যক্তিক সর্বাত্মক চেতনাকে বুঝি, তাহলে আমরা আস্তিকই হই আর নাস্তিকই হই, আমাদের বুদ্ধির সীমানার মধ্যে এক সাধারণ অর্থবোধের ভিত্তিতে নাম ও নামীকে একাত্মা বলে কল্পনা করতে পারি। এই অর্থবোধের সমভূমিতে আমার চেতনাকে “ঐশ্বরিক’ চেতনা থেকে আলাদা করতে পারিনা। এই দিক থেকে বিচার করলে ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য” মূলক ভক্তিদর্শনের তুলনায় ভর্তুহরির বৈদান্তিক শব্দাদ্বৈতবাদ মানুষের বিচারবুদ্ধির অনেক বেশী কাছাকাছি। অবশ্য আমাদের এই কথাগুলিকেই শব্দাদ্বৈতবাদের সার ও শেষ সিদ্ধান্ত বলে কেউ যেন ভুল না করেন। যে দর্শনের ভিতরে অনেক কিছুই বিচারবুদ্ধির অগোচর, তাকেও যতখানি বুদ্ধির সীমানায় টেনে আনা সম্ভব ততখানিই চেষ্টা করা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে একথাও মনে রাখা উচিত, যাকে বাক্য ও মনের অতীত বলে মনে করা হয় তাকে বাক্যময় মননের মধ্যে টেনে আনার চেষ্টা করলে অনেকখানি বিকৃতিও অবশ্যম্ভাবী । কিন্তু এই বিকৃতি মেনে না নিলে কোন ব্যাখ্যাই সম্ভব নয়।